দেশপ্রেমের চশমা
শিল্প-সাহিত্যে কি সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে নেই?
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে এখন লেখকের ছড়াছড়ি। যেদিকে তাকাবেন কেবলই লেখক আর লেখক। এরা অবিরাম গতিতে লিখে চলেছেন। লিখছেন বই, প্রবন্ধ, ফিচার, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, সংগীত, চিত্রনাট্য, আরও কত কী। লিখছেন ম্যাগাজিনে আর শত শত পত্রপত্রিকায়। আবার অনেকে লিখছেন গবেষণামূলক জার্নালে। কাজেই এ দেশে লেখকের ঘাটতি নেই।
তবে এসব লেখকের কতজন প্রকৃত লেখক, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। আর প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে কতগুলো মানসম্পন্ন লেখা, আর কতগুলো আপসকামী, ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ এবং সহানুভূতিশীল ফরমায়েশি লেখা, সে বিষয় নিয়ে ভাবার আছে।
লেখালেখি একটি সৃষ্টিশীল কাজ। এ কাজে যারা জড়িত তাদের বলা হয় লেখক। তবে আমাদের সমাজে লেখকের ছড়াছড়ি হলেও তাদের কয়জনের লেখায় সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে? কয়জনের লেখা পড়ে কিশোর ও যুবসমাজ সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন? বিষয়টি অবশ্যই ভাবনা উদ্রেককারী। এই লেখক সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এর মধ্যে একশ্রেণির লেখক আছেন যারা নিজের খ্যাতির জন্য লিখেন। বণিকবৃত্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখেন। পদ-পদবি ও পুরস্কার পাওয়ার কথা মাথায় রেখে এরা সতর্কভাবে হিসেবি কলম ধরেন।
আরেক শ্রেণির লেখক আছেন, যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য লেখেন। মানুষকে সত্য, ন্যায়পরায়ণতা ও কল্যাণের দিকে ফেরানোর জন্য তারা তাদের লিখনিশক্তি ব্যবহার করেন। সত্যকে সত্য, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে এরা পিছপা হন না। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি মাথায় রেখে সাহসিকতার সঙ্গে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলম ধরেন। এরা বণিকবৃত্তির প্রভাবে প্রভাবিত হন না। এদের লেখায় অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ ধ্বনিত হয়। এমন লেখা থেকে সমাজ ও দেশ উপকৃত হয়। এমন লেখার প্রভাবে সমাজ পরিবর্তিত হয়। এসব লেখা পাঠ করলে যুবসমাজের মধ্যে দেশপ্রেম জাগে। এসব লেখার প্রভাবে পাঠকরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন।
এরা মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখান। এরা অন্যায়কারী শাসকের প্রলোভনে আকৃষ্ট হন না। ফরমায়েশি লেখা লিখে ইতিহাস বিকৃত করেন না। মিথ্যার সঙ্গে আপস করেন না। পদ-পদবির হিসাব না করে এরা গণমানুষের কল্যাণে কাজ করেন। এমন লেখকরা অনেক ক্ষেত্রে নিগৃহীত হন। পুরস্কার পান না। তবে পুরস্কার না পেলেও এরা গণমানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পান। ইতিহাসের পাতায় স্থান পান। যুগে যুগে সব সময় কিছুসংখ্যক এমন লেখক ছিলেন। হয়তো এরা সংখ্যায় কম ছিলেন। কিন্তু এরা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে নিজের লেখনী ব্যবহার করেছেন।
বেশি উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দীনবন্ধু মিত্র ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে ‘নীল দর্পণ’ নাটক লিখেছিলেন। জাতীয় কবি নজরুলও তার প্রতিবাদী কবিতাগুলোয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন উসকে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিবো জল।’ অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীন এ কবি পদ, পদক ও পদবির চিন্তা না করে দেশ ও মানুষের চিন্তা করে তার কবিতাকে বানিয়েছিলেন শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্র। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের প্রশংসা করে দু-চারটি কবিতা লিখে ঘরে বসে তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি আপসকামী সুবিধাভোগী কবি হননি। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা এভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিবাদী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এ আপেল মাহমুদ গোবিন্দ হালদারের রচনায় গেয়েছিলেন: ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’ শীর্ষক সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান। একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব’, পটুয়া কামরুল হাসান এঁকেছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে বাংলাদেশ’। কিন্তু কই এখনকার কবি-সাহিত্যিকদের লিখনীতে সে প্রতিবাদী চরিত্র দেখা যাচ্ছে না কেন? নাট্যজগতে এখন দীনবন্ধু মিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? নাটকে এখন কেন কেবল প্রেম আর প্রেম।
আর প্রেম বাদ দিলে যা থাকে তাকে কমেডি বলে দাবি করা হয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষের নাটক কই? একেবারেই যে সে রকম নাটক নেই আমি তা বলছি না। তবে তেমন নাটক খুঁজতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়। তাহলে কি চিত্রনাট্য নির্মাতারা হিসাব করে নাটক বানাচ্ছেন? তা না হলে গুমের ওপর নাটক কই? কজন নাট্যকার ক্রসফায়ারের ওপর নাটক লিখেছেন? এগুলো কি জীবনের অংশ নয়? গণতন্ত্রহীনতা, রাজনৈতিক দুর্নীতির ওপর কোনো নাট্যকার কি নাটক লিখেছেন? এগুলো জীবনের অংশ নয়? সাহিত্যে এর প্রতিফলন থাকবে না কেন?
জীবনের পূর্ণ অবয়বের প্রতিফলন না পড়লে আমরা কীভাবে বর্তমানকালের সাহিত্যকে ‘সমাজের দর্পণ’ বলে আখ্যায়িত করতে পারব? বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, অধিকাংশ সরব কবি-সাহিত্যিক আর নাট্যকার পদ-পদবি আর পুরস্কারের হিসাব কষে আপসকামী ও সহানুভূতিশীল সাহিত্য রচনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তা না হলে সাহিত্যের প্রতিবাদী ধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছে কেন?
যেসব নাটককে কমেডি দাবি করা হচ্ছে, তা দেখলে তো হাসি আসে না। ভাঁড়ামি মনে হয়। তার মধ্যে আবার প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি কমেডি দাবিকারী নাটকগুলো হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়। এসব নাট্যকারের অধিকাংশ রচনায় না আছে কোনো মেসেজ, না আছে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ। আবার অন্যদিকে উদীয়মান নতুন প্রজন্মের প্রমিত বাংলাচর্চায় এ নাটকগুলো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। প্রেমের নাটকে কোনো দোষ নেই। কিন্তু জীবনে তো প্রেম ছাড়া আরও অনেক কিছু আছে।
সমাজ থেকে কি অন্যায়, অত্যাচার, দুঃখ-বেদনা, শোষণ, নির্যাতন, অপহরণ, গুম, খুন, উঠে গেছে? সমসাময়িক নাটকে তার প্রতিফলন নেই কেন? আজকের লেখকদের মনে রাখতে হবে যে, সাহিত্যে স্তুতিবাদের চর্চা করে হয়তো সাময়িকভাবে নিজের ড্রইংরুমকে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং পদকশোভিত করা যাবে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নিজের নামকে স্থায়ী করা যাবে না।
সংগীতের বেলায় একই রকম অবনমন লক্ষণীয়। তরুণ উদীয়মানদের মধ্যে দু-একটি রিয়েলিটি শো করে দ্রুত নামিদামি শিল্পী হওয়ার একটা তাড়াহুড়ো লক্ষ করা যায়। সাধনার বিষয়টি গৌণ হয়ে নাম এবং অর্থ কামানোর ব্যাপারটি অনেক তরুণ শিল্পীর কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ যে সমাজ সংস্কারমূলক গান করছেন না এমন নয়। এ প্রসঙ্গে হায়দার হুসেইন এবং শায়ানের কথা বলা যায়।
হায়দার তো বিডিআর বিদ্রোহের ওপর চমৎকার একটি গান লিখে ও গেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় কাজ করার দাবি করতে পারবেন। এমন আর কজন বলতে পারবেন যে, আমি গুমের ওপর, খুনের ওপর, ক্রসফায়ারের ওপর, গণতন্ত্রহীনতা, নৈশ ভোটের ওপর গান লিখে ও গেয়ে আমার সংগীতকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছি? অনেকেই তা বলতে পারবেন না। কাজেই সমাজ-সচেতন শিল্পী হিসাবে ইতিহাসের পাতায় এরা জায়গা পাবেন না।
বিদ্যমান বাস্তবতায় লেখকদের কার্যকলাপ এবং সাহিত্যিকদের কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে মনে হয়, এরা স্রোতের অনুকূলে নাও বাইতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। রোম নগরী পুড়ে গেলে এদের কিছুই আসে যায় না। এরা নিরোর মতো বাঁশি বাজাতে সুখ খুঁজে পান। সংবিধান অসুস্থ হলে, সমাজ ও রাজনীতিতে গণতন্ত্রহীনতা ছড়িয়ে পড়লে, রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত হলে এরা গায়ে মাখেন না। এসবের প্রতিবাদে এরা কলম ধরতে চান না। পরিবর্তে এরা নিরাপদ এলাকায় কাজ করতে ভালোবাসেন।
কবি লেখেন প্রেমের কবিতা। চিত্রনাট্যনির্মাতা রচনা করেন ফুচকা খাওয়া প্রেমের নাটক, বা কমেডির নামে ভাঁড়ামি। গবেষকরা করেন সহানুভূতিশীল গবেষণা। আবার কেউ কেউ সায়েন্স ফিকশন লিখে টিনএজদের কাছে জনপ্রিয় হতে চেষ্টা চালিয়ে যান। অধিকাংশ লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক নির্বাচন, সংবিধান, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সমাজের গায়ে আগুন লাগলেও সেই আগুন নেভাতে চেষ্টা না করে মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস লিখে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকেন। রুচিতে বাধে বলে সাহিত্য-সংস্কৃতির আরেক শাখা সিনেমা ও ওয়েব সিরিজের গুণমান বিষয়ে কিছু বলব না।
বই প্রকাশের সংখ্যা দিয়েও প্রমাণ করা যায়, দেশে লেখকের অভাব নেই। একুশের বইমেলা হলেই শোনা যায়, এবারের মেলায় ৫ হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। এবারের মেলায় এত হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে এত শত বেশি। আহা কী সাফল্য! এসব প্রকাশিত বইয়ের মান বিচার করতে গেলে লেখকদের গুণমান প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বাংলা একাডেমির হিসাবে ২০২০ সালে একুশের মেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ১০ শতাংশের কিছু বেশি বই ছিল মানসম্পন্ন। আর বাকি ৯০ শতাংশ বই যারা লিখেছেন, তারাও সমাজে লেখক হিসাবে পরিচিত।
তবে যে যাই লিখুন না কেন, বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ লেখকই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালন করছেন না। বেশির ভাগ লেখককে লেখালেখির বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে মনে হয়, বর্তমান বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের সক্রিয় লেখকের অধিকাংশই ব্রেন স্ট্রোকের চিকিৎসা উপেক্ষা করে পায়ের আঙুলের চুলকানির চিকিৎসাকে অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছেন। এ কারণে সাহিত্যের প্রতিবাদী ধারা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। এজন্য সুবিধাবাদী লেখকরাই দায়ী। এসব লেখককে জনগণ একসময় সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে নিষ্ক্রিয় থাকার দায়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
