|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকের লেখার শিরোনামটি ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়ার লেখা একটা গানের প্রথম লাইন। সুখেন্দু চক্রবর্তী গানটি প্রথম গেয়েছিলেন। এ লাইনটি একটি বহুলপ্রচলিত প্রবাদও বটে। এর অর্থ একজনের কষ্টার্জিত সম্পদ অন্যজনের ভোগের জন্য ব্যবহার হওয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে সাধারণ মানুষ নিজেদের শ্রম, সম্পদ, অর্থ তুলে দিয়েছে বিশেষ একশ্রেণির মানুষের হাতে। ক্রমাগত বেড়েছে আয়বৈষম্য। একশ্রেণির মানুষ যেখানে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে, কিন্তু পরিবারের জন্য দুবেলা ভাত নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে আরেকটি শ্রেণি কেবল শাসকগোষ্ঠীর মদদে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। গত ১৫ বছরে এ বৈষম্য এতটাই বেড়েছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশ ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ থেকে ‘বিপজ্জনক আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে। ওয়েলথ এক্স-এর তথ্য অনুযায়ী, সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে গত দশকে যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। অতি ধনী (১০ লাখ থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদের মালিক) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। অথচ এ একই সময়ে দেশে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। বেড়েছে জিডিপি, মাথপিছু আয়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আয়বৈষম্য। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি এবং একশ্রেণির মানুষের ধনী থেকে অতিধনী হয়ে ওঠার মহোৎসব। স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে কালোটাকার দৌরাত্ম্য আর বিদেশে টাকা পাচারের পরিমাণ। পরিণামে প্রতিনিয়ত কমছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। একই সঙ্গে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। নিত্যপণ্যের দামও এখন অতিদরিদ্র ও দরিদ্র তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে। বাঘডাশার খাবার জোটাতে তাই হাঁসের নাভিশ্বাস উঠছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ। ডলারের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। আমদানি দায় পরিশোধে সহায়তার জন্য প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে শুধু চলতি বছরের এ কয়েক মাসে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার কমে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব প্রকাশ করে, তাতে রিজার্ভ থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ এবং বাংলাদেশ বিমান, সোনালী ব্যাংক ও পায়রা বন্দরকে দেওয়া অর্থও রিজার্ভ হিসাবে দেখানো হয়। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো রিজার্ভ থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। সে বিবেচনায় বর্তমানে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা আশঙ্কাজনক। এদিকে রিজার্ভ কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করছে। কারণ, বিক্রি না করলে ডলারের দর আরও বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেড়ে যাবে। আবার রিজার্ভ এভাবে কমতে থাকলে আপৎকালীন সুরক্ষার জায়গা দুর্বল হবে। গত চার মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। রিজার্ভের উন্নতি না হলে টাকার দরপতন আরও বাড়বে এবং একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জোগান দেয় মূলত রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ সংশ্লিষ্ট পণ্যের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়। সেক্ষেত্রে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। এক কোটির বেশি প্রবাসী বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে থাকা স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠায়। অথচ বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সব জায়গায় এ প্রবাসীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করা হয়। বিদেশে যেতে এ মানুষদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ, তা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমের হিসাবে কুয়েত যেতে ভারতের একজন অভিবাসী ব্যক্তির গড়ে এক লাখ টাকার মতো লাগে। আর বাংলাদেশে লাগে আড়াই লাখ টাকার বেশি। দেশভেদে এ খরচ ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা হয়, যা প্রকৃত খরচের ৪ থেকে ৬ গুণ। এ অর্থ যাচ্ছে মূলত সরকারের মদদপুষ্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পকেটে। তাছাড়া এ অভিবাসন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের বিস্তর অভিযোগ আছে, যা এ খাতের একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাগ্য অন্বেষণে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই ভিটেমাটি বিক্রি করে এসব সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
তৈরি পোশাকসহ আমদানি-রপ্তানিনির্ভর শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কখনোই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রায়ই বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয় মজুরির জন্য। অথচ এসব শ্রমিকের হাড়ভাঙা খাটুনির ওপর ভর করেই রাষ্ট্র বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে এবং শিল্পোদ্যোক্তারা কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন।
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ২০১৫ থেকে ২০২০-ছয় বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০১৫ সালে এক বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়েছিল প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে এ পাচার আরও বেড়েছে। গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের নামে জমা টাকার পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, বছরের পর বছর নিয়মিতভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হলেও তা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে পাচারকৃত অবৈধ অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে সরকার ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে। বলা বাহুল্য, সরকারি ঘোষণার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতেই এলাকাভেদে প্রতিদিন গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ঢাকার বাইরে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। এতে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কৃষিজমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অর্থ সংকটের কারণে বর্তমানে ডিজেল, এলএনজিসহ প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না সরকার। অথচ বেসরকারি পর্যায়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন এবং দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ীকে ব্যাপক আয়ের পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। গত তিন বছরেই দেওয়া হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এ সংকটের মধ্যেও সম্প্রতি চারটি কুইক রেন্টাল প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, ব্যাংকিং সেক্টর, শেয়ারবাজার এবং উন্নয়ন প্রকল্পের লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ছে জনগণের ঘাড়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে কেবল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। থামানো যাচ্ছে না সরকারি কর্মকর্তাদের নানা অজুহাতে বিদেশ ভ্রমণ, ঘুস, দুর্নীতি ও স্বজনতোষণ। এসবের মধ্যে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ড্যারন এসেমগলু এবং জেমস রবিনসন তাদের বিখ্যাত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘হোয়াই নেশনস ফেইলে’ দেখিয়েছেন কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক (জনগণের) অর্থনীতি একটি রাষ্ট্রকে সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী করে। অন্যদিকে নিষ্কাশনমূলক (জনগণের ওপর বোঝা চাপিয়ে একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়া) অর্থনীতি একটি রাষ্ট্রকে দেউলিয়াত্বের দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতিকে কোনোভাবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক বলা যায় না। এ কারণেই সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক সংকট প্রতিনিয়ত তীব্র হচ্ছে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
সাকিব আনোয়ার : অ্যাক্টিভিস্ট, প্রাবন্ধিক
mnsaqeeb@gmail.com
