সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন তিনি
jugantor
স্মরণ
সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন তিনি

  হালিম আজাদ  

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণমুখী রাজনীতির অনুসারী এবং জাতির প্রয়োজনে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সত্যনিষ্ঠ কাণ্ডারি ছিলেন আলী আহম্মদ চুনকা। তার রাজনীতির ক্ষেত্র ছিল যদিও প্রাচ্যের ডাণ্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ; কিন্তু অকুতোভয় এবং সাধারণ মানুষের সাহসী রাজনীতির ধারক হিসাবে তিনি সারা দেশের রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এ কারণে তার কথা মানুষ মনে রেখেছে, তিনি না থাকলেও তাকে আদর্শবাদী রাজনীতির অনুসারী হিসাবে শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত করেছে শুধু নারায়ণগঞ্জেরই নয়, সমগ্র দেশের রাজনৈতিক কর্মীরা। বাঙালি জাতি যেসব কীর্তিমান সন্তানকে নিয়ে গর্ব করতে পারে, আলী আহাম্মদ চুনকা তাদের অন্যতম। সব্যসাচী ঘরানার এ কর্মবীর মানুষটি জীবনের প্রতিটি কাজে রেখেছেন অসাধারণ অবদান। জীবনের প্রথম দিকেই তিনি রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ঢাকার কাছের নগরী হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের কাজ।

১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। তার রাজনীতির মূল অঙ্গন ছিল আওয়ামী লীগের আদর্শ ও ভাবধারা। নারায়ণগঞ্জের শিল্প, বন্দর, শিল্প-কারখানা, খেটে খাওয়া শ্রমিক, দিনমজুর, অল্প আয়ের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আন্দোলন-সংগ্রামে যেমন অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার আদর্শের রাজনীতির ঝান্ডা আজীবন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছিলেন তিনি।

তার জন্ম শিল্প, বন্দর ও বাণিজ্যনগরী নারায়ণগঞ্জে ১৯৩৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি কৃষক পরিবারে। মেধাবী ও সাহসী চুনকা খুব অল্প বয়স থেকেই সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। ছাত্র জীবনেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য রাজপথের সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক আদর্শ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজ-সরল সম্পর্কের কারণে খুব সহজেই তিনি নিজ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রিয়জন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। নিজ এলাকা নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন সাহসী কর্মী হিসাবে তার রাজনীতিতে আগমন।

রাজনীতিতে তার পদচারণার শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য ও সাহস তার জন্য পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি সেই আদর্শের কাণ্ডারি হিসাবেই জীবন কাটিয়েছেন। সাধারণ মানুষের হয়ে কাজ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজ এলাকায় দরিদ্র, অসহায়, গরিব, দুঃখী মানুষের জন্য কাজ করে ভালোবাসা অর্জন করেন। রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করার পর নিজ শহর ও জেলার জনগণ তাকে অন্তরে ঠাঁই দিয়ে আন্তরিকভাব তার রাজনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার এ সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাত্রজীবন থেকেই।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি এলাকার যুবক, তরুণ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। তার নেতৃত্বে শহরের থানার অস্ত্রাগার লুট হয় এবং এসব অস্ত্র ২৫ মার্চ থেকে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের কাজে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের সময় তিনি ভারতে গিয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন অরাজকতা বন্ধ করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৩ ও ১৯৭৭ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন তিনি পৌরসভায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। জনপ্রতিনিধি হিসাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগকে চুনকা ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণে চুনকা হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা। দৈনন্দিন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অবহেলিত মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলনে থেকেছেন সদাব্যস্ত। কাজের ব্যাপারে আন্তরিক ও সুশাসক হওয়ার কারণে এলাকার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন খুবই প্রিয়জন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে প্রত্যহ জনসেবায় তিনি নজিরবিহীন অবদান রাখেন। সত্য ও ন্যায়ের বিষয়ে নিজকে আজীবন অবিচল রাখার কারণে হয়ে ওঠেন এলাকায় যোগ্য ‘বিচারক’।

এলাকার সামাজিক বিচার সভায় তার সুনাম ছিল অভাবনীয়। এ কারণে জনগণের ছিল তার প্রতি অসীম বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তিনি কাজেকর্মে ছিলেন দুঃসাহসী। দিনের অধিকাংশ সময় নিজ দলের এবং সমাজের নানাবিধ কাজেই সময় অতিবাহিত করতেন। তার কাজের কোনো সীমা ছিল না। আর রাজনীতির পরিসরে সব দলের, সব পরিসরের মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। পুরো জীবনই তিনি সমাজের বিচিত্রধর্মী কাজে অতিবাহিত করে এলাকার জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু আলী আহম্মদ চুনকা আত্মগোপন করেননি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রকাশ্যে রাজপথে প্রতিবাদী অনুষ্ঠানমালা পরিচালনায় কাজ করেন। একপর্যায়ে তাকেও জেলে যেতে হয়। কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীদের সাহস দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে জাতির পিতার হত্যার বিচারের দাবি জানানোর কাজে সহায়তা করেন। তিনি আজীবন সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মীদের সহায়তা করতেন বিভিন্নভাবে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যক্তি ছিলেন আলী আহমেদ চুনকা। সব ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। মানুষ ও মানবতাই ছিল তার মূল কাজ ও ধর্ম। প্রায় সাড়ে চার দশক তিনি রাজনীতি, বিভিন্ন সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান এবং সামাজিক জীবনে কাজ করে অনন্য এক মহীরুহে পরিণত হন। কিন্তু তার মাঝে ছিল না কোনো অহংকার। ছিল না কোনো চাওয়া। কাজের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। সে কারণেই জীবিত চুনকার চেয়ে প্রয়াত চুনকা অনেক বেশি গৌরবের আসনে সিক্ত হয়ে আছেন। ১৯৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।

তার কন্যা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পিতাকে নিয়ে লেখা ‘বাবা, তুমি আমার অহংকার’ শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বাবার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি চলমান যেকোনো ঘটনাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আলাদাভাবে চিন্তা করতেন এবং সেই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেছেন। পৌরসভার প্রথম পাঁচ বছরের সাফল্য তাকে দ্বিতীয় দফা ১৯৭৭ সালে আবার বিজয়ী করল। তিনি রাজনীতিতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন।

১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী ঘরানার এবং তার বিশিষ্ট বন্ধু খাজা মহিউদ্দিন ও খোকা মহিউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নির্বাচন করলেন।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাদের মধ্যে যে জয়ী হয়ে আসবে, সেই আমার লোক।’ বাবা অনেক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বঙ্গবন্ধু বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি জানতাম চুনকা তুই জয়ী হবি, আমার কালো মানিক আয় আমার বুকে আয়। এভাবে বাবাকে আলিঙ্গন করলেন বঙ্গবন্ধু।’ এটা আলী আহম্মদ চুনকার প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই আলী আহম্মদ চুনকার মূল্যায়ন করা সম্ভব।

হালিম আজাদ : কবি ও সাংবাদিক

স্মরণ

সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন তিনি

 হালিম আজাদ 
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণমুখী রাজনীতির অনুসারী এবং জাতির প্রয়োজনে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সত্যনিষ্ঠ কাণ্ডারি ছিলেন আলী আহম্মদ চুনকা। তার রাজনীতির ক্ষেত্র ছিল যদিও প্রাচ্যের ডাণ্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ; কিন্তু অকুতোভয় এবং সাধারণ মানুষের সাহসী রাজনীতির ধারক হিসাবে তিনি সারা দেশের রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এ কারণে তার কথা মানুষ মনে রেখেছে, তিনি না থাকলেও তাকে আদর্শবাদী রাজনীতির অনুসারী হিসাবে শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত করেছে শুধু নারায়ণগঞ্জেরই নয়, সমগ্র দেশের রাজনৈতিক কর্মীরা। বাঙালি জাতি যেসব কীর্তিমান সন্তানকে নিয়ে গর্ব করতে পারে, আলী আহাম্মদ চুনকা তাদের অন্যতম। সব্যসাচী ঘরানার এ কর্মবীর মানুষটি জীবনের প্রতিটি কাজে রেখেছেন অসাধারণ অবদান। জীবনের প্রথম দিকেই তিনি রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ঢাকার কাছের নগরী হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের কাজ।

১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। তার রাজনীতির মূল অঙ্গন ছিল আওয়ামী লীগের আদর্শ ও ভাবধারা। নারায়ণগঞ্জের শিল্প, বন্দর, শিল্প-কারখানা, খেটে খাওয়া শ্রমিক, দিনমজুর, অল্প আয়ের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আন্দোলন-সংগ্রামে যেমন অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার আদর্শের রাজনীতির ঝান্ডা আজীবন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছিলেন তিনি।

তার জন্ম শিল্প, বন্দর ও বাণিজ্যনগরী নারায়ণগঞ্জে ১৯৩৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি কৃষক পরিবারে। মেধাবী ও সাহসী চুনকা খুব অল্প বয়স থেকেই সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। ছাত্র জীবনেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য রাজপথের সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক আদর্শ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজ-সরল সম্পর্কের কারণে খুব সহজেই তিনি নিজ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রিয়জন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। নিজ এলাকা নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন সাহসী কর্মী হিসাবে তার রাজনীতিতে আগমন।

রাজনীতিতে তার পদচারণার শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য ও সাহস তার জন্য পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি সেই আদর্শের কাণ্ডারি হিসাবেই জীবন কাটিয়েছেন। সাধারণ মানুষের হয়ে কাজ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজ এলাকায় দরিদ্র, অসহায়, গরিব, দুঃখী মানুষের জন্য কাজ করে ভালোবাসা অর্জন করেন। রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করার পর নিজ শহর ও জেলার জনগণ তাকে অন্তরে ঠাঁই দিয়ে আন্তরিকভাব তার রাজনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার এ সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাত্রজীবন থেকেই।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি এলাকার যুবক, তরুণ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। তার নেতৃত্বে শহরের থানার অস্ত্রাগার লুট হয় এবং এসব অস্ত্র ২৫ মার্চ থেকে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের কাজে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের সময় তিনি ভারতে গিয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন অরাজকতা বন্ধ করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৩ ও ১৯৭৭ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন তিনি পৌরসভায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। জনপ্রতিনিধি হিসাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগকে চুনকা ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণে চুনকা হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা। দৈনন্দিন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অবহেলিত মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলনে থেকেছেন সদাব্যস্ত। কাজের ব্যাপারে আন্তরিক ও সুশাসক হওয়ার কারণে এলাকার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন খুবই প্রিয়জন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে প্রত্যহ জনসেবায় তিনি নজিরবিহীন অবদান রাখেন। সত্য ও ন্যায়ের বিষয়ে নিজকে আজীবন অবিচল রাখার কারণে হয়ে ওঠেন এলাকায় যোগ্য ‘বিচারক’।

এলাকার সামাজিক বিচার সভায় তার সুনাম ছিল অভাবনীয়। এ কারণে জনগণের ছিল তার প্রতি অসীম বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তিনি কাজেকর্মে ছিলেন দুঃসাহসী। দিনের অধিকাংশ সময় নিজ দলের এবং সমাজের নানাবিধ কাজেই সময় অতিবাহিত করতেন। তার কাজের কোনো সীমা ছিল না। আর রাজনীতির পরিসরে সব দলের, সব পরিসরের মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। পুরো জীবনই তিনি সমাজের বিচিত্রধর্মী কাজে অতিবাহিত করে এলাকার জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু আলী আহম্মদ চুনকা আত্মগোপন করেননি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রকাশ্যে রাজপথে প্রতিবাদী অনুষ্ঠানমালা পরিচালনায় কাজ করেন। একপর্যায়ে তাকেও জেলে যেতে হয়। কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীদের সাহস দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে জাতির পিতার হত্যার বিচারের দাবি জানানোর কাজে সহায়তা করেন। তিনি আজীবন সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মীদের সহায়তা করতেন বিভিন্নভাবে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যক্তি ছিলেন আলী আহমেদ চুনকা। সব ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। মানুষ ও মানবতাই ছিল তার মূল কাজ ও ধর্ম। প্রায় সাড়ে চার দশক তিনি রাজনীতি, বিভিন্ন সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান এবং সামাজিক জীবনে কাজ করে অনন্য এক মহীরুহে পরিণত হন। কিন্তু তার মাঝে ছিল না কোনো অহংকার। ছিল না কোনো চাওয়া। কাজের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। সে কারণেই জীবিত চুনকার চেয়ে প্রয়াত চুনকা অনেক বেশি গৌরবের আসনে সিক্ত হয়ে আছেন। ১৯৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।

তার কন্যা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পিতাকে নিয়ে লেখা ‘বাবা, তুমি আমার অহংকার’ শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বাবার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি চলমান যেকোনো ঘটনাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আলাদাভাবে চিন্তা করতেন এবং সেই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেছেন। পৌরসভার প্রথম পাঁচ বছরের সাফল্য তাকে দ্বিতীয় দফা ১৯৭৭ সালে আবার বিজয়ী করল। তিনি রাজনীতিতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন।

১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী ঘরানার এবং তার বিশিষ্ট বন্ধু খাজা মহিউদ্দিন ও খোকা মহিউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নির্বাচন করলেন।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাদের মধ্যে যে জয়ী হয়ে আসবে, সেই আমার লোক।’ বাবা অনেক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বঙ্গবন্ধু বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি জানতাম চুনকা তুই জয়ী হবি, আমার কালো মানিক আয় আমার বুকে আয়। এভাবে বাবাকে আলিঙ্গন করলেন বঙ্গবন্ধু।’ এটা আলী আহম্মদ চুনকার প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই আলী আহম্মদ চুনকার মূল্যায়ন করা সম্ভব।

হালিম আজাদ : কবি ও সাংবাদিক

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন