Logo
Logo
×

বাতায়ন

তথ্য আমার অধিকার জানা আছে কি সবার?

Icon

মরতুজা আহমদ

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তথ্য আমার অধিকার জানা আছে কি সবার?

যাত্রা শুরুর একযুগ পূর্তিতে এহেন শিরোনাম দেখে পাঠকমাত্রই আত্মসমালোচনা করার ও আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেবেন। কেননা একযুগ যে কত লম্বা সময়, তা কবি সৌগতবর্মণ বা অভিজিৎ দাসের প্রেম ও বিরহের কবিতা পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। আর মূলত যুগপূর্তিকে কেন্দ্র করে এবার এটিই আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছিল।

হ্যাঁ, এবারই আমাদের তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তথ্য কমিশনের যুগপূর্তি হয়েছে। নিঃসন্দেহে একযুগেও দেশের জনগণ তথ্যে তার অধিকার বা মালিকানা সম্পর্কে জানতে পারেনি। যারা জানে তাদের অনেকেই স্পষ্ট বোঝে না; বুঝলেও তাদের জীবনমান উন্নয়নে তা প্রয়োগ করে না বা করতে পারে না। এখনো সাধারণের ধারণা, তথ্যের মালিক রাষ্ট্র বা সরকার তথা আইনের ভাষায় কর্তৃপক্ষ। এটি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বিষয়, সর্বসাধারণ জানবে ততটুকুই, কর্তৃপক্ষ দয়া পরবশে যতটুকু যেভাবে জানাবে। আবার অনেকের ধারণা, এগুলো উন্নত বিশ্ব বা পশ্চিমাদের বিষয়। অন্যদিকে তথ্য যারা দেবেন বা যাদের কাছে জনগণের তথ্য আছে, তাদের অনেকের একযুগেও তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি বা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, গোপনীয়তার বেড়াজালে আটকে আছেন।

২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য জানার অধিকার হিসাবে দিবসটি পালিত হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ইউনেস্কো এবং ২০১৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটিকে ‘International Day for Universal Access to Information’, অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক সার্বজনীন তথ্যে অভিগম্যতা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে দেশে দেশে পালিত হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হলো সব মানুষের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ পাশের মাধ্যমেই সব নাগরিক তথ্য চাওয়া-পাওয়ার, প্রয়োজনীয় সব তথ্যে সাবলীল প্রবেশের এবং এর প্রয়োগে উপকারভোগী হওয়ার আবশ্যিক ও আইনি স্বীকৃতিলাভ করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ রচিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ সুগম হয়েছে। তাই যুগপূর্তিতে এর বাস্তবায়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জনস্বার্থেই প্রয়োজন।

বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ একটি আধুনিক, অনন্য ও প্রাগ্রসর আইন। এ আইনের মাধ্যমে বিরাজমান বিভিন্ন নীতি-আদর্শ ও চেতনায় Paradigm Shift হয়েছে। এ আইনে জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে; কর্তৃপক্ষের কাজের, সেবার ও বাজেটের হিসাব চায়; অন্যান্য আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এ আইনের মূল দর্শন হলো ‘Disclosure is rule, secrecy is exception’. অন্যদিকে দীর্ঘ প্রচলিত ‘Official Secrets Act’-এর দর্শন ‘Secrecy is rule, disclosure is exception’। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা শতাব্দী প্রাচীন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ মতে, উভয় বিচারের ক্ষেত্রে যিনি আদালতে বিচারপ্রার্থী, Burden of proof তারই। ফৌজদারি ব্যবস্থায় যতক্ষণ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হবে, ততক্ষণ আসামি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন। তথ্য অধিকার আইনমতে তথ্য কমিশন একটি Quasi-Judicial Court. কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিক তথ্য কমিশনে অভিযোগ করলে কমিশন কর্তৃপক্ষ বা তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করবেন, এ আদালতে Burden of proof কর্তৃপক্ষ বা ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার, আবেদনকারী বা অভিযোগকারীর নয়। অন্য কথায়, বিচারপ্রার্থীর নয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেই বা কর্তৃপক্ষকে, না পারলে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের আদেশ বা বিভাগীয় মামলার সুপারিশ তার বিরুদ্ধে হতে পারে। এই যে জনগণ তথা নাগরিককে আইনি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের ওপর, সে ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সাধারণ মানুষ কি সেভাবে প্রস্তুত হয়েছে? তাছাড়া তৃণমূল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথ্য স্বাক্ষরতার অভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে শত বছরের গোপনীয়তার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত কর্তৃপক্ষ কি রাতারাতি সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চাহিবামাত্র তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সব তথ্য দিয়ে দেওয়ার বা অবারিত করে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি তৈরি আছে? তদুপরি যার দুর্নীতির অভ্যাস মজ্জাগত, তিনি তথ্য গোপনের বা বিকৃতির প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকেন, ধরা পড়ার ভয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। এমনকি সৎ বলে কথিত এমন অনেক কর্মকর্তার মধ্যেও দেখা যায় চিরাচরিত ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবল বাসনা, তথ্য গোপনের উদগ্র চেষ্টা।

এসব কারণে অনেক বোদ্ধা আমাদের আইনটিকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর বলে মনে করেন। আইনের মূল চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বা একে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য সাধারণ মানুষ বা কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের প্রয়োজন আছে বৈকি।

তবে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত আইনটির বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। অর্জনও নেহায়েত কম নয়। তথ্যপ্রাপ্তি, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশ, প্রচার, অভিযোগ দায়ের, নিষ্পত্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিধি, প্রবিধি, নির্দেশিকা, সহায়িকা ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে। সারা দেশে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষে ৪২ হাজার ৪৫০ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব কার্যালয়ে বিকল্প দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আপিল কর্মকর্তা নিয়োজিত হয়েছেন। তথ্য কমিশন থেকে কেন্দ্র ও সব জেলা ছাড়াও শুধু উপজেলা পর্যায়েই জনউদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান ৫০৪টি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ৫০৬টি এবং যথেষ্ট সংখ্যায় মতবিনিময় সভা-সেমিনার সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় সব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার আওতায় তথ্যে অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণে তৃণমূল পর্যন্ত ইন্টারনেটের সমন্বিত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের আওতায় সারা দেশে স্থাপিত প্রায় ৫০০০ ইউনিয়ন/পৌর ডিজিটাল সেন্টার তৃণমূলে তথ্য সেবা দিচ্ছে। তথ্যপ্রাপ্তি, সহজ ও নিশ্চিতকরণে ওয়েবসাইট স্থাপন ও সিটিজেন চার্টার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন পরিষদসহ দেশের প্রায় সব সরকারি কার্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে এবং প্রতিটি ওয়েবসাইট খুললেই দেখা যায়, তথ্যে মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের পথনির্দেশনাবিষয়ক একটি কর্নার রয়েছে। স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের সব মাধ্যমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ঘরে বসেই তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে এবং উন্নয়নের মহাসড়কে প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে। এর ফলে সম্প্রতি জাতিসংঘে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

করোনা সংকটের শুরুতেই তথ্য কমিশন ভার্চুয়াল শুনানি কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। কোনো পক্ষেরই ঢাকায় তথ্য কমিশনে সশরীরে হাজির হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে অর্থ বা সময় যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি বিড়ম্বনা এড়ানো যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে তথ্য কমিশনে ১৭১টি অভিযোগের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে, তন্মধ্যে ১৬৪টি অভিযোগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা হবে এবং সব স্তরেই চালু করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করেছেন এবং তার নবগঠিত সরকার ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাশ ও কার্যকর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা মহান সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে করোনা সংকট ছাড়াও সময়ে সময়ে ভিডিও কনফারেন্স বা প্রেস কনফারেন্স করে এবং মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচিত ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বিষয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জাতির সামনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সচিব সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বিষয়টি পুনঃব্যক্ত করে বিভিন্ন অনুশাসন দিয়েছেন। উল্লেখ্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য অধিকার আইন একটি বিশেষ হাতিয়ার। সম্প্রতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী কয়েকটি অনুষ্ঠানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকল্পে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ এবং তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সম্মানিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে তথ্যে সর্বজনীন অভিগম্যতা দ্রুত নিশ্চিত হবে। বিশেষত সাধারণ নাগরিকের তথ্যে মালিকানাবোধ তৈরি হবে। তথ্য প্রদানে অনাগ্রহী বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীরা আরও সচেতন, দক্ষ ও জনগণের প্রতি ইতিবাচক ও সংবেদনশীল হবেন। সব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হবে, আস্থার সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান আরও সুসংহত হবে।

মরতুজা আহমদ : প্রধান তথ্য কমিশনার, তথ্য কমিশন

 

তথ্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম