দুর্নীতি আর উন্নয়ন একসঙ্গে চলতে পারে না
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও দলীয় সরকারগুলো সব সময় দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণে বন্দি করে ফেলতে চায়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি-প্রতিটি দলের সরকারের সময়ই এ ধারার উগ্র আচরণ লক্ষ করেছি।
সম্ভবত গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে না পারায় জনগণের শক্তিকে ভরসা করতে পারেনি সরকারগুলো। সব ক্ষেত্রে নিজ দলের লাঠিয়ালদের বসিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে। জনগণের উচ্চকণ্ঠ কেউ পছন্দ করেনি। তাই দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছে। শক্ত ভিত্তির ওপর না দাঁড়ানো বিএনপি আর জাতীয় পার্টির না হয় দলীয় শক্তির ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় ছিল না-আওয়ামী লীগ ও তার সরকার কেন দলতন্ত্রে আটকে থাকবে? স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকারের হয়তো অনেক সংকট ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে এগোতে হয়েছে।
কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের ওপর তেমন চাপ নেই। আমাদের প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম থাকায় অনেকটা নির্ভার হয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে দেবে আওয়ামী লীগ সরকার। দলতন্ত্রে আটকে না থেকে সাধারণ ও গুণী মানুষের মূল্যায়ন করা হবে। এভাবে দেশ একটি সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে। কিন্তু সে পরিস্থিতি বা পরিবেশ আমরা দেখতে পাইনি-পাচ্ছিও না।
আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিকতা ও শ্রমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত হয়েছে। অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি ঘটছে। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছার মহাসড়কে হাঁটছি। কিন্তু দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হয়, গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তি না থাকে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বলার পর আমলা-মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, সরকারের নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এরকম নানা ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তাহলে সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা অমানিশায় ঢাকা পড়বে। অনেকের বিশাল দুর্নীতির খতিয়ান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
কোনো কোনো দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্টে অনেকে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেসব দুর্নীতির কোনো বিচার মানুষ দেখতে পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সরকার যেন দুর্নীতিবাজদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নিম্ন আদালত প্রসঙ্গ।
বহুকাল ধরেই নিম্ন আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা কম। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনো ঘটনায় সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে প্রভাবশালীদের প্রভাব নিম্ন আদালতের পক্ষে এড়ানো কঠিন। ইতোমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোতে সরকার যে ব্যর্থ, তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলেও সড়ক পরিবহণ শ্রমিক সংগঠন, পরিবহণ শ্রমিক, মালিকদের সংগঠিত শক্তির কাছে পরাভব মানতে হয়েছে।
এসব কারণেই আমাদের আশঙ্কা, দেশে এতসব নৈরাজ্য বজায় রেখে উন্নয়নের উজ্জ্বল আলোক রেখার স্থায়িত্ব ধরে রাখা কঠিন হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে বলা যাবে এবারের আওয়ামী লীগ সরকারই দুর্বলতম বিরোধী দলের মোকাবিলা করে শাসন পরিচালনা করছে। এমন বাস্তবতায় শাসকদের পক্ষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ, গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার পথও তৈরি হয়ে যেতে পারে সহজেই। কিন্তু মনে হয় না সেই ছন্দে হাঁটতে পারছে সরকার। রাজনীতি ও প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারলে সরকার তার শক্তি অর্জন করতে পারবে না।
দলীয় স্বার্থে যখন দুর্নীতিবাজদের পক্ষপুটে রাখতে হয়, তখন আর শাসন করার সুযোগ থাকে না। আমলা যখন জানে সরকার গঠনে দলীয় রাজনীতিকরা তাদের ওপর নির্ভর করে, তখন সরকার গঠনের পর সেই সরকার স্বাভাবিকভাবে আমলাদের সব দাবি মেনে নেয়। মাপ করে দেয় তাদের সব অপরাধ। এভাবে এরা দুর্বিনীত হয়ে পড়ে। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও আমলারা অপরাধ করেও বুকটান করে কণ্ঠ চড়ায়।
উনিশ শতকের ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি তার বিখ্যাত সূত্র ‘Theory of Challenge and Response’ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, বিরুদ্ধ প্রকৃতি-পরিবেশ সব প্রাণীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একে মোকাবিলা করতে পারলেই টিকে থাকা, নয়তো হারিয়ে যাওয়া। লাখ লাখ বছর ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তেলাপোকা টিকে থাকলেও বরফযুগের অতিকায় প্রাণী ম্যামথ রূপান্তরিত উষ্ণ প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে নির্বংশ হয়েছে।
কিন্তু আমরা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন-সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। একটুখানি নিকট অতীতের দিকে তাকাতে চাই। বিএনপি-জামায়াত পরিচালিত জোট সরকার অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল এদেশের মানুষকে।
রাজনৈতিক সংঘাত ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল। সব চরমই ধ্বংস বা রূপান্তরের পথ তৈরি করে। আমাদের সংঘাতের রাজনীতি পথ করে দিল রূপান্তরের। বিবদমান রাজনীতিকরাই ডেকে এনেছিলেন বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
অতঃপর দু’বছরের চড়াই-উতরাইয়ে বড় সাফল্য একটি অবাধ নির্বাচনের পথ তৈরি হওয়া। দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য ধারণ করা বাঙালি হাজার সংকটের পরও বারবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নির্বাচন সামনে রেখে আবার স্বপ্ন বুনে। সেবার সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ।
জোট সরকারের শাসনকালের অপকীর্তি মুক্তমনের ভোটারকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। বিপুলসংখ্যক ভুয়া ভোটারের তালিকা ও সাজানো নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কর্মকর্তাদের বিন্যাস অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় কার্যত বিএনপি ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল।
নির্বাচনের মাঠে জামায়াত কখনো খুব ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। অতীতের নানা হতাশার কথা ভুলে মানুষ যখন গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আশায় ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকেই মন্দের ভালো বলে বিবেচনা করছিল, ঠিক সে সময়েই চিত্তাকর্ষক নির্বাচনি ইশতাহার নিয়ে এসেছিল এই দলটি। দিনবদলের স্লোগান মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে উৎসাহী করে।
সবাই ভেবেছিল আন্তরিকতা নিয়েই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিন বদলাতে চান। অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন জরাগ্রস্ত দিনের শাপমুক্তি ঘটিয়ে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে টেনে নেওয়ার মতো নতুন দিনের যাত্রা শুরু করবে মহাজোট সরকার। সুন্দর সকাল দেখার স্বপ্নে বিভোর এদেশের মানুষ সরল হিসাব কষেছিল। ভেবেছিল ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হবে। অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো এ বেলা শুধরে নেবে।
অন্যায়-দুর্নীতি-সন্ত্রাস বিএনপিকে কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন করেছিল, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কাছে থেকে দেখেছে। উপরি পাওনা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধস্নাত এ দলটি পেয়েছে বিপুল জনসমর্থন। এসব কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল এদেশের নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে জাতি এবার আওয়ামী লীগের হাত ধরে বেরিয়ে আসবে। ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরবে দেশ। নেতৃত্বের মনোবল এবার আকাশছোঁয়া হবে। দলীয়করণের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে নিঃশঙ্ক চিত্তে। দেশপ্রেমিক মানুষকে কাছে টেনে বন্ধু বাড়াবে। তারপর দিন বদলে দেওয়ার কঠিন অথচ মহৎ সংগ্রামে সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এদেশের রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি হতে না পারায় আইনব্যবস্থা কখনো স্বাধীন হতে পারেনি। বাংলার ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দুশো বছর। বাংলার সুলতানরা বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন করে দিয়েছিলেন।
এ কারণে ক্ষমতাবান কাজী আইনের প্রকৃত রক্ষক হতে পেরেছিলেন। সুলতানরা ছিলেন বিচারব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। কাজী তাই স্বয়ং সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিঃশঙ্ক চিত্তে গ্রহণ করতেন। সুলতানি বাংলার কাজীর আদালতে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্মুরাবি ধাঁচের আইন কার্যকর ছিল না। অর্থাৎ একই অপরাধে ধনী আর ক্ষমতাবানের জন্য লঘু শাস্তি এবং দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জন্য গুরু শাস্তি। সুলতানের অপরাধ প্রমাণিত হলে কাজীরা আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তি দিতে দ্বিধা করতেন না।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি আইনের শাসনকে স্বাধীন হতে দিল না। এ বাস্তবতা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বেপরোয়া করে তোলে। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির দুর্নীতি উন্মোচন করেছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির কিছু খতিয়ানও প্রকাশ্যে আসে। তবে বিএনপির তুলনায় তা ছিল নস্যি। হেভিওয়েট দুর্নীতিবাজরা আইনের হাতে ধরাশায়ী হতে থাকেন।
এই ভূমিকম্পের পর এদেশের স্বাপ্নিক মানুষ আশা করেছিল বিএনপির দুর্নীতিবাজদের পরিণতি দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দুর্নীতিবাজরা সে শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। এ কারণে আইনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুস একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির খতিয়ান।
বড় বড় দুর্নীতিবাজ তো রাজনৈতিক শক্তিমানদের প্রশ্রয়েই পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে। পাপুল, পাপিয়া, সাহেদ, সাবরিনারা এতটা পথ হাঁটতে পেরেছেন কেন, তা বুঝতে সাধারণ মানুষের তেমন অসুবিধা হয় না। বড় দাগে সরকারি টাকা লোপাট, খুঁটি শক্ত না থাকলে কী আর করা যায়! রূপপুরের বালিশ-কাণ্ডের পর মনে হচ্ছিল সমুদ্রচোররা হয়তো সংযত হবে। কিন্তু এরপর থেকে তো ক্রমাগতভাবে সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এ মিছিলে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।
এমন ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অর্থাৎ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিকল্প নেই। রাতের পরে দিন আসবে। এভাবে ঘুরে আসবে নতুন বছর; কিন্তু দিন বদলাবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতে পারলেই সম্ভব নতুন সূর্যোদয়ের।
না হলে পদ্মা সেতু হবে, মেট্রোরেল হবে আরও দৃশ্যমান উন্নয়নও হয়তো আমরা দেখব; কিন্তু দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের পাগলা ঘোড়াকে থামাতে না পারলে সবকিছুই যে অর্থহীন হয়ে যাবে, তা কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন? দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের শেকল ভাঙতে না পারলে সব আশার আলোই একসময় ম্লান হয়ে যাবে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
