আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই মূল কথা
অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বরিশালে ইউএনওর বাসভবনে হামলার খবরে সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। ইউএনওর দাবি, পোস্টার সরানোর অজুহাতে রাতে তার সরকারি বাসভবনে হামলা হয়। মেয়রসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেশনের রুটিন কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছে, গুলি চলেছে। এমনকি মেয়র গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরও ভেসে বেরিয়েছে। প্রশাসনিক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করতে হবে। মেয়রের পক্ষে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়েছে। পালটাপালটি মামলাও হয়েছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি অস্বস্তিকর। সরকারের জন্য বিব্রতকরও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশকিছু স্পর্শকাতর ঘটনা দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে ঘটেছে; যা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। প্রশ্ন ওঠে, এটা কি নিছকই কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা, নাকি সমাজের গভীরে ঘটে চলা কোনো অস্থিরতার উপসর্গ?
রাজনীতি যারা করেন বা বিশেষ করে যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তারা জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। গণতান্ত্রিক সমাজ তাকে মান্যতা দেয়। কোনোভাবেই তাকে অগ্রাহ্য করা চলে না। দেশের সুষম বিকাশ, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের জন্য তা জরুরি। আমলাতন্ত্র একটি স্বাধীন দেশে কীভাবে কাজ করবে, তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। রাজনীতিমনস্ক এ নাগরিক সমাজে এমন আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এ দেশের ঐতিহ্য, সমাজের চাহিদা বা জনমানসের গড়ন-যাই বলি না কেন-পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো এ সমাজ নয়। এখানে শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য এমনভাবে আচরণকে আচ্ছন্ন করে না; যা আধুনিক সভ্যতার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ক্ষুণ্ন করে। সভ্যতার উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিই বাঙালির রুচি ও পছন্দের পথরেখা তৈরি করে দেয়।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সে কথাই প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি স্বাধীন থাকতে চেয়েছে। গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। যুক্তি, বুদ্ধি ও সহজাত ন্যায়বোধ অন্যায়কে শাসন করেছে, ভয়কে জয় করেছে। মাতৃভূমির জন্য মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের নজির মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা বাঙালির মজ্জায় বয়ে এসেছে হাজার বছর ধরে; যা বাস্তবায়নের সুযোগ এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ’৭১-এ মুক্ত ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা করে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশের রাজনীতি ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোও চ্যালেঞ্জের মুখে ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি যেখানে এ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষের অনির্বাণ শক্তির উৎস নিহিত-তাকে ক্ষুণ্ন করার চক্রান্ত হয়েছে। লোভ ও সুবিধাবাদের অনুকূলে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে ধীরে ধীরে। শুদ্ধ রাজনীতিকে পরিকল্পিতভাবে কলুষিত করা হয়েছে। ফলে অনেক বিষয়েই আমাদের ধোঁয়াশা সহজে কাটছে না। নিজের অজান্তেই হয়তো আমরা নিজের গণ্ডিকে অতিক্রম করে চলেছি। অনুচিত কর্তৃত্ব বিলাসিতা বা অশোভন দম্ভে সওয়ার হয়ে। কার কী করণীয় তা হয়তো ভুলতেই বসেছি।
রাজনীতিতে যারা থাকবেন, তারা এখানে থাকতে পারছেন না। আর সেটা না ঘটলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক তার কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজনীতিকে নানাভাবে অজনপ্রিয় ও কালিমালিপ্ত করে ফেলা হচ্ছে। সুযোগ এসেছিল ’৯০-এ। সে সুযোগ হাতছাড়াই হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন করতে চায়নি। প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। সীমাহীন সহিংসতা হয়েছে। আগেই বলেছি এ দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা সিরিয়া নয়, সে কারণে ওই চক্রান্ত সফল হয়নি। বলা হয়েছে-ক্ষমতাসীন দল প্রহসনের নির্বাচন করছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে-সে সময় ক্ষমতাসীন নেত্রী বারবার বিরোধী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত ঐতিহাসিক ভুল করেছে। সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। ফলে কী হয়েছে? শুধু কি বিএনপির ক্ষতি হয়েছে? উত্তর-না। আসলে রাজনীতির বড় ক্ষতি হয়েছে। বিরোধী দল দৃশ্যত শক্তি হারিয়েছে। আওয়ামী লীগেও সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য বেড়েছে। দলের চরিত্র ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছে। ’১৮ সালেও বিএনপি একই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে। নির্বাচনে জেতার মরণপণ লড়াইয়ে বিএনপি মাঠে নামেনি। আবার নির্বাচনের দিনও তারা বলেনি-আগের রাতে ভোট হয়েছে। এখন বলছে। অন্যরাও বলছে সেদিন ভোট হয়নি। এসবের মধ্য দিয়ে বিরোধী শক্তি নিজেকে শুধু অপ্রাসঙ্গিক করে তোলেনি, সরকারি দলকে অনেকটা গণতন্ত্রবিমুখ ও আমলানির্ভর করে তুলেছে। ক্ষতি হয়েছে জনগণের। তারা ক্ষমতা হারিয়েছে। কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী বিশেষ করে সুবিধাবাদী ও কর্তৃত্বপরায়ণ আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতির মাঠ দখল করেছে। অরাজনৈতিক, অপ্রশিক্ষিত, স্বার্থপর গোষ্ঠী রাজনীতিতে নিয়ামক হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বিগত এক দশকে দেশকে অনেকটাই এগিয়ে নিতে পেরেছেন। তার সাহস ও সততা এখানে কাজ করেছে। আমজনতার জীবনমান উন্নয়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অবকাঠামো, দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা কিংবা আঞ্চলিক সম্পর্ক-সর্বত্রই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। দুর্নীতি দূর করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত বৈপ্লবিক একটি উদ্যোগ। বেশকিছু সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ, টেন্ডার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, নিবন্ধন, পরীক্ষার ফলাফল-অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নজর কেড়েছে, যা সত্যি আশাব্যঞ্জক। কিন্তু একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার ছাঁচ যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, অংশীজন যদি লোভে আক্রান্ত হয়, অপরাধের যদি দায়মুক্তির সুযোগ থাকে, তখন সে ওই দুর্বলতা থেকেই সুবিধা নেবে, যা এ সময় কখনো আমলা, কখনো ব্যবসায়ী, কখনো ভুঁইফোঁড় রাজনীতিক আদায় করে নিচ্ছে।
রাতে সরকারি কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা-যে কোনো মানদণ্ডে তা অপরাধ। অন্য কোনো নাগরিকের বাড়িতেও যদি এমন হামলা হয়, তা-ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রশাসন যন্ত্রের অ্যাসোসিয়েশন বিচার চাচ্ছে। বলছে নির্বাচিত মেয়র দুর্বৃত্ত। গোটা অঞ্চলই নাকি মেয়রের দুর্বৃত্তায়নে সন্ত্রস্ত। তাহলে তারা এতদিন কি তাদের দায়িত্ব পালন করেননি? কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন জনস্বার্থে? এখন গ্রেফতার দাবি করছেন। কে গ্রেফতার করবে? কাকে? একটি নাগরিক রাষ্ট্রের জনপ্রশাসনে কর্মরত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যখন জোটবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দল বা শ্রমিক জোটের মতো আচরণ করে, তখন সমাজের কাছে কোন বার্তা পৌঁছে যায়? সেটা কি শৃঙ্খলার সঙ্গে মানানসই? অনেকে বলছেন ভাষাটা শালীন নয়। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, শুধু ভাষা কেন? সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে এ সুযোগ থাকতে পারে কিনা এ প্রশ্নটিও জনমনে ঘুরে ফিরছে। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়, প্রতিকার চাওয়া যায়। স্বাধীন দেশের যে কোনো নাগরিক এ অধিকার ভোগ করে। কিন্তু সাধারণ জ্ঞান বলে-নিজের অভিযোগ নিজে নিষ্পত্তি করা যায় না। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার না করলে সংবিধানকে অস্বীকার করা হয় কিনা সেটাও ভাবতে হবে।
এখন আসি মেয়র সাহেবের প্রসঙ্গে। তিনি জনপ্রতিনিধি। তার ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তার দল। শুধু তাই নয়, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে তার পরিবার যুক্ত। তার দায়িত্বশীলতা কি একদম সাদামাটা হবে? দেশের সম্মান, দলের ভাবমূর্তি, জনগণের দুর্ভোগ-সবকিছুই তো তাকে বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলছেন-চক্রান্ত। যদি তাই হয়, কেন তিনি সেই পাতা ফাঁদে পা দিলেন। দেশ এখন কত সমস্যায় আক্রান্ত। একটা ভয়ংকর মহামারি মোকাবিলা করতে দেশ আজ হিমশিম খাচ্ছে। এরপর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ, পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক রাজনীতি- নানা সংকট। এমন অবস্থায় বিলবোর্ড বা পোস্টার সরানোর মতো বিষয়ে কর্তৃত্বের লড়াই কি তার জন্য শোভা পায়? রাজনীতির এ কর্তৃত্ব ও প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় কেন তারা বারবার আক্রান্ত হন- সেটাও এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
তবে যে প্রশ্নটি এখন সব দল-মতের জন্য ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা হলো, দেশের রাজনীতির চরিত্র কি বদলে যাচ্ছে? আর তার অভিমুখ কি ভুল গন্তব্যের পথে পা বাড়িয়েছে? এখনই ঠিক করতে হবে কীভাবে একটা টেকসই ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা যায়। প্রথমেই প্রয়োজন-দেশের মাটি, মানুষ ও ঐতিহ্যকে আমলে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার, অতুলনীয় আত্মত্যাগ ও মহান আদর্শকে ধারণ করতে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা। মানসম্পন্ন শিক্ষাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও সামাজিক সাম্য বিধানে একমত হওয়া। বহুমত, পথের বৈচিত্র্যকে সম্মান করা। যে দল মুক্তিযুদ্ধকে মানে না, সে দল রাষ্ট্রকে মানে না, তাকে রাজনীতি করার সুযোগ না দেওয়া। কারণ এসব ফ্যাসিবাদী মানসিকতা মনের গভীরে বাস করা ঔপনিবেশিক উন্নাসিকতাকে পুষ্ট করে। প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। নতুন প্রজন্ম শিক্ষার আলোয় এখন অনেকটা উন্মুক্ত ও উদার। তাদের উদ্বুদ্ধ করা, দেশকে ভালোবাসতে শেখানো এবং রাজনীতির শুদ্ধ ধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। রাজনীতির আঙ্গিনায় শিক্ষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে জনগণ ক্ষমতায়িত হবে। তারুণ্য বিশ্বজনীন দক্ষতায় সমৃদ্ধ হবে। স্বাধীন দেশের মেধাবী সন্তানরা যেন বিদেশমুখী না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুবিধাবাদী অশুভ আঁতাতগুলো তাহলে আপনাআপনি ভেঙে পড়বে। যে কোনো মূল্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন করে গড়ে তোলা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব।
আদর্শহীন, অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর পরিবেশে কায়েমি স্বার্থান্বেষী চক্র শক্তি সঞ্চয় করে। রাজনীতিতে সমঝোতার জন্য প্রয়োজন প্রথমেই নির্মোহ দৃষ্টি; যা আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে। আলোচনার ভিত্তি হওয়া উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। লক্ষ্য হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন চাই, যেখানে কোনো অন্যায় যেন দায়মুক্তি না পায়। সংঘবদ্ধভাবে কোনো গোষ্ঠী যেন সুবিধা না পায়। ব্যক্তি, সমষ্টি বা দল- কোনো আবরণেই যেন অন্যায় করে পার পাওয়া না যায়। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনও জরুরি। তাহলেই জনমনে আস্থা তৈরি হবে। সেজন্য চাই নাগরিক চেতনা, দেশপ্রেম ও জনগণের নিশ্ছিদ্র ঐক্য; যা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাজনীতি শুদ্ধ হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে দেশ অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ
principalffmmc@gmail.com
