Logo
Logo
×

বাতায়ন

মেট্রোরেল স্মার্ট যুগে প্রবেশের প্রথম ধাপ

Icon

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মেট্রোরেল স্মার্ট যুগে প্রবেশের প্রথম ধাপ

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি ও তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারই বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতিফলন হলো আজকের মেট্রোরেল। বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু করার জন্য সরকার ‘ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্পের ধারণা নিয়ে কাজ করছিল। অবশেষে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, ‘ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের জন্য মোট ৫টি রুট লাইন প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এমআরটি লাইন ১, ২, ৪, ৫ ও ৬। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে ‘দ্য ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট সার্ভে (ডিএইচইউটিএস-১)’ মূল্যায়ন করা হয় এবং ‘এমআরটি লাইন-৬’ নামে মেট্রোরেলের জন্য প্রথম এমআরটি রুট নির্বাচন করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় আনুমানিক ২.৮২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে জাইকা ০.০১ শতাংশ সুদে প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ২.১৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করছে। বাকি ২৫ শতাংশ তহবিল দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুন ২০১৬ সালে এর নির্মাণকাজের সূচনা করেন। প্রাথমিকভাবে, ‘এমআরটি লাইন ৬’-এর দৈর্ঘ্য ২০.১ কিলোমিটার হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছিল, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, যা পরে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ফলে রুটটির দৈর্ঘ্য আরও ১.১৬ কিলোমিটার বৃদ্ধি পায়। এটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ২১.২৬ কিলোমিটার। এ রুটে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে এবং এতে ২৪ সেট ট্রেন চলবে। ২৯ আগস্ট ২০২১-এ, প্রথম ট্রায়াল রান দিয়াবাড়ী থেকে উত্তরা পর্যন্ত পরিচালিত হয়। মেট্রোরেল উত্তরা-আগারগাঁও রুটে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোরেলে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন প্রায় ৯ লাখ ৬০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলেও বাংলাদেশ প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে। মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। তা ছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি : এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার দুই প্রান্তের যোগাযোগ সহজ হবে, যা সড়ক পথে চাপ কমাবে। ফলে ঢাকার অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহণ সহজ হবে; পাশাপাশি সাশ্রয় হবে মানুষের কর্মঘণ্টা।

আবাসন সমস্যার সমাধান : মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষ বাসা ভাড়া বাবদ অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারবে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, এ প্রকল্পের সব রুটের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী মানুষ এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রাজধানীতে যাতায়াত করতে পারবে।

পরিবেশ দূষণ হ্রাস : ঢাকার রাস্তায় চলমান বহু যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা পরিবেশ দূষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এ ছাড়া ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের উদ্যোগ চলছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রয়েছে। বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল রাজধানীর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ওপর চাপ কমিয়ে পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি : মেট্রোরেল প্রকল্পে দেশের প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রকৌশলীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। মেট্রোরেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর লোকবলের প্রয়োজন হবে, যা দেশে অনেক কাজের সুযোগ তৈরি করবে। ইউএনবির মতে, প্রতিটি মেট্রোরেল স্টেশনে একটি অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, লাউঞ্জ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট, প্রার্থনার স্থান, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, এসকেলেটর, লিফট এবং আরও অনেক কিছু থাকবে। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নতুন কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া, স্টেশনগুলোর আশপাশের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য একদল কর্মীর প্রয়োজন হবে। এসব নতুন কর্মসংস্থান আর্থিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করবে এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।

মেট্রোরেলের কারণে ট্রানজিট ব্যবস্থা বাড়বে এবং স্টেশনগুলোর আশপাশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। এছাড়া উন্নত পরিবহণ পরিকাঠামোর কারণে নতুন সংস্থাগুলো বিকাশের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে বর্তমান বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল হবে। সামগ্রিকভাবে এসব কর্মকাণ্ড জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

পিক আওয়ারে বাস না পাওয়া, অতিরিক্ত ভিড়, অল্প ব্যবধান, বাস কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার ইত্যাদি কারণে ঢাকা শহরে মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। এক সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিল বাসের বিকল্প। কিন্তু এখন আর যাত্রীরা সিএনজিচালিত অটোরিকশার ওপর ভরসা রাখতে পারে না।

ঢাকাবাসীর যাতায়াতের একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হবে মেট্রোরেল। এতে রয়েছে আধুনিক নানা রকম সুবিধা। প্রতি ৪ মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন যাতায়াত করবে। তা ছাড়া, বিদ্যমান গণপরিবহণ ব্যবহারে নারীরা প্রায়ই হয়রানির সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে পিক টাইমে দীর্ঘ অপেক্ষা, নানাভাবে হয়রানি, আসন স্বল্পতা, নিরাপদে বাসে ওঠা বা নামা এবং উপযুক্ত পরিবহণ খোঁজা। এসব কারণে নারীরা বিদ্যমান পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করছে। সুতরাং, তারা মেট্রোরেলে ভ্রমণে আরও আগ্রহী হবে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে।

মেট্রোরেল আমাদের দেশের মানুষকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগের সঙ্গে পরিচিত করাবে। উন্নত দেশগুলোয় মেট্রোরেল এবং অন্যান্য গণপরিবহণকে একত্র করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ শুধু একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে এ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে। এটি দেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

এ ছাড়া শব্দ, শক এবং কম্পন কমাতে মেট্রোরেলে ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম [এমএসএস] প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। শব্দদূষণ রোধে কংক্রিটের পাশে দেওয়ালও করা হবে। এ প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর মেট্রোরেলের প্রভাব কমাবে।

কাজেই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল সেই স্বপ্নের প্রকল্প যে প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে এবং আমি মনে করি মেট্রোরেল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রথম ধাপ। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ভবিষ্যতে উন্নত দেশের মর্যাদা পাবে, যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সে সময় বেশি দূরেও নয়। সেই সোনালি ভবিষ্যতের উন্নত মহানগর ঢাকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মেট্রোরেল আজ বাস্তব।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

 

মেট্রোরেল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম