Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিল্প-শিক্ষায়তন সংযোগ নিবিড় হচ্ছে না কেন?

Icon

আবু তাহের খান

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিল্প-শিক্ষায়তন সংযোগ নিবিড় হচ্ছে না কেন?

অনেকদিন ধরে এ আলোচনা বেশ জোরেশোরেই হচ্ছে যে, শিল্পকারখানা ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের দক্ষ জনবল প্রয়োজন, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে চাকরিদাতারা অনেকটা নিরুপায় হয়েই বহুসংখ্যক বিদেশিকে এখানে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছেন ও হচ্ছেন।

আর সেই সুবাদে দেশে এখন প্রায় ১০ লাখ বা তারও বেশি বিদেশি নাগরিক কাজ করছে, যারা বছরে প্রায় ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (তথ্য নিয়ে মতপার্থক্য আছে) বৈধ পথে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা হয়তো শিগগিরই দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে এবং সত্যি সত্যি তেমনটি ঘটলে চাকরির বাজারে শিক্ষিত বেকারের প্রবেশের সুযোগ কার্যতই বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

এ অবস্থায় শিল্পকারখানাগুলো কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রত্যাশা করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে ও অবহিত হয়ে সে অনুযায়ী পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানো ও পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সেটি করার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী বলে মনে হয় না, অন্তত তাদের আচরণ থেকে সেটাই প্রতীয়মান হয়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে যে শিক্ষার্থীরা বেরুচ্ছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে কোনোভাবেই কাজে লাগাতে পারছে না। আর হাতে সনদ নিয়েও কাজ জোগাড় করতে না পেরে শিক্ষিত যুবক চাকরিদাতা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উপর্যুপরি দোষারোপ করে যাচ্ছে তাকে যথাযথভাবে ‘মূল্যায়ন’ করা হচ্ছে না বলে। কিন্তু সে একবারও বুঝতে চাইছে না, তার ওই সনদের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাকে যা শিখিয়েছে, তা দিয়ে আর যাই হোক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাজের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।

উপরিউক্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্নাতক পর্যায়ের কোর্সগুলোর শেষ সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের জন্য দায়সারা গোছের যে ‘ইন্টার্নশিপ’ প্রথা চালু রেখেছে, তার মাধ্যমে সনদের সম্পূরকতা অর্জিত হলেও হাতে-কলমের শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা কতটুকু অর্জিত হচ্ছে, সেটা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে।

শিক্ষার্থীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পেশার সঙ্গে এসব ইন্টার্নশিপ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চরিত্র মিলে কিনা কিংবা এ সময়ে শিক্ষার্থী যা শিখছে তা ওই পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা অথবা এ সময়ে সে আদৌ কিছু শিখতে পারছে কিনা-এসব কোনোকিছুর বাছবিচার না করেই বস্তুত এ ইন্টার্নশিপ কোর্সগুলো পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে ইন্টার্ন গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই তাদেরকে গ্রহণ করছে এবং এতে গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান, ইন্টার্ন শিক্ষার্থী বা প্রেরণকারী শিক্ষায়তন কেউই এ থেকে খুব একটা উপকৃত হতে পারছে না।

ফলে এ ধরনের ফলাফলবিহীন কর্মসূচির ব্যাপারে একদিকে যেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে তেমনই শিক্ষার্থীরাও একে আর গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না। আর এ দুয়ের মাঝখানে বসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কী ভাবছে, তাও স্পষ্ট নয়। তবে শিক্ষায়তনগুলো যদি সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় এ ইন্টার্নশিপ কোর্সগুলো পরিচালনা করত, তাহলে এ থেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কার্যকর দক্ষতা অর্জনের সুযোগটি অনেকটাই সহজ হয়ে উঠতে পারত। আর তা থেকে সীমিত পরিসরে হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হতে পারত বলে মনে করি।

এখন কথা হচ্ছে, প্রতিবছর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কিছুসংখ্যক ইন্টার্ন পাঠানোর মধ্য দিয়েই কি শিল্পের সঙ্গে শিক্ষায়তনের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হয়ে গেল বা এ থেকেই কি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যাবে? মোটেও না। বরং এক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপের চেয়েও বড় কাজ হচ্ছে শিক্ষকদের শিল্পের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যুক্ত রাখা, যাতে তারা শিল্পের বাস্তব কার্যপদ্ধতি ও চাহিদাগুলো স্বচক্ষে দেখে ও উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারেন।

পাঠ্যক্রম হালনাগাদকরণের বিষয়টিও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িত। এ হালনাগাদকরণ এবং সেটিকে বাজারচাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সংগতিবাহী করে তোলার লক্ষ্যে একে ঢেলে সাজাতে হলে শিক্ষকদেরই সর্বাগ্রে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। কিন্তু সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলি, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকই পাঠ্যপুস্তকের অধীত তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিধির বাইরে গিয়ে শিল্পের বাস্তব কাজের সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করতে খুব একটা আগ্রহী নন। আর সেজন্যই তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা যা শিখছে, তা দিয়ে পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে কিছুতেই যোগ্য প্রমাণ করতে পারছে না।

অন্যদিকে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যেও এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে, তারা যেহেতু কর্মদাতা ও একই সঙ্গে বিনিয়োগকারী, সেহেতু যাদের কাজ দরকার তাদের বা তাদের সুপারিশকারীদেরই (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক) উচিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগটি গড়ে তোলা। এবং সম্ভবত তারা এটিও ভাবেন যে, কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে খোলাবাজারের এ চলমান বিশ্বব্যবস্থায় তাদের পক্ষে কর্মী খুঁজে পাওয়াটা মোটেও কঠিন কোনো ব্যাপার নয় এবং বিদেশি নিয়োগের মাধ্যমে তারা তা পাচ্ছেনও।

আর তারা সেটি পাচ্ছেন বলেই দেশের শিল্পকারখানাগুলোয় আজ ১০ লক্ষাধিক বিদেশি কারিগর ও ব্যবস্থাপক কাজ করে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার বৈধ পথে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ থেকে যে শুধু অবৈধ পথেই বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে তাই নয়, বৈধ পথে চলে যাওয়া অর্থের পরিমাণও নেহায়েত কম নয়, যার জন্য বহুলাংশে দায়ী শিল্প ও শিক্ষায়তনগুলোর মধ্যকার উল্লিখিত অনিবিড় সম্পর্ক ও দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা।

এদিকে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে মান ও উৎপাদনশীলতার যে স্তরে অবস্থান করছে, তাতে করে তাদের অনেকের পক্ষেই বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যহার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ যখন উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় যুক্ত হবে, তখন থেকে কেউই কিন্তু আর শুল্কহারে ছাড় দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহযোগিতা করবে না। তখন মান ও মূল্য দুটোর ক্ষেত্রেই তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে।

কিন্তু তজ্জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন ও বাজার গবেষণার কাজটি আরও জোরদার হওয়া প্রয়োজন, যে গবেষণার কাজটি শিল্প ও শিক্ষায়তনগুলো একসঙ্গে মিলে করতে পারলে খুবই ভালো হয়। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা এর শিক্ষকদের গবেষণার জন্য সীমিত পরিসরে হলেও যে অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, সেক্ষেত্রে গবেষণা কাজটি এরূপ যৌথভাবে করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে মর্মে শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে।

মোট কথা বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে, উদ্যমহীনতা, চিন্তাভাবনায় সামগ্রিকতার ঘাটতি, দূরদৃষ্টির অভাব, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে অনভ্যস্ততা, নিজ নিজ অবস্থান থেকে লালিত অহংবোধ প্রভৃতি নানা কারণে বাংলাদেশের শিল্প ও শিক্ষায়তনের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মান ও স্তরের যোগাযোগটি কিছুতেই গড়ে উঠছে না।

এ নিয়ে কিছু কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাঝেমধ্যে বক্তৃতা-আলোচনা প্রভৃতির মাধ্যমে বিষয়টিকে সামনে আনতে এবং এ নিয়ে কাজ করতে চাইলেও একটি সামগ্রিক নড়াচড়া কিছুতেই যেন অনুভূত হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শিল্প ও শিক্ষায়তনের মধ্যকার এ যোগাযোগটি পর্যাপ্ত পরিসরে নিবিড় করে তুলতে না পারলে তাতে শিক্ষার মান ও শিল্পের উৎপাদন কোনোটির ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পক্ষে একটি বৈশ্বিক মান অর্জন করা সম্ভব হবে না।

আর তা করতে না পারলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সনদধারীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বাস্তবে তাদের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসবে। অন্যদিকে শিল্পকারখানাগুলো মান ও মূল্যের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লে দেশের বাজার ক্রমেই বিদেশি পণ্যের জন্য অধিকতর সহজ ক্ষেত্র হয়ে উঠবে, আমাদের যথেষ্ট মেধা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও। আর সে রকম একটি অনাকাঙ্ক্ষিত নিকট ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিক্ষা ও শিল্প খাতের নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তারা পরস্পরের মধ্যে একটি কার্যকর ও নিবিড় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় দ্রুতই এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি।

আবু তাহের খান : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

atkhan56@gmail.com

শিল্প শিক্ষায়তন সংযোগ নিবিড়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম