Logo
Logo
×

বাতায়ন

উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কিছু পরামর্শ

Icon

এম আর ইসলাম

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কিছু পরামর্শ

ফাইল

বাংলাদেশের উপাচার্যদেরও যে সংগঠন বা ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ থাকতে হয়, সেটা স্পষ্ট হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি একযোগে ৩৪ জন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সংহতি দেখে; যেখানে তারা একসঙ্গে পদত্যাগ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এমন হুঁশিয়ারি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটা নিয়ে খানিকটা সন্দেহ আছে, কারণ তুমুল আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও উপাচার্যরা তাদের পদ থেকে কোনোভাবেই পদত্যাগ করেন না। পদত্যাগ করে তারা সাধারণত তাদের দীর্ঘদিনের কষ্টের বিনিময়ে প্রাপ্ত কেষ্টকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না।

তাই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন, সহকর্মী শিক্ষকদের অনাস্থা আর প্রতিবাদ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের পদে জগদ্দল পাথর হয়ে টিকে থাকতে চান। সরকারের নির্দেশ ছাড়া কোনোভাবেই তাদের পদ থেকে নামানো সম্ভব হয় না। তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই চূড়ান্তভাবে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তো স্বায়ত্তশাসিত থাকার কথা ছিল-যেখানে সরকার শুধু তাদের অর্থের জোগান দেবে, আর বাকি সব কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে পরিচালনা করবে স্বাধীনভাবে। কিন্তু তেমন চর্চা এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ইস্যুই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কখনো শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ, কখনো ইউজিসির হস্তক্ষেপ, আবার কখনো কখনো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া অচলাবস্থার সমাধান হয় না।

একজন উপাচার্য একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি। তিনি প্রথমত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষক, তারপর তিনি প্রশাসক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি যত না পেশা, তার চেয়ে বেশি ব্রত। তারা মূলত স্বাধীনচেতা হন, তাই কারও গোলামি না করে, অনেক যোগ্যতা আর উঁচু ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলক কম বেতনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ও গবেষণায় নিয়োজিত হন। সম্মান আর সুনাম ছাড়া অন্য কিছু যেমন-বিশাল বাংলো বাড়ি, পতাকাওয়ালা গাড়ি, আমলাতান্ত্রিক ভোগী জীবন সাধারণত তাদের টানে না। তবুও তাদের মধ্য থেকেই কাউকে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেক্ষেত্রে তারা যত না ক্ষমতার আধার, এর চেয়ে অনেক বড় সম্মানে আর দায়িত্বে। প্রটোকল অনুযায়ী উপাচার্যদের উপরে থাকেন শুধু আচার্য বা রাষ্ট্রপতি।

এমন সম্মানজনক পদ একজন অধ্যাপকের জীবনে কাঙ্ক্ষিত হতেই পারে, কিন্তু সেজন্য মরিয়া হওয়া দৃষ্টিকটু ও অসম্মানের। উপাচার্য সরকার নিয়োগ দেবে বটে, কিন্তু সেখানে দেখবেন তাদের যথেষ্ট মেধা, ব্যক্তিত্ব আর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা আছে কি না। এর সঙ্গে দেখা উচিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটা। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়োগ দেওয়ার ফলাফল খুব একটা ভালো হয় না, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে।

সরকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাধারণত বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেতাদের অপেক্ষাকৃত ছোট বা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে তাদের রাজনীতির পুরস্কারস্বরূপ। কেউ কেউ আবার প্রচণ্ড তাঁবেদারি কলাম লিখতে লিখতেও উপাচার্যের পদ লাভ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের বঞ্চিত করে, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশাসক আমদানি করা হয়, যারা শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শিক্ষকদের বিরাগভাজন থাকেন। তবে কিছু শিক্ষককে বিভিন্ন পদ-পদবি দিয়ে বহিরাগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকরা হাত করে তার পলিটিক্স চালু রাখেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি দুটি শিক্ষক দল দেখা যায়। যাদের একটা হয় উপাচার্যপন্থি, আরেকটা থাকে উপাচার্যবিরোধী। এমন গ্রুপিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা দলীয় আদর্শ কাজ করে না। টার্গেট থাকে বহিরাগত উপাচার্যের বিরুদ্ধাচরণ করা, এবং তাকে ক্যাম্পাস থেকে হটানো।

এমন দলীয় কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের গ্রুপ অনেক সময় বিরোধী ছাত্র সংগঠনের অথবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন। কারণ, অকারণে ইস্যু তৈরি করে আন্দোলনে রূপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে এমন আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য সরকারি ক্ষমতায় বলীয়ান বহিরাগত উপাচার্য আর তার সঙ্গীরা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ আর সরকারপন্থি ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেন। এমন সংঘাতে প্রায়ই নিরীহ শিক্ষার্থীদের হতাহত হতে হয়। অন্যদিকে দ্বৈত সংঘাতের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে; অনেক ক্ষেত্রেই চাপ সামলানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বাইরে থেকে উপাচার্য বা শিক্ষক প্রশাসক আমদানি করা বন্ধ করতে হবে। একেবারে আনকোরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যদি বাইরের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতেই হয়, তাহলে তাদের ওইসব ছোট, স্থানীয় আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া দরকার। যেন তারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপন করে নিয়ে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিজের যাবতীয় মেধা আর অভিজ্ঞতা ঢেলে দেন। তাদের কোনোভাবেই আর তার পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। এমন নিয়ম করতে পারলে অনেকেই আর কিছুদিনের জন্য শুধু আরাম করতে, আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক হতে রাজি হবেন না। এমন নিয়ম করতে পারলে অনেক রাজনৈতিক উপাচার্যের ঢাকা থেকে স্যাটেলাইট স্টাইলে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর বিলাসিতা বিলোপ পাবে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে সার্ভিস দেওয়ার নিয়ম নেই, সেখানে কেন অতি রাজনৈতিক শিক্ষকদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসক হিসাবে সাময়িকভাবে পাঠিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে? সরকারের নিশ্চয় যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাই এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করা ঠিক হবে না।

একটা কথা প্রচলিত আছে যে, যারা অযোগ্য, তারা সারাক্ষণ তদবির নিয়ে হাজির হয়। অন্যদিকে যারা যোগ্য আর ব্যক্তিত্ববান, তাদের খুঁজে বের করতে হয়। রাজনৈতিক নিয়োগ কোনো অবাক করা ঘটনা নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রিজেন্ট, প্রেসিডেন্ট বা রেকটর নিয়োগে সরকারের একটা প্রভাব থাকে, যা খুব একটা দোষণীয় নয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রশাসক হিসাবে যোগ্য শিক্ষকদের সরকার পাঠাতে পারে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, যেহেতু তাদের যথেষ্ট সিনিয়র শিক্ষক থাকে না। কিন্তু সেখানে এমন শিক্ষকদের স্থায়ী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত, যেন তারা প্রশাসকের মেয়াদকাল শেষ করে শিক্ষক হিসাবে সেখানেই অবসরগ্রহণ করেন। তাহলে শুধু নিবেদিত শিক্ষকরাই নতুন আর আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় (ঢাকার বাইরে) যাবেন প্রকৃত উন্নয়নের স্বার্থে। নতুবা কিছু সুযোগসন্ধানী শিক্ষক শুধু কিছুদিনের জন্য আমলাতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধার লোভে সেখানে যাবেন এবং মূল উন্নয়নের চেয়ে সারাক্ষণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেবেন। অন্যদিকে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০ বছরের বেশি, সেখানে কোনোক্রমেই বাইরের শিক্ষকদের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য হিসাবে পাঠানো উচিত নয়। বরং ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটকে কার্যকর করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সৎ ও যোগ্য কোনো সিনিয়র শিক্ষককে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত। যেন উপাচার্যদের জলবিদ্যুৎহীন গৃহবন্দি অবস্থা দেখতে আর না হয়!

এম আর ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্য নিয়োগ পরামর্শ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম