উপযুক্ত কৌশল অবলম্বনে বজ্রপাত থেকে বাঁচা যায়
jugantor
উপযুক্ত কৌশল অবলম্বনে বজ্রপাত থেকে বাঁচা যায়

  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু  

২৯ মে ২০২১, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বজ্রপাতের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার বাতাসের প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে বিকট শব্দ হয়। এ ধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ ও ভূমির মধ্যেও হতে পারে। তবে মেঘ থেকে ভূমিতে ধাবিত বজ্রপাত মানুষ ও সম্পদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপ্তি অনেক এলাকাজুড়ে হলেও বজ্রপাত নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ এবং সব সময় বজ্রপাত হয় না।

এ দেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, যা ভারত মহাসাগরের একটি অংশ- যেখান থেকে আসে গরম আর আর্দ্র বাতাস। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয়, যেখান থেকে ঢুকে ঠাণ্ডা বাতাস। আর এ দুই বাতাসের সংমিশ্রণ তৈরি করছে বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ।

বন্যা ও সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক। দেশে প্রতিনিয়ত বজ পাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর মে মাস দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে অনুকূল সময় হয়ে উঠছে। দেশে সারা বছর ধরে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে মে মাসে হয় সবচেয়ে বেশি।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বছরে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। এক বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিনই বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে জুনে হয় ৭০ শতাংশ। ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট ১ হাজার ৮৭৮ জন বজ পাতে মারা গেছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশই কৃষক। যদি কেউ খালি মাঠে বা পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে সমতল ভূমির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উচ্চতা বেশি হওয়ায় তিনি সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হতে পারেন।

অন্যদিকে কেউ যদি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যেমন মুঠোফোনে কথা বলেন বা কম্পিউটারে কাজ করেন অথবা টিনের ঘরে টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকেন, তাহলে বজ্রপাত থেকে নির্গত অতিরিক্ত ভোল্টেজের সংস্পর্শে তিনিও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। শস্যরোপণ বা আহরণের কাজে কৃষক মূলত দুই পা আড়াআড়ি করে সারিবদ্ধ অবস্থায় জমিতে কাজ করেন। তারা স্টেপ ভোল্টেজের কারণে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বজ্রপাতে বছরে প্রাণহানি ঘটে প্রতি ১০ লাখে ১ দশমিক ৬ জনের। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে প্রতিদিন প্রায় দুজন বজ্রঝড়ের কারণে মারা যায়। কারণ, মার্চ থেকে জুন মাসে কৃষক বোরো ধান রোপণ ও কাটার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারা মাঠে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে কাজ করেন। ফলে তারা বজ্রপাতের আঘাতের প্রথম শিকার হন। বাড়িতে ফেরার পথে বজ্রপাতে মারা যান ১৪.৫ শতাংশ। আর পুকুর-নদীতে গোসল করা এবং মাছ ধরার সময় মারা যান ১৩.৪ শতাংশ। অপরদিকে মোট প্রাণহানির ২১ শতাংশ ঘরের অভ্যন্তরে ঘটে থাকে।

আমরা একটু সচেতন হলেই বজ্রপাত থেকে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। যেমন- কেউ যদি ঘরের ভেতরে থাকেন, তাহলে বজ্রবৃষ্টির সময় কিছু সতর্কতা গ্রহণ করা জরুরি- ক. ফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা; খ. পাম্বিং যেমন বাথটাব, রান্নাঘরের ধাতব পদার্থ থেকে দূরে থাকা; গ. ঘরের জানালা, দরজা বা যে কোনো প্রবেশদ্বার থেকে দূরে থাকা; ঘ. বজ্রপাতের সময় কোনো অবস্থাতেই কংক্রিটের ওপর শোয়া যাবে না বা দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে থাকা যাবে না। আর বজ্রপাত বা বজ ঝড়ের সময় যদি কেউ বাইরে থাকেন, তাহলে ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই যে বিষয়গুলোয় খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে- ক. অবশ্যই উঁচু স্থান এড়িয়ে চলতে হবে বা নদী, পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদির আশপাশে থাকা যাবে না; খ. কোনো অবস্থাতেই ভূমিতে শোয়া যাবে না বা বিচ্ছিন্ন কোনো বড় গাছের নিচে দাঁড়ানো যাবে না; গ. বৈদ্যুতিক তারের বেড়া, ধাতব পদার্থ বা সংশ্লিষ্ট বস্তু (টাওয়ার) থেকে দূরে থাকা। কারণ, ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বজ্রপাত অনেক দূর পর্যন্ত চলাচল করতে পারে; ঘ. বজ্রঝড়ের সময় পুকুর, নদী-নালা বা হ্রদে মাছধরা বা নৌকাভ্রমণ পরিহার করা; ঙ. অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকলে (যেমন খেলার মাঠে) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করা উচিত। কারণ বজ্রঝড়ের সময় মানুষ একত্রে থাকলে একসঙ্গে অনেকের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।

আমাদের দেশে যেহেতু বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তাই বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ১৮টি উপায় বলে দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। উপায়গুলো হচ্ছে- ১. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয় এবং এর সময়সীমা সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। সুতরাং এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে হবে। ২. ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না (জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে জুতা পরে বের হতে হবে)। ৩. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় বা খোলা মাঠে অথবা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। ৪. বজ পাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে দ্রুত পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। ৫. যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। ৬. উঁচু গাছপালা এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইলের টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ৭. আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। ৮. বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না এবং সম্ভব হলে গাড়ি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ৯. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকা যাবে না। পাশাপাশি জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ১০. বজ পাতের সময় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ১১. বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে হবে। ১২. বজ্রপাতের সময় শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্কদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে হবে। ১৩. বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। ১৪. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। ১৫. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যেতে হবে। ১৭. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতে হবে। ১৮. বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা নিতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসক ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বর্তমানে দেশে বজ্রবৃষ্টির মৌসুম চলছে। এ অবস্থায় বজ্রপাত বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়ানো অতি জরুরি। কারণ বায়ুমণ্ডলীয় এ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথ সামান্য। নতুবা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঝড় ও বজ্রপাত আমাদের জীবন-জীবিকাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ- কখন ও কোথায় বজ্রঝড় হতে পারে, তা আবহাওয়ার সংবাদ থেকে জেনে নেওয়া এবং ঝড় ও বজ্রপাতকালীন নিয়মাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যদিও বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য তালগাছ লাগানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, তবে তালগাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। বস্তুত বজ্রপাত ঠেকানোর কার্যকর উপায় এখন পর্যন্ত মানুষের অজানা। তবে মানুষ যদি সচেতন হয়ে উল্লিখিত কৌশলগুলো যথাযথভাবে অবলম্বন করে, তাহলে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি বহুলাংশে কমানো সম্ভব।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট, গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনাল (নেদারল্যান্ডস)

kekbabu@yahoo.com

উপযুক্ত কৌশল অবলম্বনে বজ্রপাত থেকে বাঁচা যায়

 ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু 
২৯ মে ২০২১, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বজ্রপাতের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার বাতাসের প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে বিকট শব্দ হয়। এ ধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ ও ভূমির মধ্যেও হতে পারে। তবে মেঘ থেকে ভূমিতে ধাবিত বজ্রপাত মানুষ ও সম্পদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপ্তি অনেক এলাকাজুড়ে হলেও বজ্রপাত নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ এবং সব সময় বজ্রপাত হয় না।

এ দেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, যা ভারত মহাসাগরের একটি অংশ- যেখান থেকে আসে গরম আর আর্দ্র বাতাস। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয়, যেখান থেকে ঢুকে ঠাণ্ডা বাতাস। আর এ দুই বাতাসের সংমিশ্রণ তৈরি করছে বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ।

বন্যা ও সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক। দেশে প্রতিনিয়ত বজ পাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর মে মাস দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে অনুকূল সময় হয়ে উঠছে। দেশে সারা বছর ধরে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে মে মাসে হয় সবচেয়ে বেশি।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বছরে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। এক বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিনই বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে জুনে হয় ৭০ শতাংশ। ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট ১ হাজার ৮৭৮ জন বজ পাতে মারা গেছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশই কৃষক। যদি কেউ খালি মাঠে বা পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে সমতল ভূমির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উচ্চতা বেশি হওয়ায় তিনি সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হতে পারেন।

অন্যদিকে কেউ যদি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যেমন মুঠোফোনে কথা বলেন বা কম্পিউটারে কাজ করেন অথবা টিনের ঘরে টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকেন, তাহলে বজ্রপাত থেকে নির্গত অতিরিক্ত ভোল্টেজের সংস্পর্শে তিনিও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। শস্যরোপণ বা আহরণের কাজে কৃষক মূলত দুই পা আড়াআড়ি করে সারিবদ্ধ অবস্থায় জমিতে কাজ করেন। তারা স্টেপ ভোল্টেজের কারণে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বজ্রপাতে বছরে প্রাণহানি ঘটে প্রতি ১০ লাখে ১ দশমিক ৬ জনের। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে প্রতিদিন প্রায় দুজন বজ্রঝড়ের কারণে মারা যায়। কারণ, মার্চ থেকে জুন মাসে কৃষক বোরো ধান রোপণ ও কাটার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারা মাঠে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে কাজ করেন। ফলে তারা বজ্রপাতের আঘাতের প্রথম শিকার হন। বাড়িতে ফেরার পথে বজ্রপাতে মারা যান ১৪.৫ শতাংশ। আর পুকুর-নদীতে গোসল করা এবং মাছ ধরার সময় মারা যান ১৩.৪ শতাংশ। অপরদিকে মোট প্রাণহানির ২১ শতাংশ ঘরের অভ্যন্তরে ঘটে থাকে।

আমরা একটু সচেতন হলেই বজ্রপাত থেকে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। যেমন- কেউ যদি ঘরের ভেতরে থাকেন, তাহলে বজ্রবৃষ্টির সময় কিছু সতর্কতা গ্রহণ করা জরুরি- ক. ফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা; খ. পাম্বিং যেমন বাথটাব, রান্নাঘরের ধাতব পদার্থ থেকে দূরে থাকা; গ. ঘরের জানালা, দরজা বা যে কোনো প্রবেশদ্বার থেকে দূরে থাকা; ঘ. বজ্রপাতের সময় কোনো অবস্থাতেই কংক্রিটের ওপর শোয়া যাবে না বা দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে থাকা যাবে না। আর বজ্রপাত বা বজ ঝড়ের সময় যদি কেউ বাইরে থাকেন, তাহলে ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই যে বিষয়গুলোয় খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে- ক. অবশ্যই উঁচু স্থান এড়িয়ে চলতে হবে বা নদী, পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদির আশপাশে থাকা যাবে না; খ. কোনো অবস্থাতেই ভূমিতে শোয়া যাবে না বা বিচ্ছিন্ন কোনো বড় গাছের নিচে দাঁড়ানো যাবে না; গ. বৈদ্যুতিক তারের বেড়া, ধাতব পদার্থ বা সংশ্লিষ্ট বস্তু (টাওয়ার) থেকে দূরে থাকা। কারণ, ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বজ্রপাত অনেক দূর পর্যন্ত চলাচল করতে পারে; ঘ. বজ্রঝড়ের সময় পুকুর, নদী-নালা বা হ্রদে মাছধরা বা নৌকাভ্রমণ পরিহার করা; ঙ. অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকলে (যেমন খেলার মাঠে) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করা উচিত। কারণ বজ্রঝড়ের সময় মানুষ একত্রে থাকলে একসঙ্গে অনেকের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।

আমাদের দেশে যেহেতু বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তাই বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ১৮টি উপায় বলে দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। উপায়গুলো হচ্ছে- ১. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয় এবং এর সময়সীমা সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। সুতরাং এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে হবে। ২. ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না (জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে জুতা পরে বের হতে হবে)। ৩. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় বা খোলা মাঠে অথবা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। ৪. বজ পাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে দ্রুত পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। ৫. যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। ৬. উঁচু গাছপালা এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইলের টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ৭. আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। ৮. বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না এবং সম্ভব হলে গাড়ি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ৯. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকা যাবে না। পাশাপাশি জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ১০. বজ পাতের সময় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ১১. বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে হবে। ১২. বজ্রপাতের সময় শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্কদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে হবে। ১৩. বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। ১৪. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। ১৫. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যেতে হবে। ১৭. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতে হবে। ১৮. বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা নিতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসক ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বর্তমানে দেশে বজ্রবৃষ্টির মৌসুম চলছে। এ অবস্থায় বজ্রপাত বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়ানো অতি জরুরি। কারণ বায়ুমণ্ডলীয় এ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথ সামান্য। নতুবা ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঝড় ও বজ্রপাত আমাদের জীবন-জীবিকাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ- কখন ও কোথায় বজ্রঝড় হতে পারে, তা আবহাওয়ার সংবাদ থেকে জেনে নেওয়া এবং ঝড় ও বজ্রপাতকালীন নিয়মাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যদিও বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য তালগাছ লাগানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, তবে তালগাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। বস্তুত বজ্রপাত ঠেকানোর কার্যকর উপায় এখন পর্যন্ত মানুষের অজানা। তবে মানুষ যদি সচেতন হয়ে উল্লিখিত কৌশলগুলো যথাযথভাবে অবলম্বন করে, তাহলে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি বহুলাংশে কমানো সম্ভব।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট, গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনাল (নেদারল্যান্ডস)

kekbabu@yahoo.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

ঘটনাপ্রবাহ : বজ্রপাতে মৃত্যু