বিশ্ব পরিবেশ দিবস
ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার কেন জরুরি
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। ইকোসিস্টেমে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি প্রত্যেক মানুষের দুর্বলতা রয়েছে। এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গাছপালা, নদীনালা, খালবিল, সাগর ও মহাসাগরের সমারোহে দৃশ্যমান হয়। আবার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সংযোগও রয়েছে। যদিও আধুনিক যুগে কর্মক্লান্ত মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভাবে উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান ইকোসিস্টেমই মানবজাতির অবসাদ বা ক্লান্তি দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে বিদ্যমান নদনদী, খালবিল, সাগর ও মহাসাগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদি কোনো কারণে এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য হারিয়ে যায়, তাহলে ইকোসিস্টেমের কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সমাজে মানুষের চাহিদা মেটাতে ইকোসিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১১ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯ কোটি ২০ লাখ ৭৮ হাজার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার ২১০০ সালের দিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যা কমে ১৫ কোটি ১০ লাখ ৩৯ হাজার হতে পারে। ২০২০ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এ দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইকোসিস্টেমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
গ্লোবাল ইকোলজিক্যাল সংকট মোকাবিলায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বনায়ন ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের গতি বাড়ানো সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের মোট ভূমির মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ বনভূমি। পরিবেশ সংরক্ষণে যে কোনো দেশে মোট ভূমির প্রায় ২৫ শতক বনভূমি থাকা প্রয়োজন। দেশে বনায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশের বিপর্যয় মোকাবিলায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ইকোসিস্টেমে বিদ্যমান গাছপালা খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে থাকে। ফলে বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে আমাদের প্রাণপ্রিয় পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। অন্যদিকে ইকোসিস্টেমে বিদ্যমান বনাঞ্চল আমাদের মধু, ওষুধ, কাঠ ও বিভিন্ন ধরনের খাবার সরবরাহ করে থাকে। বননাঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গত ২ কোটি বছরের মধ্যে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ সর্বোচ্চ। এ কারণে বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ কমানোর জন্য অনবরত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ইকোসিস্টেমে বিদ্যমান গাছপালাই বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন শোষণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। একটি গাছ বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান কার্বন শোষণের মাধ্যমে তা দীর্ঘদিন ওই গাছে সংরক্ষণ করতে পারে। দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, লম্বা, বড় পাতাবিশিষ্ট ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন গাছ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণ করতে পারে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইকোসিস্টেমে বিদ্যমান উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্যময়তা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতি প্রাকৃতিকভাবেই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। যদি কোনো কারণে কোনো একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে ওই প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল অন্য প্রজাতিও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান খাদ্যশৃঙ্খলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। এ ভারসাম্যহীনতায় প্রকৃতিতে বিদ্যমান উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতিগুলোর বাসস্থানের পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সমগ্র বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, করোনাভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে ওই প্রাণী নিশ্চয়ই পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় বাসস্থানের অভাবে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে মানবজাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ বিশ্লেষণে আরও বলা যেতে পারে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ছাড়াও মানুষকে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষার জন্যও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার অতীব জরুরি।
মাটিতে বিদ্যমান অণুজীব মাটির উর্বরতা শক্তি, উৎপাদনশীলতা ও ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ওই অণুজীবগুলো ইকোসিস্টেমে জৈব উপাদান হিসাবে ভূমিকা রেখে মাটির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। বর্তমানে শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য এবং কৃষিতে প্রয়োগকৃত রাসায়নিক উপাদান অণুজীবের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে উপকারী অণুজীব যেমন মাইকোরাইজা ও ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা আনুপতিক হারে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল উৎপাদনে কৃষকের রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে মাটিতে বিদ্যমান অণুজীবের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে রাসায়নিক উপদানের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যেতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব বেড়েছে। যদি কেমিক্যাল প্রয়োগ ছাড়াই খাদ্য উৎপাদান বাড়ানো যায়, তাহলে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। এভাবে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব। ফলে স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভাসাম্য রক্ষা ও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারও সম্ভব। জাতিসংঘ ২০২১-২০৩০ দশককে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। মূলত ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের বিষয়টি কারোনাভাইরাসের অভিজ্ঞতায় জাতিসংঘের নজরে এসেছে। ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে বনায়ন, ম্যানগ্রোভ, পিটল্যান্ড, মাটির উর্বরতা, বণ্যপ্রাণী, ধ্বংসপ্রাপ্ত ল্যান্ডস্কেপ, উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও সামদ্রিক ব্লু-ইকোনমি সংরক্ষণের ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে গ্লোবালি ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে গৃহীত পদক্ষেপগুলোও প্রশংসার দাবি রাখে। আবার আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে দেশে ১ কোটির বেশি গাছ লাগানো হয়েছে, যা ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে। বস্তুত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের বিষয়টিতে সবার গুরুত্ব দেওয়া উচিত। গাছপালা রোপণ, নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর ও মহাসাগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অণুজীবের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও শহরায়ন, জলাশয় সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বনায়ন সংরক্ষণ, সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধি, ম্যানগ্রোভ বনায়ন সংরক্ষণ, নদীর নাব্য রক্ষা ও ব্লু-ইকোনমির ওপর গবেষণার মাধ্যমে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষিত হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu