সড়ক ও বাজার নিয়ন্ত্রকদের হাতে সরকার জিম্মি
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভেবেছিলাম শিরোনামের শেষটায় লিখব ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’। কিন্তু পরে অনুধাবন করলাম বাস্তবতাটি ভিন্ন। সাধারণ মানুষকে রক্ষা করবে যে সরকার সেই সরকারই তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। সড়ক ও বাজার নিয়ন্ত্রণযানের ড্রাইভিং সিট থেকে সরকারকে সরিয়ে দিয়ে এসব অঞ্চলের শক্তিমানরা আসন দখল করে সরকারকে জিম্মি করেছে। অনেকটা লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসনের মতো। প্রশাসন পরিচালনার দায় সরকারের রইল ঠিকই কিন্তু সব চর্ব-চোষ্য-লেহ্য আকণ্ঠ পান করতে থাকলেন এসব অঞ্চলের ক্ষমতাবানরা। এরা পর্দার অন্তরালে সুখনিদ্রা দিলেন আর সমালোচিত হতে থাকল সরকার। সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষুব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে সরকারের কাছের কোনো পক্ষ কী গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? না হলে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে চাল, তেল থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম ঝড়ের গতিতে বেড়ে যাচ্ছে কেন! অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস আর পানির মূল্য। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এখন রেকর্ড ছাড়াতে যাচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণে সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে এগিয়ে না এসে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে যেন অসহায় দৃষ্টিতে সব দেখছেন। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই বলতে হচ্ছে যানবাহনে দক্ষ চালক নিয়োগের কথা। এমন একটি জিম্মি দশার অবস্থা দেখে গভীর হতাশায় ডুবছে এদেশের সাধারণ মানুষ।
সরকারের হাতে যে সড়ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই সেই সত্য তো বহু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। জনগণের মাথায় হাজারটা কাঁঠাল ভেঙে হলেও যানবাহনের শ্রমিক মালিকদের স্বেচ্ছাচার মানতে হয় সরকারকে। আর এরাও সরকারের দুর্বল জায়গাটি চিনে ফেলেছে। একে তো এ অঞ্চলে আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর ভোট ব্যাংক রয়েছে, অন্যদিকে গণবিরোধী হলেও এদের সংঘবদ্ধ শক্তির দাবির মুখে সরকার পক্ষ বরাবরই নমনীয় থাকছে। সরকারি মন্ত্রী এমপিরা শ্রমিক সংগঠনের আর মালিক সমিতির নেতা হওয়ার সুবাদে নিজ নিজ স্বার্থ ঠিক রাখতে গণঅধিকারকে বারবার ভূলুণ্ঠিত করেছে। সাধারণ নাগরিককে গাড়ির চাকায় পিষে ফেলায় চালক দোষী সাব্যস্ত হলেও কিছু বলা যাবে না? ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যাবে না? শাস্তি দিলে রাস্তার রাজারা মুহূর্তে সড়কে অবরোধ গড়ে তুলবে! অচল করে দেবে পরিবহণ ব্যবস্থা! অগত্যা সরকারকে আপসের পথই বেছে নিতে হয়। এখন এমন এক দশায় সাধারণ মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে যে সড়কে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই এ সত্য তারা বুঝে নিয়েছে। কিন্তু এমন অন্তঃক্ষরণের প্রতিক্রিয়া যে ভয়ংকর হয় সে ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা সতর্ক বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের সরকারগুলো বরাবরই বর্তমান ভালোটাই দেখে। আগামীর ভয়ানক সংকটের কথা তেমন একটা বিবেচনায় রাখতে চায় না।
আমরা এ সত্যটি বহুবার লিখেছি কিন্তু যাদের বিবেচনায় নেওয়ার কথা তারা বরাবরের মতোই যেন তুচ্ছজ্ঞান করছেন। আমাদের দেশে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এ সত্যও এড়িয়ে গেলে চলবে না একই সঙ্গে এদেশে ধনবৈষম্যও অনেক বেড়েছে এবং বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসল একটি শ্রেণির হাতে জমা হচ্ছে আর আঙুলের ফাঁক দিয়ে যেটুকু বেরিয়ে যাচ্ছে এর ছিটেফোঁটা দিয়ে অসহায় মানুষকে উন্নয়নের আস্বাদ নিতে হচ্ছে। এই সত্যটি তো মানতে হবে একটি দেশের সিংহভাগ মানুষের যাপিতজীবনে যদি উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগে তবে সে উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে না। প্রতিদিনের নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের যদি নাভিশ্বাস ওঠে, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়, চিকিৎসা খরচ জোগাতে চোখে অন্ধকার দেখে, সড়কের অব্যবস্থাপনায় মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হতে থাকে তখন পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেল তাদের মনে আনন্দ তৈরি করে না। ফলে এসব উন্নয়নের দৃশ্যমান খতিয়ান দেখালেও ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার সুযোগ কম।
সবাই হয়তো লক্ষ করেছেন, দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও গত এক বছরে দোকানে, ফিলিং স্টেশনে, বাজারে, সড়কে সংখ্যার বিচারে ভিক্ষুক অনেক বেড়ে গেছে। ভাসমান মানুষ কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে। এই কঠিন শীতেও জবুথবু হয়ে ফুটপাতে ঘুমানোর মানুষের সংখ্যা কতটা কমেছে বা বেড়েছে সেই পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কোনো ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের এবং জীবিকার সুযোগ হয়তো তারা পায়নি। এসব বিবেচনায় এনে কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে উন্নয়নের মর্মার্থ এসব মানুষ বুঝবে কেমন করে।
একজন চাকরিজীবীর বেতন থেকে পাওয়া আয় তো নির্দিষ্ট। সরকার কয়েক বছর আগে বেতন কাঠামো পরিবর্তন করেছে। প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বেতন। সে কথা সরকার পক্ষ মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয়। এতে মানুষের সাংসারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যও কিছুটা ফিরে এসেছিল। চাকুরেদের বেতন বাড়লে ভিন্নভাবে সেই সুবিধা ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষও উপভোগ করে। কিন্তু ২০১৫-এর পে-স্কেলের পর এ পর্যন্ত নিত্যপণ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়িভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ কত হারে বেড়ে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে পরিসংখ্যান কি আমরা সামনে আনতে পেরেছি? সাধারণ মানুষ কতটা সুখে আছে আর কতটা কষ্টে আছে পরিসংখ্যান ধরে হিসাব না মেলালে তো বিষয়টি বুঝা যাবে না।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী একদিকে জানাচ্ছেন ধান উৎপাদনে বাম্পার ফলন, খাদ্যশস্যের বিশাল মজুত রয়েছে। পাশাপাশি লাফিয়ে বাড়ছে সব কিছুর মূল্য। চালের বাজারের অস্থিরতা কাটানো যাচ্ছে না; পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে। নিয়ন্ত্রণের জায়গায় সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার প্রকৃত রাজনীতিবিদদের সাইডলাইনে রেখে ব্যবসায়ীদের মন্ত্রী, এমপি বানাতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিল। হয়তো ভাবনা ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা সাফল্য দেখাতে পারবেন। কিন্তু ফর্মুলা আমলে আনেনি সরকার। বণিক স্বার্থ যে শুধু নিজ পুঁজি বৃদ্ধিতেই দৃষ্টি দেয় এ সাধারণ সত্য গুরুত্ব পায়নি। ১৯ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ সরকার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। ঘটনাক্রমে ব্রিটিশ সরকারের বদলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা বাংলায় অতঃপর ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কোথাও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নীতি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করত। সাধারণ মানুষকে আপাতত সুখে রেখে নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করত। আর গোপনে পাচার করত উপনিবেশের সম্পদ। কিন্তু কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ফর্মুলা ভুলে তারা অধিক লভ্যাংশ তুলতে গিয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। যার শেষ প্রতিক্রিয়া ১৮৫৭ সালের বিপ্লব। এ সময় ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে বণিকদের হাতে কর্তৃত্ব দেওয়ার কুফল। ফলে বাধ্য হয়ে কোম্পানি শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল ভারতবর্ষে।
আমাদের রাজনীতি আর বাজারের দশা দেখলে ইতিহাসের এ পর্বগুলোর কথা মনে পড়ে। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র সরকারের নানা জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যয়-ঘাটতি পূরণের সামর্থ্য না থাকলেও সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে ঘাড় মটকে অর্থ আদায় করে না। মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্বই তো সরকারের। আমরা দেখতে পাচ্ছি সার্কাসের সঙ-এর মতো দাঁড়িয়ে আছে বাণিজ্য আর খাদ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই নানা যুক্তিতে ব্যবসায়ীরাই ভোজ্যতেল, চালসহ নানা নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। একবারও জনগণের দুর্দশার কথা বলছে না দায়িত্বশীল পক্ষ। যেন জিম্মিদশায় অন্তরীণ সরকারের কাজ হচ্ছে তাকিয়ে তাকিয়ে সেসব দেখা আর সাফাই বক্তব্য দেওয়া।
এমন এক সাফাই বক্তব্য কদিন আগে টিভিতে দেখে বিষণ্নবোধ করলাম। নগরবাসী জানে ওয়াসা কতটুকু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে। ইতোমধ্যেই ধাপে ধাপে মূল্য বাড়িয়ে ত্রাহি অবস্থায় রেখেছে মানুষকে। এবার গলাটিপে ধরতে চাইছে যেন। ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে সাফাই বক্তব্য রাখলেন ওয়াসার এমডি। শুনতে গিয়ে মনে হলো মধ্যযুগের ইউরোপের কোনো সামন্ত অধিপতির বক্তব্য শুনছি। তিনি জানালেন ১০০ ভাগ থেকে নানা ধাপে মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল। তারা যেন দয়া করে ‘মাত্র’ ২০ ভাগ বাড়াচ্ছেন। ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গি আর শব্দ চয়নে মনে হলো জনগণের প্রতি সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই। জানালেন ভিক্ষা করে তারা ওয়াসা চালাতে পারবেন না। কথা ঠিক। কিন্তু তার বোধ হয় জানা নেই জনগণের সরকার জনগণকে বাঁচিয়ে অন্যভাবে এই ‘ভিক্ষার টাকা’ জোগাড় করে। জনগণকেই যদি সব ব্যয় নির্বাহ করতে হয় তবে ওয়াসা হয়ে যেত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর এমডি সাহেব হতেন প্রধান ঠিকাদার। আমরা যতদূর জানি তিনি একজন বেতনভুক কর্মচারী। সবচেয়ে খারাপ লাগল এমডি সাহেব কড়া ভাষায় ওয়াসার মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কথা জানালেন কিন্তু একবারও জনগণের কষ্টের কথা বললেন না। সামান্য সহানুভূতিও জানালেন না। দেশে সুশাসন না থাকলে বোধহয় এমনই হয়। শুধু ওয়াসা কেন গ্যাসের আতঙ্ক তো এখন দেশজুড়ে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে গ্যাসের মূল্য। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। এসব উচ্ছেদ করে সরকার ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করতে পারছে না। সব দায় নিতে হচ্ছে জনগণকেই।
দেশে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির রামরাজত্ব চলছে। কঠোর হাতে এসব দুর্নীতি কমিয়ে, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে, ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারের পক্ষে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি মেটানো অনেকটাই সম্ভব। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি ধরে রাখতে ব্যস্ত সরকারগুলো সুশাসনের পথে হাঁটতে পারছে না বলে সে পথে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এখন যদি হিসাব নিয়ে অঙ্ক করা যায় একজন নাগরিকের আয় এবং তার গ্যাস, পানিসহ প্রতিদিনের জীবন নির্বাহের সামগ্রিক ব্যয়ের পার্থক্য কত তা হলে আমাদের ধারণা দেখা যাবে অধিকাংশ মানুষ একটি বড় ঘাটতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ বাস্তবতায় জনগণ সরকারের ঘাটতি মেটাবে কী করে?
আমরা চাইব জিম্মিদশা থেকে মুক্তি ঘটুক সরকারের। সরকার নিয়ন্ত্রকরা বাস্তবতার উঠোনে দাঁড়ান। কারণ যে দিকে দেশ এগোচ্ছে তাতে সরকার জনকল্যাণকামী না হতে পারলে-জনগণের প্রতিদিনের কষ্ট মোচনের পদক্ষেপ না নিতে পারলে যে ক্ষুব্ধতার আগুন ভেতরে ভেতরে জ্বলছে তা উন্নয়নের উজ্জ্বল ছবি দেখিয়ে প্রশমন করা সম্ভব হবে না।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
