Logo
Logo
×

বাতায়ন

সুন্দর থেকে সুন্দরতর ভবিষ্যতে

Icon

অমিত রায় চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বর্ষবরণ সভ্য সংস্কৃতির স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। নানা দেশে নানা বেশে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর রীতি আছে। প্রতিটি উদযাপনের ভঙ্গিতে নিজস্বতা থাকে, থাকে চর্চাভেদে বৈচিত্র্য। উৎসবের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। ঐতিহ্যকে ধারণ করেই সময় এগিয়ে চলে, বিবর্তনের ধারায় মননের পরিশীলন ঘটে, অমোঘ সত্য ও ধ্রুপদি সুন্দরের বহমান কালস্রোত শাশ্বত সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে আর মানবসভ্যতা পরিণত হয় বিবিধতার সঙ্গমে।

অখণ্ড সময় ভাবনার গর্ভেই কালের চলমানতা। প্রকৃতির ঋতুনির্ভর আবর্তিত রূপ ও বৈশিষ্ট্যভেদে সময়ের বিভাজিত খেয়া বেয়েই আমরা আজ আরও একটি নতুন বছরের আঙিনায় উপনীত। নতুনের প্রতি বাঙালির আকর্ষণ দুর্নিবার, প্রেম শাশ্বত। সেটাই বাঙালির চিরায়ত প্রকৃতি। আর বিমূর্ত প্রকৃতি চেতনার মাঝেই বাঙালির উত্তুঙ্গ বাঙালিয়ানা, বাঙালি হয়ে ওঠা।

বাঙালি আবেগপ্রবণ, উৎসবমুখিন, অতিথিপরায়ণ। এ জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা, জাতীয়তাবোধ ও সংবেদনশীলতা কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। গাঙ্গেয় সমতল ভূমিতে বসবাসকারী প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরনো এ নৃ-গোষ্ঠীর জীবনচর্যা, অর্থনীতি, ধর্মাচরণ- যে কোনো মানদণ্ডে উদার, মানবিক ও শিল্পমণ্ডিত। একটি মিশ্র নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার বহন করেও বাঙালির আবহমান মাঙ্গলিক চেতনা, সূক্ষ্ম জীবনবোধ, রুচির আভিজাত্য এবং অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বাঙালি জাতিসত্তায় এক দুর্লভ মাত্রা সংযোজন করেছে।

বাঙালি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ, মর্যাদাশীল জাতিগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, অহিংস জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথনকশা বিশ্বের যে কোনো নিপীড়িত মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর রোল মডেল। আর তার রয়েছে একটি সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস চেতনানির্ভর। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের মানচিত্র, একটি বিকাশমান জাতির সম্মিলিত প্রত্যাশার দলিল, বঞ্চনা থেকে মুক্তির সনদ। যেখানে এ ভূখণ্ডের মানুষের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য- সবকিছুই সংযুক্ত।

মহাকালের বিশালত্ব বিবেচনায় মানবজীবনের ব্যপ্তি খুবই নগণ্য। এ সংক্ষিপ্ত সময়কে, যাপিত জীবনকে উপভোগ্য, পরিশীলিত ও অর্থবহ করে তোলার জন্য সৃষ্টির সেরা মানুষের প্রয়াস ক্লান্তিহীন, নিরলস। উৎসব এমনই একটি অনুপম উপকরণ, যা মানুষের নির্জীব প্রাণে জলসিঞ্চন করে, অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল করে। উৎসবের মধ্যেই একতার সুর, মিলনের অণু-পরমাণু। জীবন যত কর্মমুখর হচ্ছে, যন্ত্রের দাপট হচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর, ব্যক্তিজীবনের পরিসর যত সংকীর্ণ হয়, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা ততই প্রকট হয়ে পড়ে। ব্যক্তি মানুষ তখন সমষ্টির মাঝে একতার সান্নিধ্যে শক্তির মাহাত্ম্য অনুভব করে, অভিন্ন ধারায় বিলীন হওয়ার আকাক্সক্ষায় নিঃসঙ্গ মন মুক্তির আনন্দে নির্ভার হতে চায়, বৃহতের সঙ্গে সংযুক্তির অভিলাষে সে সমর্পিত হতে চায় বাঙালির মূল স্রোতে, বিশাখার দ্যুতিধন্য বৈশাখের প্রথম প্রহরে।

হাজার বছরের বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হল উৎসবময়তা। এ ভূ-রাজনৈতিক সীমায় আবদ্ধ শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর, গতিশীল ও কাঠামোবদ্ধ করার প্রয়াসে চান্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার ব্যবহার লক্ষণীয়। পৌরাণিক কাল থেকে সম্রাট আকবর হয়ে বাংলা একাডেমি অবধি নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিমূর্ত সময়ের ধারণা বিবর্তিত হয়েছে। কালের যাত্রাপথে চান্দ্র পঞ্জিকা থেকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তর এবং সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার পরিমার্জন সম্পন্ন হয়েছে। কৃষি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা- সবখানেই সময়ের এ জ্ঞানভিত্তিক বিভাজনের নির্বিকল্প আবশ্যিকতা প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত। তাই ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি নবান্ন, বর্ষবরণ, পৌষ উৎসব, বসন্তবরণ, চৈত্রসংক্রান্তির মতো ঋতুধর্মী সামাজিক উদযাপন বাঙালির সর্বাত্মক, সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এসব চিরায়ত লোকসংস্কৃতির অংশ কালের পরিক্রমায় একটি স্থানিক ও কালিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে উঠেছে।

সংস্কৃতি কৃত্রিমভাবে আরোপযোগ্য নয়। জোর করে কিছু আরোপ করলে সভ্যতা তাকে রুখে দেয়। সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস তাই বলে। পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী সামন্ত শ্রেণী কায়েমি স্বার্থে ’৫২-তে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে পক্ষান্তরে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভ্রূণ সঞ্চার করেছিল। এরপর রবীন্দ্রচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বেগবান করেছে, ’৬৫-তে ছায়ানট রমনা বটমূলে বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরিত ভ্রূণের পরিচর্যা করেছে, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক মুক্তি। ’৭২-এ বর্ষবরণ জাতীয় দিবসের মর্যাদা লাভ করে, ’৮৯ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা সংস্কৃতির অন্তর্গত সামর্থ্য ও সৌন্দর্য রাষ্ট্রীয় পরিধি টপকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিকতার সঙ্গে লোকজ কৃষ্টির মেলবন্ধন বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিয়েছে।

সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এ প্রজন্মের একজন বাঙালিকে বৈশাখ যা শেখায়, তা হল সংগ্রামের দীক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়রথ চালনার সংকল্প। বাঙালির বর্ষবরণ তার নিজস্ব আঙ্গিকে বাঁধা। ভাবনার সংকীর্ণতা আমাদের চেতনাকে কলুষিত করে, ধারণার অসহিষ্ণুতা আমাদের বিভক্তির পথে চালিত করে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গে যখন ন্যায়ভ্রষ্টতার আধিপত্য, চিরকালীন সামাজিক মূল্যবোধ যখন আক্রান্ত, বাঙালি সংস্কৃতির শুষ্ক প্রায় ধারাটিকে প্রাণসঞ্চার করে সজীব করে তোলার তাড়নাকে, তখন ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়, প্রয়োজন দেখা দেয় বাঙালির চিরকালীন সাংস্কৃতিক মননকে বিকশিত করার। কেবল উন্নত দেশের অভিজাত বলয়ে প্রবেশগম্যতা নয়, নিছক বৈষয়িক সমৃদ্ধি নয়, দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। বিভ্রান্তি-বিকৃতির ধোঁয়াশা নয়, দরকার একটি উদার, মানবিক, ন্যায়ানুগ, উন্মুক্ত সমাজ গঠনের উর্বর ক্ষেত্র। ধর্ম পোশাকে নয়, বিশ্বাসে, মননে। রাজনীতি মঞ্চে নয়, আচারে, মগজে। শুধু নিজে নয়, অন্যকে নিয়ে বাঁচার সংকল্পই হোক আগামী দিনে পথচলার শক্তি।

ভরসা রাখতে চাই- এবারের বর্ষবরণ উৎসবে বাঙালি আবার ফিরে যাবে তার শিকড়ের দিকে, মাটির টানে, মেতে উঠবে লোকায়ত নাচ, গান, যাত্রাপালা, মেলা, নৌকাবাইচ, কবিগান আরও কত অজানা নির্দোষ সংস্কৃতিচর্চায়। বাণিজ্য বিতানে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানে শুধু লেনদেনের হিসাব নয়, আত্ম অনুসন্ধানের পাতাটিও উল্টাতে হবে আমাদের চারপাশে- শাব্দিক অর্থেই শুদ্ধাচার স্থাপনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞায়।

পুরাতনের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে প্রতিটি নূতনই ভেসে চলে অনন্তের পথে। সে চিহ্ন কখনও প্রবল, কখনও প্রচ্ছন্ন। নতুনের মাঝে পুরাতনের, বর্তমান বা ভবিষ্যতের মাঝে অতীতের উপস্থিতি অমোঘ। জীর্ণ, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, মলিন যা কিছু- সব ভুলে নতুনের যাত্রা হোক শুরু। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য বেঁচে থাক চিরকাল; বিদ্বেষ, হানাহানি, বিচ্যুতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণই হোক নববর্ষের শপথ। নতুন বছর ভালো কাটুক, সমৃদ্ধির পথে আরও এগোক মানবজাতি।

অমিত রায় চৌধুরী : অধ্যক্ষ ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, বাগেরহাট

principalffmmc@gmail.com

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম