Logo
Logo
×

বাতায়ন

দ্রব্যমূল্য বাড়ে কেন

Icon

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিভিন্ন পণ্যের শতকরা হারে কত ভাগ দাম বেড়েছে, তা হয়তো সার্বক্ষণিকভাবে হিসাব করে রাখার মতো কোনো সংস্থা নেই দেশে। তারপরও স্পষ্ট করে বলা যায়-দাম বেড়েছে তেল, চাল, ডাল, পেট্রোল ও ডিজেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে। বাড়ছে খাবারের দাম। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়ছে সাধারণ নিুবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক এবং দিন-আনি-দিন-খাই রোজগারের মানুষজন। তারা ভাঙিয়ে ফেলছেন সঞ্চয়। মূলত দাম বাড়ার পেছনে অর্থনৈতিক দুটি কারণ থাকার কথা। পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়লে এবং/অথবা চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকলে তার দাম বাড়ে। প্রথমটা সরাসরিভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ এবং দ্বিতীয়টাও রাজনীতির বাইরে নয়। প্রকৃতপক্ষে পণ্যের দাম বাড়ে না, বাড়ানো হয়। অর্থনৈতিক কারণের চেয়েও এখানে বড় কারণ হচ্ছে রাজনীতি। দাম বাড়ার এ ডামাডোলে খুব জোরেশোরে বলা হয়ে থাকে, গোটা বিশ্বে দাম বাড়ছে তেল এবং সব ভোগ্যপণ্যের। কিন্তু এ কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলো চাহিদা বজায় রাখতে বর্ধিত দামের ওপর ভর্তুকি দিচ্ছে। তাতে সেখানে একদিকে উৎপাদনের পুঁজি বাঁচছে, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে রপ্তানির দাম ঠিক থাকছে। সর্বোপরি তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম কম রাখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালনায় এমন নীতি কখনো গ্রহণ করা হয়নি।

আজকের পৃথিবী তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য বিশ্লেষণের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তথ্যের মূল্য জীবনের উন্নতি ঘটাতে পারে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’র প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল-‘ডেটা ফর বেটার লাইভস’। সমাজের উন্নয়নের তথ্যভাণ্ডারের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সমাজের অনেক মিথ্যা ধারণা ভাঙতে পারে তথ্যভাণ্ডার। তবে তথ্যের আবার বিপরীত দিকও আছে। তাই সব ক্ষেত্রে চলতে দেখা যায় পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসের অস্তিত্ব; প্রয়োজন অনুসারে কোনো কথা ভুলে যাওয়া এবং প্রয়োজন পড়লে পুনরায় তাকে স্মরণে নিয়ে আসা। অর্থাৎ ক্ষমতাশালীদের পক্ষে অনুকূল একটি সর্বগ্রাসী ‘বাস্তব’ নির্মাণ করে দেওয়া। অনেক সময় সেই স্বার্থে শুধু সত্যটাকে উহ্য রাখলেই কাজ হয়ে যায়। যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেওয়ার পাবলিক মন ভোলানোর বক্তব্য হয়-‘ব্যবসা করা দেশের নির্বাচিত সরকারের কাজ নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো বেঁচে দেওয়া জনগণের স্বার্থেই প্রয়োজন।’ সরকার এমনটা বলে পাবলিকের মন ভোলানোর কাজটি ঠিক করে বসে। শুধু বলে না যে, মুনাফা করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলো তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছিল জনসেবা করার জন্য। টেলিফোন সংস্থা হোক, পাটকল হোক কিংবা হোক অন্য যে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা-এসব সংস্থার উদ্দেশ্য মুনাফার প্রতিযোগিতা করা নয়, বরং মানুষের দোরগোড়ায় পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। এ কথাগুলোকে সুবিধামতো ভুলে গেলে, ভুলিয়ে দিতে পারলে বেসরকারি খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেঁচে দিতে আর কোনো নৈতিক আপত্তি থাকে না। সুতরাং তথ্যভাণ্ডার প্রয়োজন আমাদের উন্নয়নের স্বার্থে। তবে সেই তথ্যভাণ্ডার হতে হবে পরস্পরবিরোধিতা মুক্ত।

সত্য বরাবরই কঠিন। আর সেই কঠিনকে ভালোবাসা আরও কঠিন। মিথ্যা বারবার উচ্চারিত হলে সত্য পালিয়ে যায়-এ কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু মানুষ তাতে বিভ্রান্ত হতে পারে। এ নিয়ে একটি গল্প শোনাই। এক পুরোহিত ধনী যজমানের বাড়িতে পূজা করে দক্ষিণাস্বরূপ একটি পাঁঠা লাভ করেন। হৃষ্টচিত্তে পুরোহিত পাঁঠাটিকে মাথায় চেপে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। মাঝে একটি জঙ্গল। সেখানে তিনজন ঠগ লোক লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল পুরোহিতের কাছ থেকে পাঁঠাটা বাগাবার ফন্দি এঁটে। ঠগদের প্রথমজন এগিয়ে এসে বলল, এ কি! আপনার মতো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ একটি অশুচি কুকুর মাথায় চাপিয়ে যাচ্ছেন! শুনে পুরোহিত রেগে বললেন, চোখের মাথা খেয়েছ? দেখছ পাঁঠা, বলছ কুকুর! পুরোহিত কিছুদূর যেতেই দ্বিতীয় ঠগের আবির্ভাব। সে-ও একই কথা বলল। এবার পুরোহিতের একটু সন্দেহ হলো। তবে কি যজমান তাকে ঠকাল? আরও খানিকটা পর তৃতীয় ঠগ যখন একই কথা পুনরাবৃত্তি করল, তখন পুরোহিতের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলো। ঘৃণায় পাঁঠাটিকে মাথা থেকে নামিয়ে মনে কষ্ট নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন পুরোহিত মহাশয়। ঠগ লোকরা অতঃপর ভূরিভোজের আয়োজনটি সম্পন্ন করল।

গল্পের মতো বারবার একই মিথ্যা বা অর্ধসত্য শুনতে শুনতে চরম আত্মবিশ্বাসীরাও মিথ্যাকেই সত্য বলে মনে করে। রাজনীতির কারবারিরা এ কৌশলটা নানাভাবে ব্যবহার করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের সেনাপতি দ্রোণকে যুধিষ্ঠির উচ্চকণ্ঠে ‘অশ্বত্থামা হত’ শুনিয়ে চাপা গলায় ‘ইতি গজ’ বললে স্নেহশীল পিতা দ্রোণের বাক্যের প্রথম অংশটুকু শুনে অস্ত্র ত্যাগ ও ফলত মৃত্যুবরণ করেন। বারবার প্রচারে মিথ্যা কিংবা অর্ধসত্যকে পূর্ণ সত্যতে রূপান্তরিত করার ব্যাপারটিকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন হিটলার এবং তার প্রচারমন্ত্রী গোয়েবেল্স। ‘হিটলার এবং জার্মানি অজেয়’ বলে তারা এমন প্রচার করেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে বার্লিনের পতন ও হিটলারের মৃত্যুর খবরও বহু জার্মান বিশ্বাস করতে পারেননি।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকা। শতকরা হিসাবে বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহণ মালিকদের ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। তেলের দাম যতটুকু বেড়েছে, বাসের ভাড়া তার চেয়েও বেশি বেড়েছে। তেলের এ বৃদ্ধির অজুহাত তুলে বেড়ে গেছে সবকিছুর দাম। তেলের দাম বাড়ল অর্থাৎ তেলে যে সরকারের ভর্তুকি ছিল তার পরিমাণ কমল। সরকার লাভবান হলো, পরিবহণ মালিকরা লাভবান অথবা স্থিতাবস্থায় থাকল। শুধু জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হলো। দাম বাড়ার তথ্যটি একেবারেই জনগণের মাথার ওপর গিয়ে আঘাত করল। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্থানীয় বাজারে তেলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারতে জ্বালানি তেলের দাম আমাদের চেয়ে বেশি। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা না গেলে ভারতে তেল পাচার হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। কারণ দুটি বিপরীতধর্মী হলেও রাজনৈতিক ব্যাখ্যার জন্য যথোপযুক্ত। এর বিপরীত ব্যাখ্যাও বেশ সবল। অন্যদিকে, কিছু তথ্য আছে যা বিশ্ববাজারের অবস্থা বর্ণনা করতে পারে। সম্প্রতি পণ্যের দামবৃদ্ধি রোধে ভারত সরকার তেলের শুল্ক কমিয়েছে, গ্যাসে ভর্তুকি বাড়িয়েছে, সরবরাহ বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। আমেরিকা ও আরও কিছু দেশ চাহিদা বজায় রাখতে বর্ধিত দামের ওপর ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা কখনো নেয়নি।

দামবৃদ্ধির ইতিহাস বেশ লম্বা আমাদের দেশে। দামবৃদ্ধির এ রাজনীতি আড়ালে রাখতে মাঝেমধ্যে লোক দেখাতে বাজারে বাজারে এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালানোর ইতিহাস আছে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির আসল কৌশল আড়ালেই থাকে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয়, বিদেশে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধিই আসল কারণ। অথচ এর আগে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কম ছিল, তখনো এদেশে টানা পেট্রোল-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূলত আসল কারণটি গোপনই থাকে। দেশের জ্বালানি খরচ কমাতে সরকার যত ভর্তুকি কমাবে তত দাম বাড়বে, ততই সরকারের রাজস্ব বাঁচবে এবং বড় বড় বহুজাতিক তেল সংস্থা এদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। দুদিকেই সরকারের লাভ। দাম তাই বেড়ে যায়।

এদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। ১৯৭২ সালের ৬ মে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর প্রতিবছরই ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে এর দাম। রাজনৈতিক কারণে কোনো সময় মূল্য কমানো হলেও তার তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার জন্য কিংবা কমিয়ে নিতে অর্থনীতির বাজারে প্রক্রিয়াগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা কোনো সরকারই করে দেখাতে পারেনি। তাই মূল্যবৃদ্ধি আর রাষ্ট্রের ভর্তুকি হ্রাসের প্রভাব সরাসরিভাবে দরিদ্র জনতার ওপর গিয়ে পড়েছে বারবার।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমাতে রাষ্ট্র কী করতে পারে, তা নিয়ে কোনো সরকারই তেমন করে খোলাখুলিভাবে কখনো কারও সঙ্গে আলোচনা করার তাগিদ অনুভব করেনি। তেমনটা করলে হয়তো ভালো হতো, হয়তো কোনো সুফল এলেও আসতে পারত। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ পরিবহণ সেক্টরের। সেখানে দাম বাড়লেই সরাসরি তা গিয়ে পড়ে জনগণের ওপর। পরিবহণ সেক্টরে একটি ওপেন সিক্রেট সর্বদাই জাগ্রত আছে বাংলাদেশে। পরিবহণ মালিকদের ঘাটে ঘাটে, পথে পথে কালেকশনের শিকার হতে হয়। এটি বন্ধ করতে পারলেই পরিবহণ সেক্টর ১০ থেকে ২০ শতাংশ কম হারে ভাড়া নিলেও তাদের খুশি থাকার কারণ থাকবে।

সরকার জ্বালানি খাতে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে দিতে পারে। আমাদের দেশে আসছে পরিশোধিত তেল এবং তা আনতে হচ্ছে অধিক মূল্যে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কম মূল্যে আনার সুযোগ আছে, যদি আমরা রিফাইনারি কারখানা স্থাপন করতে পারি। এসব নিয়ে আলোচনা হয় না, কাউকে ভাবতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় না। বরং চোখ বুজে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করাই যেন সহজ পথ-এমনটাই ভেবে নেয় কর্তৃপক্ষ।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম