Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রভাতফেরিকে আদিরূপে দেখতে চাই

Icon

ড. এমএ মাননান

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রভাতফেরিকে আদিরূপে দেখতে চাই

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারির একুশ শুধু একটি মাস-তারিখ নয়; নয় শুধু একটি দিনমাত্র। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিশ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটি নিজেই একটি ইতিহাস, বাঙালি-জীবনে রক্ত-রাঙানো একটি জেগে ওঠার দিন, অনন্য একটি অর্জনের দিন, মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেওয়ার প্রয়াসী হায়েনাদের গ্রাস থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাঙালি জাতির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটি দিন। এমন একটি দিন, যে দিনটি আন্তর্জাতিকতায় রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। আজ বিশ্বের সব দেশ এ দিনটিকে স্মরণ করে, বরণ করে, উদ্যাপন করে, আপন আপন ভাষাকে শ্রদ্ধা জানায়, মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য প্রতি বছর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। অথচ প্রত্যুষে নগ্নপায়ে প্রভাতফেরির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হওয়ার প্রচলিত রীতি পালটে মধ্যরাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হয় সবাই আমাদের এ ঐতিহ্যটির কথা ভুলে গেছে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ঐতিহ্যদরদি মানুষ ছাড়া। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও তেমন হয় না; সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আলোচনা হয় না। সয়ে গেছে সব। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-কলামিস্ট একেএম শাহনাওয়াজ এ ব্যাপারে বেশ সোচ্চার। তিনি একাধিকবার বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে লিখেছেন এবং জনমত সৃষ্টির চেষ্টাও করছেন। আমার মতো যারা ষাট-সত্তরের দশকে এবং এরশাদ-পূর্ব সময়ে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে খালি পায়ে যোগ দিতাম প্রভাতফেরিতে, তারা প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে মন খারাপ করে চিন্তা করতে থাকি-ভবিষ্যতে অন্যান্য বাঙালি ঐতিহ্যও কি এভাবে ভূলুণ্ঠিত হতে থাকবে?

একুশের প্রভাতফেরির আদিরূপ মলিন হয়ে গেছে সেই কবে। দিনদিন তার রূপ আরও মলিন হচ্ছে। এখন আর আগের মতো জুতা খুলে নগ্নপায়ে মিছিল করে প্রত্যুষে প্রভাতফেরি হয় না। মধ্যরাতে শুরু করে পরদিন দুপুর পর্যন্ত শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার সময়ে জুতা পায়ে দলে দলে লোকজনদের চলতে দেখে পুরোনো মানুষদের মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। ভোরবেলার প্রভাতফেরি আর আদিরূপে ফিরে যেতে পারল না। পারবে কিনা, তা কেউ বলতেও পারবে না। একবার রূপ হারালে সেই রূপ কি আর সহজে ফিরে পাওয়া যায়? রূপকে হারিয়ে যেতে পথ করে দেওয়া সহজ; কিন্তু রূপকে আপন পথে চলতে দেওয়া অত সহজ নয়। পথহারানোরাই অন্যের চলার পথ নষ্ট করে দেয়। একুশের প্রভাতফেরির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন দরকার ঘুরে দাঁড়ানোর। সবকিছুকে হারিয়ে যেতে দিতে হয় না। দেওয়া যায় না। জাতীয় ইতিহাসের সম্মান রক্ষার্থেই তা প্রয়োজন। ইতিহাসকে বিকলাঙ্গ করার চেষ্টা করলে ইতিহাস কখনো আপসরফা করে না, ঘুরে দাঁড়ায়।

প্রভাতফেরির পেছনের ইতিহাস জানলে নিশ্চয় নবপ্রজন্ম নতুন করে চিন্তা করবে, নব-উদ্দীপনায় জেগে উঠবে। ফিরে যাই সেই ইতিহাসে। সত্তর বছর আগের এক ফেব্রুয়ারিতে গর্জে উঠেছিল বাঙালি তরুণ-তরুণীরা। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানি শাসকরা। শহিদ হয়েছিলেন রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম, সফিউরসহ অনেকে। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শুধু আমতলা নয়, সারা ঢাকা শহরেই হতাহত হয় তারুণ্যে উজ্জীবিত মিছিলকারীরা, যারা নিজের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য শাসকদের ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে নেমেছিল রাজপথে। অবশ্য আন্দোলন দানা বাঁধে এরও অনেক আগেই; যখন পাকিস্তানের জনক নামে অভিহিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরওয়ালারা সদম্ভে ঘোষণা করে, ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার এ ঘোষণা ছিল একেবারেই একটি হঠকারী ঘোষণা, যেখানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনসংখ্যা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলোর ভাষাও উর্দু ছিল না; সেগুলোতে ছিল পাঞ্জাবি, বেলুচি, সিন্ধি, পাঠান। জিন্নাহসহ বোম্বে-গুজরাট থেকে আগত মুহাজির, যারা পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়, শুধু তাদের ভাষাই ছিল উর্দু। তখনকার প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নিয়ন্ত্রিত সরকার ‘এক জাতি এক তমদ্দুন, এক ভাষা’র স্লোগান তুলে উর্দুকে সারা দেশের বুকে চাপিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঙালিরা আসন্ন বিপদ আর ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে রাজপথে গর্জে উঠেছিল, যা ছিল প্রথমবারের মতো বিশ্বের বুকে অচিন্তনীয় এক আগুনভরা বিপ্লব; যা আপন ভাষার, মায়ের মুখের ভাষার অধিকার আদায়ের বিপ্লব।

সরকারি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রক্তচক্ষুকে একপাশে ঠেলে দিয়ে আপামর বাঙালি জনতা রুদ্ররূপ নিয়ে ভাষা রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ নেতা, একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন বাঙালি জাতিসত্তার ভাবনা বুকে ধারণ করে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে তিনিও একাত্ম হয়ে গেলেন, তখন জেলে অন্তরিন থাকা সত্ত্বেও ভাষার অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ১৬ থেকে শুরু করে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনশন ধর্মঘট করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তার পরামর্শক্রমে। স্বাধীনতার পরও তিনি চুয়াত্তরে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা ২০১০ সালে বাবার মতোই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন।

সময়টা তখন এমন যে, মাত্র চার বছর আগে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হয়েছে। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রটি একটা মেকি রঙিন স্বপ্ন তৈরির চেষ্টা করছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসাবে পূর্ববঙ্গের বুকে চতুরতার সঙ্গে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে দিয়ে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় পর্যুদস্ত অবস্থার সৃষ্টি করে ভাষা-সংস্কৃতির স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকচক্রের এ দুরভিসন্ধি আর অপতৎপরতা বাঙালি তরুণরা, বিশেষভাবে ছাত্রছাত্রীরা, বুঝতে পেরে রুখে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে তৈরি হয় ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার নতুন তাগিদ, নতুন প্রেরণা; সৃষ্টি হয় সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন সম্ভাবনার পথ।

তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার, বাংলা ভাষা এ অঞ্চলের শাসকদের কাছে কোনোকালেই গুরুত্ব পায়নি; এমনকি অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন ভাষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। মোগলরা যখন পারস্য-সীমানা অতিক্রম করে ভারতে এসে শাসক সেজে বসেছিল, তখনও মোগলীচক্রে পড়ে স্থানীয় সব ভাষাই প্রাণ হারাতে বসে। পুরো ভারতবর্ষে চাপিয়ে দেওয়া হয় পারস্য সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘ফার্সি’। সামন্তযুগীয় রাজতন্ত্র কখনো চায়নি এ ভূখণ্ডের মানুষ লেখাপড়া শিখুক, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক। তাই তারা ফারসিকে রাজদরবারের ভাষার মর্যাদা দিয়ে নিজেদের বিশেষ নীলরক্তীয় অভিজাত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পায়। ভাষার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার এখানেই শেষ নয়; সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা যখন মোগলদের হটিয়ে ভারতের শাসনভার হাতে নিল, তখন তারাও তাদের দেশের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিল। ব্রিটিশরা বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষকে অশিক্ষিত মূর্খ রেখে দিয়ে দেশ শাসন করতে প্রয়াসী হওয়ার কারণে এ দেশের বিভিন্ন ভাষাকে তুচ্ছতার পর্যায়ে নামিয়ে রাখে। মুসলিম লীগাররা পাকিস্তানের শাসনভার হাতে নিয়েই স্বাধীনতার পরপরই আগের মোগল-ব্রিটিশদের মতো স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে তাদের লীগ ভাষা উর্দুকে পুরো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে চক্রান্তে মেতে ওঠে। অনেকেরই জানা আছে, নবাবি আমলে ঢাকা, বগুড়া আর কুমিল্লার পশ্চিমগাঁও-এর নবাবরা বাংলার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ নিজ দরবারের ভাষা হিসাবে মোগলদের ভাষা ‘ফারসি’ ব্যবহার করতেন। তাদের দোসর মুসলিম লীগাররা একই কায়দায় উর্দুকে বাংলার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় উঠেপড়ে লাগে।

সময় ছিল ভিন্ন; কিন্তু মানসিকতা ছিল অভিন্ন। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা উপেক্ষিত হয়, লাঞ্ছিত হয়। তবে পদদলিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা। গর্জে ওঠে রাজপথে সামন্তবাদী মুসলিম লীগ সরকারের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্ত ঝরিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ভাষার অধিকার। আর এ কারণেই এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে চিরকাল। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রমাণ করে দিয়েছে এবং এদেশের মানুষকে শিখিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে এবং আপামর জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ তৈরি করা সম্ভব হলে যে কোনো হঠকারিতাকে শুধু রুখেই দেওয়া যায় না; বরং প্রতিক্রিয়ার প্রবল শক্তিকেও পরাজিত করা যায়। যে একুশে আমাদের মধ্যে চুপটি করে থাকা অমিত শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছে, সেই একুশ তার হারিয়ে যাওয়া প্রভাতফেরির আদিরূপ ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা করতেই পারে।

সারা বিশ্ব জানে, ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালিরাই রক্ত দিয়েছে এবং রক্তের আখরে লিখে দিয়েছে ইতিহাসে মাতৃভাষার অমরত্ব। আমরা চাই, তরুণরা জানুক তাদের ভাষার ইতিহাস, জানুক কীভাবে তাদের পূর্বসূরিরা লাঞ্ছিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে। আর এ কারণেই আমরা কামনা করি, একুশের সকালের প্রভাতফেরি তার আসল রূপে ফিরে এসে ইতিহাসে আবার নতুন করে ঠাঁই নিক, জেগে উঠুক পূর্বচেতনা নতুন রূপে নবীন হৃদয়ে। আমাদের ভবিষ্যতের নতুন কান্ডারিরা, নতুন প্রজন্মের নবীনরা মধ্যরাতে নয়, প্রত্যুষে প্রভাতফেরি করে শহিদ মিনারে গিয়ে ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে শ্রদ্ধা জানাক ভাষাসংগ্রামীদের প্রতি।

অধ্যাপক ড. এমএ মাননান : সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরি আদিরূপ দেখতে চাই

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম