Logo
Logo
×

বাতায়ন

মোটরবাইকে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যু

Icon

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মোটরবাইকে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যু

লকডাউনের সময় দীর্ঘদিন দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহণ যখন বন্ধ ছিল, তখন মোটরবাইকের ব্যবহার বেড়ে যায়। গত বছর এবং এবারের রোজার ঈদে মোটরবাইকের ব্যবহার বহুগুণ বেড়েছে। করোনার কারণে চাকরি চলে যাওয়ায় অনেক কর্মজীবী পরিবারের হাল ধরতে মোটরবাইককে আয়-রোজগারের বিকল্প হিসাবে বেছে নিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের নতুন কোনো ঘটনা নয়। বর্ষাকালে নৌদুর্ঘটনা, সড়ক-মহাসড়কে বাস দুর্ঘটনা, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া প্রভৃতি কারণে যাত্রী হতাহত হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এ দৌড়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মোটরবাইক দুর্ঘটনা, যা সাম্প্রতিককালে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্প্রতি পদ্মা সেতুতে বেপরোয়া গতিতে বাইক চালিয়ে দুজনের প্রাণহানির ঘটনা সাধারণ মানুষ এবং সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোনোরকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে মোটরবাইক শহরের ভেতরে এবং হাইওয়েতে দুই-তিনজন যাত্রীসহ অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে এবং প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরের দিন থেকেই এ দ্বিচক্রযান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, বাড়ছে মোটরবাইক সংখ্যাও। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীন বাইকের দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকেই। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপ মতে, এবারের (২০২২) রোজার ঈদে গণপরিবহণের বিকল্প হিসাবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় আসা-যাওয়া করেছেন। ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে; তার মধ্যে নারী ৩৮, শিশু ৫১; আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার। ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরবাইকের। আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এ দুই চাকার বাহনে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ঈদযাত্রায় ১৬৪টি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হয়েছেন, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪.০৮ শতাংশ; নিহতের ৩৪.৮৫ শতাংশ ও আহতের ১৩.০৩ শতাংশ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন। এ সংখ্যা ২০১৯ সালে ৯৪৫ এবং ২০২০ সালে ছিল ১ হাজার ৪৬৩ আর ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ২১৪ জন। নিহতদের ৭৫ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর। পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৭৪ জন চিকিৎসা নেন; যাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।

২০২১ সালের ঈদুলফিতরের সময়ের চেয়ে এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের ঈদুলফিতরের সময় ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সংঘটিত মোটরবাইক দুর্ঘটনার ধরনগুলো হলো-মুখোমুখি সংঘর্ষ ১৬.১৯, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪১.৯৫, অন্য যানবাহন ধাক্কা/চাপা ৩৯.০৪ এবং অন্যান্য কারণ ২.৮২ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের চিত্রটি শতাংশ হিসাবে এ রকম-মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ৪১.৪৮ শতাংশ, বাসযাত্রী ৮.৫১ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টরযাত্রী ৫.৩১ শতাংশ, মাইক্রো-কার, অ্যাম্বুলেন্সযাত্রী ৩.৯৮ শতাংশ, থ্রি-হুইলারযাত্রী ২০.৭৪ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-মাহেন্দ্রযাত্রী ৩.৪৫ শতাংশ, বাইসাইকেল, রিকশাযাত্রী ২.১২ শতাংশ, পথচারী ১৪.৩৬ শতাংশ। অঞ্চলভিত্তিক এসব দুর্ঘটনা হলো-ঢাকা বিভাগে ২৯.৩২ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২০.৮৪ শতাংশ, খুলনায় ৯.১৮ শতাংশ, বরিশালে ৫.৩০ শতাংশ, সিলেটে ২.৪৭ শতাংশ, রংপুরে ৮.৪৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৬.৩৬ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ৮৩টি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সিলেটে সাতটি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম ৯ জনের মৃত্যু। ৪৬.৬৪ শতাংশ দুর্ঘটনা জাতীয় মহাসড়কে, ৩০.৭৪ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে-মোট দুর্ঘটনার মধ্যে ৬৭টি (২৩.৬৭ শতাংশ) ঘটনায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে, ১১২টি (৩৯.৫৭ শতাংশ) ঘটনায় বাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হতাহত ঘটেছে। এসব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২ শতাংশ) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এসব জরিপ থেকে সহজেই দেশে মোটরবাইক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র অনুমেয়।

কেন এত দুর্ঘটনা? মানুষ অনুপাতে নগর-মহানগরে অভ্যন্তরীণ চলাচলে যথেষ্টসংখ্যক গণপরিবহণ নেই। দ্রুত চলাচলের উদ্দেশ্যে তরুণরা ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে মোটরবাইকের ওপর। এর ওপর রয়েছে দুঃসহ যানজট, কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছে। বাহনটি ট্রাফিক আইন মানতে চায় না। ডানে-বামে যেখানে সুযোগ পায়, সেখান দিয়েই ওভারটেক করার প্রবণতায় একটু ফাঁকা পেলেই বড় গাড়ির সামনে হঠাৎ করে হাজির হয়, ফুটপাতেও চলতে দেখা যায়, এমনকি উলটা পথেও ইচ্ছামতো আঁকাবাঁকা, ইচ্ছামতো স্টাইলে দ্রুত গতিতে চলছে। এভাবে চলতে চলতে চালক কারও পায়ে, মাথায়, বাস-গাড়ির বাম্পারে, রিকশার ওপর কিংবা কোনো পথচারীর গায়ে গিয়েও পড়ছে। কয়েক মাস আগে মোটরবাইকের দুর্ঘটনা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, কোনো এক অজানা কারণে এখন আর সেই নিয়ম পালিত হচ্ছে না।

যেহেতু মোটরসাইকেল এখন গণপরিবহণের বিকল্প হতে চাইছে, তাই এদের জন্য সঠিক নিয়মকানুন, গতিবেগ, লেন ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। একসঙ্গে কতজন চলতে পারবে, হ্যামলেট বাধ্যতামূলক করা, উলটোপথে এবং কোনো অন্যায় করলে জরিমানার কঠোর বিধান রাখা উচিত। অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ যেন মোটরবাইক নিয়ে বের না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। পরিবার থেকেও এটি মনিটরিং করা দরকার। যত্রতত্র বাইক পার্কিং করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ফুটপাত কিংবা উলটো পথে বাইক চালালে জেল-জরিমানার নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ করা দরকার। এ কাজে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা অবশ্যই নেওয়া উচিত। প্রতিটি মোটরবাইকে জিপিএস ও সেন্সর যুক্ত ডিজিটাল ডিভাইস থাকতে পারে, যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাইকের গতি, নিরাপদ দূরত্ব, ডানে-বামে যাওয়ার প্রবণতা রোধসহ যাবতীয় তথ্য সংগৃহীত হবে। কোনোরকম অসংগতি পরিলক্ষিত হলেই মেসেজ চলে যাবে ট্রাফিক পুলিশের কাছে, সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নেবেন। গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর দেশে পাঁচ লাখ নতুন মোটরবাইক যোগ হচ্ছে সড়কে। ফলে বাইক বিপণন করে কোম্পানিগুলো আয় করছে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা অথচ বাইক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। তাই আর কালবিলম্ব নয়, সময় এসেছে মোটরবাইকের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মনীতি ও ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের। মোটরবাইককে কোনো দেশের গণপরিবহণ হিসাবে গণ্য করা যায় না, তবুও এটি যেহেতু রুটি-রোজগারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে, তাই বাইকের জন্য আলাদা লেন করা, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো, গণপরিবহণ উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেলকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। যাত্রী-ড্রাইভার-পথচারী সবাই বিদ্যমান ট্রাফিক আইন মেনে চললে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যু অনেকাংশে কমে আসবে।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মোটরবাইক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম