Logo
Logo
×

বাতায়ন

মুক্তিযুদ্ধের এক বিস্মৃত বীর

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের এক বিস্মৃত বীর

আজ ২৩ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন। এই দিনে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই, যিনি গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, সেই দুর্ধর্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ আলী কসাইয়ের নাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, রংপুর সেনানিবাসের ২৯ ক্যাভালরির পাঞ্জাবি অফিসার লেফটেন্যান্ট আব্বাস সম্মানীপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ আলীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ঘটনাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।

দেশীয় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শাহেদ আলীসহ গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতে আরও তিনজন সৈনিকের মৃত্যুর ওই ঘটনা ছিল সত্যিই অকল্পনীয়। সমগ্র জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল, ঠিক সে সময় শাহেদ আলী নামের এক গ্রাম্য কসাই পাকিস্তানি সেনাদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র হাতে অ্যাম্বুশ করে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। সেদিনের সেই দুঃসাহসিক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রথম গেরিলা অ্যাকশন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে চিরকাল।

শাহেদ আলী পেশায় কসাই হলেও দেশমাতৃকার জন্য বুকভরা সাহস নিয়ে সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের ঘায়েল করেছিলেন। তার এ বীরত্বপূর্ণ অভিযান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু শাহেদ আলীর এ বিরল দুঃসাহসিক অভিযানের কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আজও স্থান পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা যারা গর্ব করি, তাদের কতজন শাহেদ আলী কসাইয়ের মতো ইতিহাসে বিস্মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বলতে পারি? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে শাহেদ আলীর মতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এমন অনেক অজানা-অচেনা বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরগাথা ইতিহাসে আজও লিপিবদ্ধ হয়নি।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। দেশের অন্যান্য জেলার মতো ৩ মার্চ রংপুরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেদিন সকালে হরতালের সমর্থনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে রংপুর শহরে এক জঙ্গি মিছিল বের হলে ১২ বছরের শঙ্কু সমজদার নামে এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার মৃত্যুসংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে গোটা রংপুর শহর। উত্তেজিত জনতা শহরের মূল বাণিজ্যিক এলাকার বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে। শহরের উত্তেজনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেনা কর্তৃপক্ষ সব পদবির সদস্যদের সেনানিবাসের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

৩ মার্চ শঙ্কুর মৃত্যুর ঘটনা ও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর শহরের যেসব ঠিকাদার সেনানিবাসে তাজা রসদ অর্থাৎ মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকেন, তারা এক জরুরি বৈঠকে বসে সেনানিবাসে তাজা রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সেনানিবাসে তাজা রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ে যায়। সরবরাহ বন্ধের কারণে ধীরে ধীরে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। অপরদিকে সেনানিবাসের বাইরে যাওয়া নিষেধ থাকায় অফিসার্স মেসের অফিসারদের জন্য তাজা রসদ সংগ্রহের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, অফিসার ও সৈনিকদের শুধু ডাল ও রুটি খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় চিরকালের প্রথা ভেঙে সৈনিক ও অফিসারদের জন্য প্রতি বেলায় একই মেন্যু, অর্থাৎ শুধু ডাল-রুটি চালু করা হয়।

এমন পরিস্থিতি অবাঙালি অফিসাররা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সিদ্ধান্ত হয়, যে কোনো উপায়ে বাইরে থেকে তাজা খাদ্য সংগ্রহ করে আনতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ মার্চ সকালে একটি জিপ নিয়ে লে. আব্বাস টহল দল নিয়ে খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশে সেনানিবাসের পশ্চিম গেট দিয়ে বের হয়ে গ্রামের পথে অগ্রসর হন। সেনা দলটি দামোদর গ্রামে পৌঁছলে মুহূর্তে সেই সংবাদ আশপাশের গ্রাম, সম্মানীপুর, বড়োবাড়ি ও মনোহরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।

কসাই শাহেদ আলী খবর পেয়ে গ্রামের সবাইকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তানি টহল জিপের দিকে অগ্রসর হতে অনুরোধ করেন। শাহেদ আলী নিজেও একটি খাপ্পর (পশু জবাই করার ধারালো ছোরার মতো দেশি অস্ত্র) নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর জিপটি কাঁচা রাস্তায় ধুলোর কুণ্ডলি পাকিয়ে গ্রামের প্রবেশপথের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের এ প্রবেশপথের দুপাশ ছিল তুলনামূলকভাবে উঁচু জমি এবং ঝোপজঙ্গলে ভরা। শাহেদ আলী ও তার সঙ্গী রফিক, সালাম, আবিদুর রহিম, বাবুল, হায়দার, জসিম ও বাদশা দা-শাবল, কুড়াল ও চাপাতি নিয়ে ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করেন যেন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের উপস্থিতি টের না পায়। এসব যুবকের প্রথাগত প্রশিক্ষণ না থাকলেও বুকে ছিল সাহস আর শত্রু হননের প্রতিজ্ঞা। সিদ্ধান্ত হয় জিপটি মাটির ঢিবির কাছে এলে প্রথমে শাহেদ আলী জিপের বাম পাশে বসা অফিসারকে আক্রমণ করবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বন্ধুরা দ্রুত জিপের পেছনের আসনধারী সৈনিকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাবেন, যেন শত্রুপক্ষ তাদের ওপর পালটা গুলিবর্ষণ করতে না পারে।

জিপটি ঢিবির কাছে আসামাত্র শাহেদ আলী কালক্ষেপণ না করে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো এক লাফে জিপের বনেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং এক ঝটকায় বাম হাতে জিপের ওপর স্থাপিত মেশিনগানটি ছিনিয়ে নেন এবং ক্ষিপ্রগতিতে ডান হাতের খাপ্পর দিয়ে লে. আব্বাসকে আঘাত করেন। খাপ্পরের আঘাতে আব্বাস মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অপরদিকে শাহেদ আলীর সঙ্গীরা খুব দ্রুত জিপের পেছনের সৈনিকদের কুপিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলেন এবং তাদের সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। সেনাসদস্যদের ওপর আক্রমণের খবর চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছুটিতে থাকা এক বাঙালি সৈনিক নুরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন এবং তারই পরামর্শে গ্রামের দুলাল নামে এক ড্রাইভার মৃতপ্রায় সব সেনাসদস্যসহ জিপটিকে গণেশপুর গ্রামের কাছে ডাঙিরপাড় নামক এক পরিত্যক্ত জায়গায় ফেলে আসে।

লে. আব্বাসের টহল জিপ ফিরে আসছে না দেখে ২৯ ক্যাভালরির অধিনায়ক লে. কর্নেল সগীর তাদের অনুসন্ধানের জন্য একটি উদ্ধারকারী টহল দল প্রেরণ করেন। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে সন্ধ্যার ঠিক পরপর ডাঙিরপাড়ে এসে জিপটির সন্ধান পান। লে. আব্বাসের অবস্থা তখন শোচনীয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অন্যদের অবস্থাও একই রকম। উদ্ধারকারী দলটি মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। লে. আব্বাসের জখম এত গভীর ছিল যে, সেনানিবাস থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রংপুরবাসী খুশি হলেও সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। উল্লেখ্য, আব্বাসের মৃত্যুর ঘটনার পর লে. কর্নেল সগীর রংপুরের রাজনৈতিক নেতাদের তার রেজিমেন্ট সদর দপ্তরে ডেকে এনে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। সগীরের সঙ্গে মিটিং শেষে নেতারা গ্রামবাসীর কাছ থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে সেনানিবাসে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

ঘটনার পর শাহেদ আলী নিজ গ্রাম ছেড়ে তার কর্মস্থল লালাবাগ হাটে চলে যান। তিনি ভেবেছিলেন, লালাবাগ হাট তার গ্রাম থেকে অনেক দূরে, তাই পাকিস্তানিরা তার খোঁজ পাবে না। তিনি ছিলেন রংপুর সেনানিবাসের কাছে অবস্থিত সম্মানীপুর গ্রামের অধিবাসী। ভাইবোনদের ভেতর তিনিই ছিলেন সবার বড়। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য বেশিদূর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে তিনি কাজের সন্ধানে বের হয়ে লালাবাগ হাটে একটি মাংসের দোকানে কসাইয়ের কাজ শুরু করেন।

৩ মার্চের ঘটনার পর রংপুর শহরে অবাঙালিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, সেনানিবাসে তাজা রসদ সরবরাহ বন্ধ এবং ২৪ মার্চ লে. আব্বাসের মৃত্যু রংপুর সেনা কর্তৃপক্ষকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে আরও বেশি প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। ফলে ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাতে যেন তারই আক্রোশ মেটায় তারা। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর রংপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। মেশিনগান সজ্জিত ছোট ছোট সেনা দল কারফিউ ডিউটির নামে শহরের অলিগলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং রাতের নীরবতাকে প্রকম্পিত করে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। রংপুরের আকাশে তখন ট্রেসার বুলেটের আগুনের ফুলকি, বাতাসে বারুদের গন্ধ এবং গুলির আঘাতে মানুষের আর্তচিৎকার যেন রাতের ভয়াবহ পরিবেশকে আরও ভয়ংকর করে তোলে।

শাহেদ আলী লালাবাগ হাটে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচতে পারেননি। তারই গ্রামের আমজাদ নামের এক বাঙালি বিশ্বাসঘাতক তাকে ধরিয়ে দেয়। ২৫ মার্চের পর পাক সেনারা লে. আব্বাসের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে খোঁজ করতে থাকে। আমজাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা শাহেদ আলীর খোঁজ পেয়ে একদিন লালবাগ হাটের মাংসের দোকান ঘেরাও করে তাকে আটক করে। আটকের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে শাহেদ আলীর ধস্তাধস্তি হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে একজন সৈনিক রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে শাহেদের বাম চোখে আঘাত করে। ফলে তার চোখ বেরিয়ে আসে। অতঃপর পাকসেনারা মারাত্মকভাবে আহত শাহেদ আলীকে জিপের পেছনের হুকের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায়। অসমতল রাস্তার সঙ্গে ঘর্ষণ খেতে খেতে শাহেদ আলীর দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তার দুটো চোখই উপড়ে ফেলা হয় এবং মাথায় আঘাতের জন্য মগজ বের হয়ে যায়। অবশেষে পাকিস্তানি বর্বররা শাহেদ আলীর মৃত্যু নিশ্চিত করে লালাবাগ হাট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীর হাটের কাছে এক কর্দমাক্ত জায়গায় তার দেহ ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনার পরদিন শাহেদ আলীর মরদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করে সম্মানীপুর গ্রামে কবর দেওয়া হয়। এভাবেই সেদিন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগেই, গেরিলাযুদ্ধ সূচনাকারী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ আলীর জীবনাবসান হয়েছিল।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

 

মুক্তিযুদ্ধ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম