স্বদেশ ভাবনা
নতুন ইসি দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করুক
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে অবসান হলো সব জল্পনা-কল্পনার। সম্প্রতি প্রণীত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর আলোকে সরকার গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি সুপারিশকৃত ১০ জনের তালিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্দিষ্ট করা পাঁচজনের একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজনকে অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গঠিত হলো নতুন ইসি। সিইসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত চারজন হলেন-সাবেক দুই সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা এবং ব্রিগেডিয়ার জেনালের আহসান হাবীব খান (অব.)। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার তাদের কার্যভার গ্রহণের আগে শপথ নিয়েছেন। দেশে এ যাবত অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অন্যসব জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল না। তাই নবগঠিত ইসি কতটা সুষ্ঠুভাবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করে, তা দেখার জন্য দেশবাসী উন্মুখ হয়ে থাকবে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, নবগঠিত ইসি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নতুন ইসিকে স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি আশা প্রকাশ করেছে, নতুন ইসি দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নতুন ইসিকে তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নতুন ইসি সম্পর্কে কিছুটা বিরূপ মন্তব্য করেছে। দলটির মতে, নতুন ইসি আওয়ামী লীগ সমর্থিত আমলানির্ভর। এই ইসি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
ইসি গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ না নেওয়া মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নতুন ইসি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নতুন ইসির সদস্যরা সরকারের পছন্দের লোক। তারা সবাই সরকারের অনুগত, সুবিধাভোগী ও তোষামোদকারী।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নবনিযুক্ত সিইসি এবং চার নির্বাচন কমিশনারকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ না নেওয়া রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, সরকারের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠজন বলে বিবেচিত লোকদের দিয়েই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে-এটাই বাস্তব সত্য।
ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ না নেওয়া আরেকটি রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের খেয়ালখুশি মোতাবেক নতুন ইসি গঠন করেছে। তার মতে, অতীতের ইসির মতোই নতুন ইসি আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবে।
সদ্য গঠিত ইসি নিয়ে দেশে এ যাবত ১৩টি ইসি গঠিত হলো। বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রপতি পদের এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরির তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ইসির ওপর ন্যস্ত করেছে (অনুচ্ছেদ ১১৯(১)। তাছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনি আইন ও বিধিমালায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ইসি এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এবং চলতি শতকের প্রথম দশকে অন্তর্বর্তীকালীন ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া ইসি অন্য কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেনি। গত প্রায় এক দশকে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের সংখ্যাও খুবই কম। বাংলাদেশের সংবিধান, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এবং বিভিন্ন বিধিমালা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের ইসিকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। অনেকের মতে, আইনি ক্ষমতায় বাংলাদেশের ইসি ভারতের ইসির চেয়ে শক্তিশালী। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইসি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
ইসি নির্বাচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার মূল কারণগুলো হলো-ক. নির্বাচনে দলীয় সরকারগুলোর হস্তক্ষেপ রোধে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনায় দৃঢ়তা প্রদর্শনে দলীয় ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী ইসির ব্যর্থতা; খ. ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতি বাস্তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ প্রশাসনের অনুরক্ততা।
১৯৭২ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম সিইসি ছিলেন বিচারপতি মো. ইদ্রিস। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকা, রাষ্ট্রীয় রেডিও-টেলিভিশন ও যানবাহনসহ প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ কর্তৃক বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের। ১১টি আসনে বিরোধীদলীয় কোনো প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিতে পারেননি। ইদ্রিস কমিশন শাসক দলের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে এবং জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের ২৯৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর দু’জন সামরিক শাসক সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে প্রায় ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। বেসামরিক পোশাকে রাজনৈতিক দল গঠন করে তারা তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২য়, ৩য় ও ৪র্থ) অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ সময়কালে যারা সিইসির দায়িত্বে ছিলেন তারা হলেন বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম এবং বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ। বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম সিইসি পদে নিয়োগ পান ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ে। সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের শাসনামলে সিইসি হিসাবে নিয়োগ পান বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ। এ দু’জনের নেতৃত্বাধীন ইসি উপর্যুক্ত তিনটি সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জয়লাভের জন্য ক্ষমতায় থাকা দলগুলো মাঠ প্রশাসনসহ পুরো প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে। জনগণ সহজেই বুঝতে পারেন, সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে পরিচালিত হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের ফল আগে থেকেই ছকে বাঁধা থাকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মানুষ নির্বাচনের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফের নেতৃত্বাধীন ইসি এ নির্বাচন পরিচালনা করে। আর সপ্তম (জুন ১৯৯৬), অষ্টম (অক্টোবর ২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যথাক্রমে সাবেক সচিব আবু হেনা, সাবেক সচিব এমএ সাঈদ এবং সাবেক সচিব ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রভাবিত না হওয়ায় এসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে নির্বাচনের ওপর জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসে।
নির্বাচনের ওপর ভোটারদের ফিরে পাওয়া বিশ্বাস বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি। নবম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিএনপি সরকার প্রবর্তিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা আটটি দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে। এতে ওই নির্বাচন অনেকটা একদলীয় রূপ নেয়। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে শাসক দল আওয়ামী লীগ নিয়োগকৃত কাজি রকিবুদ্দিন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। এতে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও সুষ্ঠু হয়নি। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হলো, নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ভোটগ্রহণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এসব ঘটেছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার নিয়োগকৃত এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এতে ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন দেশের জনগণ। দেশে ও বিদেশে সমালোচিত হয় এ নির্বাচন। ফলে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে নেমে আসে।
জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বর্জনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। মানুষ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।
আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব ইসির ওপর ন্যস্ত করলেও ইসির পক্ষে এ নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠ প্রশাসন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসাবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও কমিশন কর্তৃক জেলা প্রশাসককে (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ প্রদান একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই এ দায়িত্ব পালনে তাদের অনেকটা অপরিহার্য করে তুলেছে। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিসহ পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতসীন দলগুলো তাদের জয় নিশ্চিত করতে মাঠ প্রশাসনকে ব্যবহার করে। গত এক দশকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয়। ডিসি, ইউএনও, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসি-এসব কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণের অর্থাৎ পদোন্নতি, বদলিসহ তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকায় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে নির্বাচনে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা অনেকটা সহজ হয়। শাসক দলের স্বার্থ রক্ষার্থে মাঠ প্রশাসনের অপরিহার্যতা বুঝতে পেরে অনেক কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ক্ষমতাসীন দল ও দলের নেতাদের ব্যবহার করেন। দলবাজ কর্মকর্তারা হয়ে ওঠেন দুর্নীতিবাজ। বলা বাহুল্য, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু ইসির ওপর নির্ভর করে না, সুষ্ঠু নির্বাচন বহুলাংশে নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছা ও মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতার ওপর।
নবগঠিত ইসিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করে দুর্বল গণতন্ত্রকে সুস্থ ও সবল করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। এজন্য কমিশনের করণীয় কাজগুলো হবে-এক. নবগঠিত ইসির সিইসি ও কমিশনারদের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি দুর্বলতা থাকলে তা ভুলে যাওয়ার জন্য তাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। ‘আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্য পালনের’ যে সাংবিধানিক শপথ তারা নিয়েছেন, তা থেকে যেন তারা কখনো বিচ্যুত না হন। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে ইতঃপূর্বে একাধিক ইসি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, নতুন ইসিকে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
দুই. শুধু ইসির একার পক্ষে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় ইসি যতই শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হোক না কেন, নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসন কোনো পক্ষ নিয়ে কাজ করলে ইসি তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। তাই নতুন ইসির কাজ হবে বাস্তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ থাকতে উদ্বুদ্ধ করা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করে মাঠ প্রশাসন যে সুনাম অর্জন করেছিল, তা তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। তাদের সেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে অনুপ্রেরণা দিতে হবে।
তিন. ইসিকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচন মঞ্চে কুশীলব হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের এড়িয়ে নয়, বরং তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপিসহ অন্য যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে আসছে, তাদের নির্বাচনমুখী করতে ইসিকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। আশার কথা, নবনিযুক্ত সিইসি ইতোমধ্যে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং বলেছেন, ‘সব দলকে নির্বাচনমুখী করাই হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের মূল লক্ষ্য।’ সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে নতুন ইসি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে-এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
