Logo
Logo
×

বাতায়ন

শোকের নদী বিত্তিপাড়া

Icon

বশীর আহমেদ

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কুষ্টিয়া জেলা সদরের অনতিদূরে জাতীয় মহাসড়কের পাশে পুরোনো বাসস্টপেজ ও বাজার বিত্তিপাড়া। একসময় কেবল স্থানীয় মানুষের চাহিদানির্ভর বিত্তিপাড়া সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখন বহুমাত্রিক জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র। সাপ্তাহিক হাটবারে এলাকায় উৎপাদিত হরেকরকম কৃষিপণ্যের বিকিকিনিতে সরগরম হয় বাজারটি। আধুনিক জীবনের সব ধরনের উপকরণ জোগান দেওয়ার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বিত্তিপাড়ায়।

৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। হাতেগোনা কয়েকটি মুদিদোকান আর ঝুপড়ি ঘরের চা স্টলগুলো অনিয়মিত খদ্দের নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। তখন বাজারসংলগ্ন কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়ক ছিল খুবই সংকীর্ণ; সিমেন্টের স্লাব ঢালাই একচিলতে রাস্তা। যানবাহনের আনাগোনাও ছিল সীমিত। ওই সময় মানুষের আয়-রোজগারও ছিল অল্প; দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যাই ছিল অগণতি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনারা তাদের এদেশীয় সহযোগীসহ বিত্তিপাড়ায় গড়ে তোলে গুরুত্বপূর্ণ টর্চার ক্যাম্প। বাজারের ইউনিয়ন পরিষদ অফিসটি হয়ে ওঠে শত্রুসেনাদের কৌশলগত সামরিক বিবর। সেই সেনাছাউনির চৌহদ্দি ঘিরে শত রোমহষর্ক নৃশংসতা, হৃদয় মোচড়ানো কত আর্তনাদ যে নিঃশব্দে আজও গুমরে কাঁদে, তার খতিয়ান আলোয় এসেছে সামান্যই। বিত্তিপাড়ার গণকবরে শায়িত শত মানুষের ক্ষয়িষ্ণু করোটিগুলো যেন মুক্তিযুদ্ধের অব্যক্ত উপাখ্যান হয়ে মাটিচাপা পড়ে আছে। ওই হতভাগ্যরা যেন আজও অভিযোগে-অভিশাপে বিদ্ধ করছে অকৃতজ্ঞ স্বজনদের।

একাত্তরে বিত্তিপাড়ার পাকিস্তানি সেনাছাউনিটি ছিল এ এলাকার জীবন্ত বিভীষিকা, গণহত্যাযজ্ঞের অন্যতম বধ্যভূমি। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ সংযোগের কেন্দ্র হওয়ায় কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া অতিক্রমকারী যানবাহন থামিয়ে হতভাগ্য নারী-পুরুষদের নামিয়ে নেওয়া হতো। ক্যাম্পে নিয়ে চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন; হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখা হতো আশপাশে। কখনোবা ফেলে দেওয়া হতো পুকুর অথবা ডোবা নালায়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বিত্তিপাড়ায় চলেছে নির্বিচার গণহত্যাযজ্ঞ, যার প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ অসম্ভব।

এ বাজারে সড়কের পাশে চা দোকানের পসরা সাজিয়েছেন প্রবীণ দোকানি আবজাল হোসেন। সড়ক বিভগের উচ্ছেদ আতঙ্কে কাস্টমারদের বসার জন্য লাগিয়েছেন অস্থায়ী ছোট্ট বাঁশের মাচান। চা দিতে বলে অতঃপর এখানকার গণকবর সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি অবাক চোখে তাকালেন। পরে চা বানানোর সঙ্গে স্বাভাবিক হলেন একসময়। কাজের ফাঁকে জানালেন, বিত্তিপাড়া বাজার এবং এর আশপাশের পুরো এলাকাই বলতে গেলে গণকবর। স্বাধীনতার পর এখানে একটি-দুটি করে বাড়িঘর তৈরি হতে থাকে। যেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে, সেখান থেকেই উঠে এসেছে মানুষের হাড়গোড়, মাথার খুলি, পচে যাওয়া নানা ধরনের উপকরণ। বিত্তিপাড়া বাজারের গণহত্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সবার জবাব প্রায় একই।

আবজাল জানান, এখানকার সবচেয়ে বড় গণকবর-যেখানে শত শত মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল-তা ২-৩ বছর আগেও ঝোপঝাড় হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন কেউ খোঁজখবর না করায় গত কয়েক বছর থেকে সেখানে চাষবাস হচ্ছে। আবজালের মতে, ওই জায়গা খোঁড়া হলে কী পরিমাণ কঙ্কাল উঠবে তা আল্লাহই মালুম। এখানে একটি প্রায় শতবর্ষী গভীর পুকুর রয়েছে; যেখানে এখনো কেউ ভয়ে মাছ ধরতে উৎসাহী হন না। কারণ, একাত্তরে অগণতি মানুষ হত্যার পর ফেলে দেওয়া হতো ওই পুকুরে।

বিত্তিপাড়া বাজারের প্রবীণ বাসিন্দা সবদুল ইসলাম জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে তাদের পৈতৃক বাড়ি সংস্কার করতে মাটি খুঁড়লে ২০-২৫টি মাথার খুলি, হাড়গোড় উঠে এসেছিল। তিনি বলেন, খুলির সঙ্গে লেগে থাকা দাঁতগুলো ছিল একেবারে অবিকৃত ও ঝকঝকে। এ থেকে ধারণা হয়, ওগুলো সবই ছিল তরুণ-যুবকদের কঙ্কাল। সবদুল আরও বলেন, বছর সতেরো আগে একইভাবে তাদের বসতবাড়ি থেকে আরও বেশ কয়েকটি মাথার খুলি, হাড়গোড় উঠে এসেছিল।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে কথা হয় বিত্তিপাড়ার পরিবহণ মালিক মশিয়ার রহমান, সাংবাদিক রাজ্জাক মাহমুদ রাজসহ আরও অনেকের সঙ্গে। তাদের সবার স্মৃতিচারণা প্রায় একই। রাজ ও মশিয়ার বলেন, ‘বাপ-দাদা এবং গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে একাত্তরের ভয়ংকর দিনগুলোর কথা শুনেছি। বিত্তিপাড়ায় মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের বর্ণনা শুনে শিউরে উঠেছি। প্রতিরাতে দলবেঁধে হতভাগ্য মানুষদের মারতে মারতে নেওয়া হতো আশপাশের ডোবা-নালা, জলাশয় এবং হত্যা করার নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে। মানুষের করুণ কান্না আর মরণচিৎকার শোনা যেত বহুদূর থেকেও।’

‘কত নিষ্ঠুরভাবে যে মানুষ হত্যা করা হতো; গুলি করে, গলা কেটে, পেট ফেঁড়ে, গলায় রশি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে, আধামরা জীবন্তদের মাটিচাপা দিয়ে; নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক, বয়স্ক-বাছবিচারহীনভাবে। পরে মাটিচাপা দেওয়ার জায়গাও আর বাজারের আশপাশে ছিল না, অনেক লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে এখানকার পুরোনো এক পুকুরেও।’

রাজ বলেন, ‘পুরো বিত্তিপাড়া বাজারটাই যেন এক সুবৃহৎ গণকবর। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেকদিন পরও নানা স্থানে শিয়াল-কুকুর মাটি খুঁড়ে মানুষের হাড়গোড়, কঙ্কাল মুখে নিয়ে টানাটানি করেছে।’

একাত্তরে লন্ডনে গঠিত বাংলাদেশ ফান্ডের প্রধান উদ্যোক্তা-ট্রেজারার, ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ একাত্তরের গণহত্যার পরিধি খতিয়ে দেখতে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। জানা যায়, কুষ্টিয়ার তৎকালীন এমপি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সহায়তায় স্টোনহাউজ বিত্তিপাড়া বধ্যভূমি থেকে প্রায় দুই পিকআপ ভর্তি নরকঙ্কাল সংগ্রহ করেছিলেন। এ ঘটনা বিত্তিপাড়ায় পাকিস্তানি নরপশুদের বাছবিচারহীন গণহত্যাযজ্ঞ ও বীভৎসতার অকাট্য প্রমাণ বহন করে।

বিত্তিপাড়ার শহিদদের স্মরণে ২০১২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুষ্টিয়া জেলা ইউনিট কমান্ড একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখন প্রায় সবাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ফলে ইচ্ছা থাকলেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও নজরদারি না থাকায় তা ক্রমেই বিনষ্টের পথে। লোহার রেলিংগুলো খুলে নিচ্ছে ছিঁচকে চোরের দল। আশপাশের মানুষ গরু-ছাগল বেঁধে রাখেন স্মৃতিসৌধের পিলারে। এখন ভেজা কাপড় শুকাতেও এটা ব্যবহার করেন কেউ কেউ।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে কুষ্টিয়া তথা দক্ষিণবঙ্গের এত বড় একটি বধ্যভূমি ও গণকবর স্থান পায়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বধ্যভূমি বা গণকবরের তালিকায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নিয়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অতীতে একাধিকবার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সুধীজন অনেক দাবি জানিয়েছেন। এমনকি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেও এ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বের নীরব সাক্ষী বিত্তিপাড়ার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যেটুকু হয়েছে তা যৎসামান্য বললে বোধকরি খুব অল্পই বলা হবে।

একাত্তরে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর নির্মমতা প্রত্যক্ষকারীদের কাছ থেকে নিজের কানে শোনা বিত্তিপাড়ার শোকার্ত জনতা এবং কুষ্টিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি-গণহত্যার নিদর্শনাদি এখনো যা রয়েছে তা উপযুক্ত মর্যাদায় সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ের বধ্যভূমি ও গণকবরের তালিকায় কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়ার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হোক। একই সঙ্গে এখানকার বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানগুলো সংরক্ষণসহ অজ্ঞাত শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমপ্লেক্স নির্মাণে উদ্যোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি।

বশীর আহমেদ : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম