চেতনায় বুদ্বুদ

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আমার পরামর্শ

 বদিউর রহমান 
২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আদার ব্যাপারীর আবার জাহাজের খবর-এ পুরোনো কথাটাই আবার আমার মনে এলো নিজের একটা ভাবনা নিয়েই। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন-এ ভাবনা তো একমাত্র শেখ হাসিনার। অবশ্যই তিনি একটা প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেবেন। নেবেন এজন্য যে, তিনি তো ইনশাল্লাহ আবার পরের মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, অতএব পরের মেয়াদের রাষ্ট্রপতির পদের মানুষটাও অবশ্যই তার শুধু পছন্দের হলেই চলবে না, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ধ্যানধারণাও অবশ্যই সম্মানের চোখে দেখবেন। সংবিধান অনুযায়ী এখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বলা চলে একেবারেই সীমিত। কেবল প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য সব কাজই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে করতে হয়। আবার প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিলেন বা আদৌ কোনো পরামর্শ দিলেন কি না, তাও কোনো আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না। কেউ যদি রাষ্ট্রপতির পদের কাজকে রসালোভাবে কেবল কবর জিয়ারত আর মিলাদের মধ্যে সীমিতও করেন, তারপরও তিনিও ওই পদে থেকেই কিন্তু একথা বলেন। রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তির সম্মান তারই। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে মহামান্য বলার স্বীকৃতি না থাকলেও একজন জ্ঞানী রাষ্ট্রপতি এ মহামান্য সম্বোধন অপছন্দ করে উঠিয়ে দিতে চাইলেও রাষ্ট্রপতিকে আমরা সম্মান দেখানোর জন্য মহামান্য বলে থাকি। মহাযুক্ত অনেক শব্দই কিন্তু প্রকৃত মহা হয় না, যেমন মহাজোট, মহাবিদ্যালয়, মহাবিপদ, মহাযন্ত্রণা, মহাকাল প্রভৃতি। কিন্তু আলংকারিক পদ হলেও আমাদের রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক দলসহ সবাই ইজ্জতের সঙ্গেই মহামান্য বলে। পদকে ইজ্জত করলেও বড় কোনো নেতাও এ পদধারী তার অপছন্দের হলে তাকে নামের বিকৃত উচ্চারণে হেয় করে থাকেন-এটা যিনি করে থাকেন সেটা তার রুচি-অভিরুচির পরিচায়ক। এতে পদের গুরুত্ব কমে না। আর তাই যে কোনো অবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদটি আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীক। তাই আমরা এ পদে একজন ভালো মানুষ চাই।

আমি কোনো দল করি না, কিন্তু আমারও তো পছন্দের একটি দল আছে। যে দল আমার পছন্দের, সেই দলের সমালোচনা করার অধিকারও আমার অবশ্যই আছে। আমি যার ভালো চাই, তার মন্দ কাজের সমালোচনা করে তাকে সুপরামর্শ দেওয়াও আমার কর্তব্য মনে করি। অন্ধ বা গোঁড়া সমর্থক হওয়া এক কথা, আর বিচার-বিবেচনায় সঠিক সমালোচনা করা আরেক কথা। রবীন্দ্রনাথের এ কথাটা আমার বেশ ভালো লাগে-শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে গো। অতএব আমরা প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের সমালোচনাও করব, আবার ভোট দেওয়ার সময়ে সঠিক বিবেচনাও রাখব। আমরা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর বাকশাল করার সমালোচনা করেছি। বঙ্গবন্ধুর আবার রাষ্ট্রপতি হওয়া পছন্দ করিনি, কিন্তু তাই বলে আমরা কখনো জাতির পিতাকে সামান্যতম অশ্রদ্ধা করি না। কারণ তিনি দেশ দিয়েছেন, আমাদের জাতিসত্তা দিয়েছেন, বিশ্বে আমাদের মর্যাদাপূর্ণ ঠিকানা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলেন না, কারণ তিনি নিখাদ দেশপ্রেমিক। তার নেতৃত্বে দেশের যে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন, তা তার ঘোর শত্রুরাও প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি মাঝেমধ্যে এমন সব কাজ করে ফেলেন, যা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। চামড়া তুলে নেওয়ার স্লোগানধারীকেও তিনি উচ্চাসনে নিয়ে আসেন, ট্যাংকে নাচনেওয়ালাকেও তিনি মহীয়ান করে দেন, বিনে পয়সায় তিনি নৌকাও ভাড়া দিয়ে দেন অন্যদের, আবার মোশতাকের শপথ পরিচালনাকারীকে তিনি সম্মানের পদে বসান। হতে পারে, হয়তো তিনি বিষ খেয়ে বিষও হজম করতে পারেন বলেই রাজনৈতিক কৌশলে ম্যাকিয়াভেলি হয়ে তিনি এসব করে থাকেন। অথবা তিনি হয়তো ভেবে থাকেন যে ডাকাতও তো পরে বড় আউলিয়া হয়ে গেছেন। এমনও হয়তো তার ভাবনা হতে পারে যে, তার সংস্পর্শে এরাও আবার মানুষ হবে। তিনি যা ভালো মনে করে থাকেন করবেন, তিনি উপযুক্ত মনে করলে সন্ত্রাসের গডফাদারকেও হয়তো লালন করবেন, সময়-সুযোগে তিনি হয়তো কাউকে ধরবেন, দেখাবেন তিনি ছাড় দেন না। এই-ই যখন অবস্থা, তখন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পছন্দেও তার পছন্দই হবে শেষ কথা। তারপরও আমরা তো নিজের পরামর্শ দিতে পারি, মতামত ব্যক্ত করতে পারি। বিবেচনা করা-না-করা তার অভিপ্রায়। পরমতসহিষ্ণুতাকে সম্মান করেই বলতে চাই, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পছন্দে তিনি যেন বেশ সতর্ক থাকেন।

আমি নিজে যৎসামান্য আমলাগিরি করেছি। গভীর আগ্রহ নিয়ে আমি আমলা-চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে থাকি। এ আমলা নিয়ে আমার কঠোর মনোভাব রয়েছে। এদের বেশির ভাগই রুটিন চাকরি করায় অভ্যস্থ। এর বেশির ভাগই নিজের স্বার্থ ছাড়া তেমন বেশি কিছু ভাবতে আগ্রহী নয়। একটু ক্ষমতার জন্য, একটু লোভে এরা অতীত-উপকার ভুলতে দ্বিধা করে না। তখন ওরা হরেকরকম অজুহাত দেখায়। নিজের অপারগতার সমর্থনে অনেক যুক্তির জন্ম দেয়। অতএব এই শ্রেণির কাউকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতির পদে বিবেচনা করতে চাইলে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই হাজারও বার ভাবতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে তাকে অবশ্যই সাবধানি পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনীতিকরাও যে গাদ্দার হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিকদের পোস্টমর্টেম করলেই তা খোলাসা হয়ে যায়। তারপরও বিশ্বস্ত রাজনীতিকের সন্ধান নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে। তিনি যেহেতু সবার খোঁজখবর রাখেন, সেহেতু এখন তো তার আর মানুষ চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। এক-এগারোর পরবর্তী সময়ে তার দলেরই কারা নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে STAR হতে চেয়েছিলেন এবং পরে তিনি তা উলটিয়ে কীভাবে STAR-কে RATS করে দিয়েছিলেন, তা তো আমাদের জানা আছে।

আমার মনে হয়, এবার রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে তিনি তার সুদীর্ঘ দলীয় রাজনীতিই শুধু বিবেচনায় নেবেন না; তিনি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনীতিও গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন। নারীর ক্ষমতায়নে এবার তিনি আরেকটা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন। তার সঙ্গী-সাথিদের মধ্য থেকেই তিনি রাষ্ট্রপতি বাছাই করবেন-এটা আমরা চাই। তবে অবশ্যই রাজনীতিকদের মধ্যে পরীক্ষিতজনদের মধ্য থেকেই। আমি এবার সরাসরি আমার পরামর্শটাই প্রকাশ করে ফেলি। আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন অনেক রাজনীতিকের চরিত্র আমি দেখেছি। ‘কিছু রাজনীতি, কিছু বাজনীতি’ বইয়ে কিছু লিখেছিও। ফলে পর্যবেক্ষণ থেকেই আমার পরামর্শ-তিনি বর্তমান স্পিকারকে রাষ্ট্রপতি করুণ, আর বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকে স্পিকার পদে বিবেচনা করতে পারেন। ফলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার আগামী মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বও একটা ভালো টিমের সমন্বয়ে পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রের ১নং পদে নারী, ২নং পদে নারী, ৩নং পদে নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী, সরকারদলীয় উপনেতা নারী-রসালোভাবে কেউ বেগম রোকেয়ার নারীস্থান বলুক বা না-বলুক, আমরা বিশ্বে একটা নতুন মর্যাদায় আসীন হতে পারব। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিলের আগেও কিন্তু আমি সরাসরি নাম বলেই আমার মতামত প্রকাশ করেছিলাম।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন