করোনাকালে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
ড. এএইচএম মাহবুবুর রহমান ও ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সামাজিকীকরণ সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবৈজ্ঞানিক একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তিকে তার জন্মের পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে অনেক কিছু শিখতে হয়। এ শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে বাবা-মা, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, খেলার সাথী ও সমবয়সি দল, বন্ধু, প্রতিবেশী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, কর্মস্থান এবং চেনা-অচেনা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজস্ব ভাষা, পারিবারিক নিয়ম-কানুন, আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক শৃঙ্খলা, প্রথা-পদ্ধতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি আয়ত্ত করে সমাজের উপযোগী একজন সদস্য হয়ে ওঠেন। জীবনব্যাপী চলতে থাকা এ শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সামাজিকীকরণ বলে। সামাজিকীকরণ যথাযথ না হলে শিশু বা ব্যক্তির মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে সে অনেক অসামাজিক আচরণ করতে পারে। ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম ঘটলে তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে।
করোনাকালে ব্যক্তি, বিশেষ করে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে সামাজিকীকরণের যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, বিগত প্রায় ৯০ বছরের মধ্যে এমনটি ঘটেনি। করোনাভাইরাস পৃথিবীব্যাপী মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এ রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ওপর এর অভিঘাত নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা, প্রকাশিত সংবাদ ও সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন- সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, লকডাউন বা শাটডাউন ঘোষণা, অফিস-আদালতসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার কারণে অনেকেই ঘরে থাকতে বাধ্য। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে, অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এসব থেকে সৃষ্ট ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপের বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবার ও ছেলেমেয়েদের ওপর। দেশে শিশু-কিশোর ও ছাত্রছাত্রীদের ওপর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার যে চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো হলো-
১. যেসব মাধ্যমে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সাধিত হয়, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম পরিবার। পরিবারেই শিশুর চিন্তা, আবেগ ও কর্মের অভ্যাস গঠিত হয়। একটি শিশুর সুকোমল বৃত্তি ও সুপ্ত প্রতিভা পরিবারের মাধ্যমেই বিকাশ লাভ করে। শিশু পরিবার থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও গ্রহণ করে।
পরিবার থেকেই একটি শিশু আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে গড়ে ওঠে। সুতরাং, একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে পরিবারের তিনটি বিষয়ের ওপর- মা-বাবার সম্পর্ক, মা-বাবা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক, একই পরিবারের একাধিক শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। উল্লিখিত সম্পর্কগুলো যদি ইতিবাচক হয়, তবে শিশু সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজে সহজ জীবনযাপন করতে পারে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা শিশুর পূর্ণ বিকাশও হয়ে থাকে।
পরিবার, বিশেষ করে বাবা-মা যেহেতু শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম স্থান; সেই পরিবারেই যদি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা, ঝগড়া, দ্বন্দ্ব কাজ করে, তাহলে তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়তে বাধ্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিবারে এখন উপরোক্ত সমস্যগুলো বিরাজমান। সুতরাং, শিশুর স্বাভাবিক যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, করোনাকালে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এ ছাড়া এ সময়ে যেসব নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, তারাও যথোপযুক্ত সামাজিকীকরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একমাত্র বাবা-মা ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় ঘটছে না এতে তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের আবেগ-অনুভূতি ও স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই এদিক থেকে বলা যায়, নবজাতক শিশুর ক্ষেত্রেও সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে।
২. শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সামাজিকীকরণে তাদের সঙ্গী বা খেলার সাথীরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান হয়; শারীরিক দক্ষতা গড়ে ওঠে, যা তাদের বলিষ্ঠ মনোবল গঠনে সহায়তা করে এবং নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি পরিস্ফুট হয়। সে স্বাবলম্বী হতে শেখে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে শিশু বা ছেলেমেয়েরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা আগের মতো একত্রে খেলাধুলা করা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে যোগ দিতে পারছে না। এর ফলে তাদের যথাযথ সামাজিকীকরণে ব্যাঘাত ঘটছে।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো শিশুর সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় ও মিথস্ক্রিয়া হয় এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে, যা তার সামাজিকীকরণে সহায়ক হয়। সমাজের সদস্য হিসাবে যাতে সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক আদর্শ, সামাজিক অভ্যাসগুলো আয়ত্ত্ব করতে পারে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ শিক্ষাই শিক্ষা দেয়। কিন্তু প্রায় দেড় বছরকাল ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
৪. ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবন নানাভাবে প্রভাবিত করে। শৈশবকাল থেকে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী, সে ব্যক্তি সেই ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে লালিত হয় এবং সেই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ তথা সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়। এক কথায়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু করোনাকালে অধিকাংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এবং কোনো কোনো সময় করোনার দ্রুত বিস্তার রোধে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করায় এর প্রভাব ছেলেমেয়েদের ওপর পড়েছে, যা তাদের যথাযথ সামাজিকীকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
৫. সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা লক্ষ করা যায়। গণমাধ্যম হলো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তবে এগুলো সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গৌণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনে করোনা সংক্রান্ত খবর দেখে ও শুনে ছেলেমেয়েদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ছে, যা তাদের প্রতিনিয়ত ভয়-ভীতির মধ্যে রাখে এবং তাদের স্বাভাবিক সামাজিকীকরণে বাধা দিচ্ছে। তবে আশার কথা হলো- এই করোনাকালে গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র, কার্টুন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে ছেলেমেয়েদের মনোবল দৃঢ় ও সতেজ রাখতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
করোনাকালে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত মাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর খেলাধুলার কারণে তাদের স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে। মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে বিভিন্ন ধরনের গেম খেলে তাদের মধ্যে গেমিং ডিসঅর্ডারও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম অপেক্ষা শহরাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর ক্রিয়াকলাপ বেশি। তাছাড়া পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় তারা ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর খেলাধুলা বেশি করছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অনেক শিশুর মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তারা আক্রমণাত্মক ও ক্ষিপ্ত স্বভাবের হয়ে পড়ছে। এসবই সামাজিকীকরণের চ্যালেঞ্জ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়।
করোনা মহামারি শিশু, কিশোর-কিশোরী ও ছাত্রছাত্রীদের সামাজিকীকরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কতটুকু প্রভাব ফেলছে, তার গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত এখন পর্যন্ত আমাদের জানা নেই। তবে করোনাকালে একটা প্রজন্মের স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস, যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি কারণে করোনা-উত্তর এ প্রজন্মের মানসিক ও সামাজিক ভারসাম্যহীন আচরণ যে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে, সে বিষয়ে হয়তো কারও কোনো দ্বিমত নেই। বস্তুত করোনাকালে একটা প্রজন্মের ক্ষেত্রে যথাযথ সামাজিকীকরণের যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে; সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের এখনই মনোযোগ দিতে হবে বলে আমরা মনে করি।
বৈরী এ সময়ে বাবা-মাকে সন্তানদের বেশি করে সময় দেওয়া, ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভরতা কমাতে বাড়ি বা ঘরের মধ্যেই যতটুকু সম্ভব তাদের অন্যান্য খেলাধুলায় নিয়োজিত করা, মজার কোনো গল্পের বই পড়া, ছড়া আবৃত্তি করা, ছবি আঁকা শেখানো, শিশুদের সঙ্গে একত্রে বসে শিশুদের উপযোগী কোনো চলচ্চিত্র দেখা, সংবাদপত্র পড়ানো, দেশ-বিদেশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভাববিনিময় করানো (ভার্চুয়ালি), ছাদ বাগানে নিয়ে যাওয়া, আকাশ ও এর আশপাশের দৃশ্য উপভোগ করা, লুডু-ক্যারম খেলা বা পাজল মেলানো, সম্ভব হলে একই বিল্ডিংয়ে বসবাসরত শিশুদের নিয়ে মজার কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুদের মনোবল চাঙ্গা রাখা যেতে পারে। এর ফলে তাদের ভয়-ভীতি দূর হবে ও কিছুটা হলেও সামাজিকীকরণ হবে এবং এ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করা সহজ হবে বলে মনে করি।
ড. এএইচএম মাহবুবুর রহমান : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, সমাজকর্ম বিভাগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
ড. মতিউর রহমান : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা
