ফাল্গুনে যায়নি দেখা বসন্তের সেই রূপ
jugantor
ফাল্গুনে যায়নি দেখা বসন্তের সেই রূপ

  ড. এমএ মাননান  

১৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

১৪২৯-এর ফাল্গুন বিদায় নিল। চিরাচরিত নিয়মে ফাল্গুন আসে বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে। এবারও এসেছিল তেমনভাবেই। তবে বাংলার বসন্তপ্রিয় মানুষ কি আবাহন করতে পেরেছে বসন্তকে আগের মতো? পারেনি অনেকেই।

যারা এ ঋতুটিকে পহেলা ফাল্গুনে উদযাপন করেছে, তারাও কি তা করতে পেরেছে আনন্দচিত্তে? সাধারণভাবে সবার কাছে ধরা দেয়নি এবার বসন্ত আগের রূপে।

বসন্ত বাসন্তী হয়ে উঠতে পারেনি অনেকের হৃদয়ে। আগের মতো মৃদুমন্দ দখিনা সমীরণ উতলা করতে পারেনি বাঙালি হৃদয়, যে হৃদয় সারা বছর অপেক্ষায় থাকত বসন্তের আগমনের জন্য, কোকিলের সুমধুর কহু কুহু ডাক শোনার জন্য, চারদিকে প্রস্ফুটিত ফুলের কুঞ্জ দেখার জন্য, পুষ্পে পুষ্পে মঞ্জুরিত বাগানে চিরসুখী চঞ্চল প্রজাপতির ডানা ছড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে প্রফুল্ল চিত্তের নাচন দেখে নয়ন জুড়ানোর জন্য।

এ হৃদয় আর এখন আগের মতো ফাল্গুনের আগমনে উদাস হয় না, ভালোবাসার ছন্দে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে না বসন্তকে। ফাল্গুন আর বসন্ত একাকার হয়ে যায় না।

বসন্ত লুকিয়ে থাকে ধুলায় ভরা বৃক্ষের আড়ালে, ধূসরিত ফুলের বাগানের পেছনে, ধুলায়-দূষণে নাকাল প্রকৃতির দুঃখভরা নিশ্বাসের অন্তরালে।

এখন আর দূষণে দূষণে সিক্ত-অবসাদের শহরে, গাছপালাবিহীন সবুজহারা নগরে শোনা যায় না কোকিলের কুহুতান, কারও অন্তরে অনুরণিত হয়ে ওঠে না কোনো রাখালের মনকাড়া বাঁশির পাগলপারা সুর।

শহুরে নাগরিকদের বিবর্ণ শহরে ফাল্গুন লাগে না বনে বনে, ফুলে ফুলে পাতায় পাতায়। গানে গানে মেতে ওঠে না আগের মতো গাছপাখি; সৃষ্টি হয় না কারও দৃষ্টিতে আর আগের মতো গোলাপ ফুল। গানে গানে উদাস হয় না নিখিল, রঙে রঙে রঙিন হয় না ধোঁয়াশা আকাশ।

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে নগরকন্যারা এলোমেলো ধুলাময় বাতাসে উড়ায় না শাড়ির আঁচল, বসন্ত আসে না দুই চোখে মেখে দিতে ভালোবাসার কাজল। পোড়খাওয়া মানুষদের কণ্ঠে ঝংকৃত হয় না ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’

আগের মতো গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে না ‘বসন্ত এসে গেছে বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা’ কিংবা ‘পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়, রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।’ মন হয় না আপনহারা; হয় না বাঁধনছেঁড়া। ফাগুনের আবির মেখে প্রকৃতি দেয় না ধরা আপনরূপে।

ফাল্গুন কি শুধুই ধুলায় মলিন? তার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে জনজীবনের প্রতিটি পরত। আক্রায় বিবর্ণ-বিধ্বস্ত জনজীবন। ঝটিতে হানা দেওয়া করোনা মহামারির ছোবলের বিষ হজম করে উঠতে না উঠতেই সারা বিশ্বের সব দেশ ছোবলে পড়েছে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের,

অস্ত্রবিক্রেতা আর হিংসা চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় নামা গডফাদারদের। তাদের কারসাজিতে লেগে যাওয়া যুদ্ধের জাঁতাকলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বুকে বসে গেছে এক ভয়ংকর জগদ্দল পাথর, যে পাথরের চাপে পিষ্ট অর্থনীতি, ক্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য, সংকুচিত শিক্ষা, আড়ষ্ট সবকিছু। চারদিকে সংকট আর সংকট-জ্বালানি সংকট, উৎপাদন সংকট, মুদ্রাস্ফীতি সংকট, আয়-রুজির সংকট, আর এসবের ফলে তীব্র খাদ্য সংকট।

সংকটের আবর্তে বন্দিজীবন। নগরজীবনে আছে আরও বাড়তি সংকট। ঢাকাসহ ছোট-বড় সব কয়টি শহরে গিজগিজ করছে মানুষ। বেড়েছে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের তীব্রতা। বেশিরভাগ শহরে নেই কোনো সুপরিকল্পিত রাস্তা। ‘গ্যাসবোমার’ ওপর বসে থাকা রাজধানী শহর এখন ‘খ্যাত’ হয়ে গেছে বিস্ফোরণের শহর হিসাবে। রিকশার শহর হিসাবে আগের খ্যাতি তো একটুও কমেনি।

শুধু দূষণেই ঢাকা এক নম্বরে নয়, নোংরা-ময়লা-দুর্গন্ধেও সম্ভবত শীর্ষে। গণপরিবহণের অরাজক পরিস্থিতিও বহু পুরোনো। বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিতভাবে দালানকোঠা নির্মাণের দিক থেকে ঢাকা কত নম্বরে, সে তথ্য না থাকলেও খুব যে ভালো অবস্থানে নেই তা সহজেই অনুমেয়। কোনো রাস্তায় যদি একবার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়, সেখানে চলে ধুলাবালির তাণ্ডব। এ তাণ্ডব চলতেই থাকে, দেখার কেউ নেই।

পণ্যমূল্য প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণ নেই কোথাও। পরিষেবার দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, বরং সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন। প্রায় সর্বত্র সিন্ডিকেট, সংঘবদ্ধ-দলবদ্ধ প্রতারণা। বাটপার, জালিয়াত চক্রের অরণ্য এখন রাজধানী শহর। চারদিকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।

সব সংকটের মূলেও মানুষ। দিন দিন সোনার হরিণ হয়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। অথচ মানুষের আয়ের গতি ছুটছে পেছনে আর ব্যয়ের গতি ছুটছে সর্পিল গতিতে সামনের দিকে। মানুষের কাছে পৃথিবীটা হয়ে যাচ্ছে গদ্যময়। ঝলসানো রুটির মতো মনে হয় না পূর্ণিমার চাঁদটাকে; ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা আকাশ ভেদ করে চাঁদটাকে মনে হয় ফ্যাকাসে রুটির চিলতে।

এত কিছুর মধ্যে গভীর মন্দার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া মানুষ কীভাবে কোথায় খুঁজে পাবে ফাল্গুন হাওয়ায় ভর করে আসা বসন্তকে? বসন্তই বা কীভাবে সৌরভ ছড়াবে এমনতরো নুয়েপড়া অন্তরের মানুষের কাছে? যাদের চোখে নিত্য জলোচ্ছ্বাস, কীভাবে বসন্তের আগমনে উদ্বেলিত হবে তাদের উচ্ছ্বাস? নগরবাসীরা এখন পলাশের মাসে ধুলায় আর প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণায় ভরা মলয় বাতাসে ছাড়ে শুধুই দীর্ঘশ্বাস।

এরা চায়ের সঙ্গে ধুলা খায়, নাসারন্ধ্রে বিষ টানে, ফুসফুসে বিষ ছড়ায়। তাই ফাল্গুনের রঙিন বিহুর নেশা তাদের নিতে পারে না কোনো খোয়াবের আকাশে। প্রজাপতির রংবেরং ডানা নগরবাসীর আকাশ-চাওয়া চোখে মেখে দিতে পারে না রঙিন স্বপ্ন। নিত্য ক্ষয়ে যেতে থাকা হৃদয়ে ‘অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে’ না। ধরা দেয় না বসন্ত তার বাসন্তী রং নিয়ে।

প্রকৃতি আমাদের দিয়েছে অনেক, নিয়ে যায়নি কিছুই। আমরাই প্রকৃতির শ্যামল-সবুজ গায়ে লোভের ছোবল মেরেছি, গাছপালা উজাড় করে ইট-পাথরের দেওয়াল তুলেছি, রাঙামাটির চরণে বর্জ্যরে নহর বইয়ে দিয়ে ড্রেনগুলোর চলার গতি স্তব্ধ করে দিয়েছি, ফুটপাতে পসরা সাজিয়েছি, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খুঁেড় গর্ত বানিয়েছি,

রাস্তার মাটিকে ধুলারূপ দিয়ে ফাল্গুনের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছি, যত্রতত্র পলিথিন ফেলে নগর-পরিবেশকে ছিন্নভিন্ন করেছি, এককালের তিলোত্তমা বুড়িগঙ্গাকে কালোত্তমা করে ছেড়েছি, তুরাগকে নদীখেকো অজগরদের গ্রাস বানিয়েছি, আর হাট-বাজারকে বেপরোয়া যৌতুকলোভীদের মতো অযৌক্তিক মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছি।

এসবের মধ্য দিয়ে আমরা বসন্তকে অরণ্যের দিকে তাড়িয়ে দিয়েছি-যেখানে ফাল্গুন আছে, ফাল্গুন থাকবে তার মলয় বাতাস নিয়ে, ধারণ করবে বাসন্তীকে আনন্দ-শিহরণে।

নগরবাসীর হৃদয় তো এখন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শীত বোঝে না, তাপ বোঝে না। শরীর-মন এখন সবকিছু সয়ে সয়ে নির্বাক হয়ে আছে। জন্ম থেকে পাওয়া সবাক জীবন এখন অ-বাক চলচ্চিত্র।

তবুও মন স্বপ্ন দেখে। নিষ্ফল জেনেও আবেদন করে, নিবেদন করে এবং প্রত্যাশা করে। আশা করে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যারা জনমানুষের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সুমতি হবে, প্রশাসন জনতান্ত্রিক হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমাদের পুরোনো দিন ফিরে আসবে।

আকাশ ধোঁয়াশা কাটিয়ে শুভ্রোজ্জ্বল হবে, কাশবনে সাদারা লুটোপুটি খেলবে, প্রাণবন্ত কন্যারা আবার জেগে উঠবে, প্রাণবন্ত হবে, হলুদ মুকুট খোঁপায় লাগিয়ে বাসন্তী সাজে ঘুরে বেড়াবে। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে হাতে গোলাপ নিয়ে তরুণরা অপেক্ষায় থাকবে প্রিয়জনের আগমনের আশায়।

সবাই কোলাহলমুখরিত প্রশান্ত মন নিয়ে আলিঙ্গন করতে পারব চিরসবুজ বসন্তকে।

করোনা আর যুদ্ধের দামামার মধ্যেও আমরা কম পাইনি কিছু। পাইনি শুধু বসন্তে নেচে ওঠার স্বপ্নসুখ। একদিন পাব বসন্তকে আপন করে, যদি আমরা দেশের ৯৫ শতাংশ সম্পদ ৫ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধার বিন্দাচল হয়ে অটল দাঁড়াতে পারি,

সম্পদের সুষম বণ্টনের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো নির্মূল করতে পারি, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় স্ফীত হওয়া কর্তাব্যক্তিদের দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করিয়ে নিতে পারি, রাস্তায় রাস্তায় কাজের নামে খানাখন্দ তৈরি করে মাসের পর মাস ফেলে রাখার বাজিকরদের মুখ থুবড়ে দিতে পারি,

পরিবেশ নষ্টকারক পণ্য উৎপাদন বন্ধ করতে পারি, গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে সুস্থ-সবল করতে পারি, নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে আর মুখে মাস্ক পরে দমবন্ধ অবস্থায় রাস্তায় চলার ব্যাপারটিকে সেকেলে করে দিতে পারি, শহরের বেদখল হয়ে যাওয়া খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে জনগণের জন্য আবার সচল করে দিতে পারি,

রাস্তাঘাট-পার্ক-বাগানগুলোকে ধুলামুক্ত করতে পারি আর নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি।

যদি পারি, আবারও বলছি যদি পারি, তাহলে হয়তো আগামী কোনো এক ফাল্গুনে আবারও বসন্তের দেখা পাব। বাসন্তী রঙে সেজে আগুনঝরা ফাগুনে আমাদের প্রজন্ম গেয়ে উঠবে : ‘ফাগুন এসেছে বনে বনে, ফাগুন এসেছে নয়নে নয়নে, বসন্ত বাজাইছে বাঁশি কোকিলের কুহুতানে।’

ড. এম এ মাননান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

ফাল্গুনে যায়নি দেখা বসন্তের সেই রূপ

 ড. এমএ মাননান 
১৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

১৪২৯-এর ফাল্গুন বিদায় নিল। চিরাচরিত নিয়মে ফাল্গুন আসে বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে। এবারও এসেছিল তেমনভাবেই। তবে বাংলার বসন্তপ্রিয় মানুষ কি আবাহন করতে পেরেছে বসন্তকে আগের মতো? পারেনি অনেকেই।

যারা এ ঋতুটিকে পহেলা ফাল্গুনে উদযাপন করেছে, তারাও কি তা করতে পেরেছে আনন্দচিত্তে? সাধারণভাবে সবার কাছে ধরা দেয়নি এবার বসন্ত আগের রূপে।

বসন্ত বাসন্তী হয়ে উঠতে পারেনি অনেকের হৃদয়ে। আগের মতো মৃদুমন্দ দখিনা সমীরণ উতলা করতে পারেনি বাঙালি হৃদয়, যে হৃদয় সারা বছর অপেক্ষায় থাকত বসন্তের আগমনের জন্য, কোকিলের সুমধুর কহু কুহু ডাক শোনার জন্য, চারদিকে প্রস্ফুটিত ফুলের কুঞ্জ দেখার জন্য, পুষ্পে পুষ্পে মঞ্জুরিত বাগানে চিরসুখী চঞ্চল প্রজাপতির ডানা ছড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে প্রফুল্ল চিত্তের নাচন দেখে নয়ন জুড়ানোর জন্য।

এ হৃদয় আর এখন আগের মতো ফাল্গুনের আগমনে উদাস হয় না, ভালোবাসার ছন্দে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে না বসন্তকে। ফাল্গুন আর বসন্ত একাকার হয়ে যায় না।

বসন্ত লুকিয়ে থাকে ধুলায় ভরা বৃক্ষের আড়ালে, ধূসরিত ফুলের বাগানের পেছনে, ধুলায়-দূষণে নাকাল প্রকৃতির দুঃখভরা নিশ্বাসের অন্তরালে।

এখন আর দূষণে দূষণে সিক্ত-অবসাদের শহরে, গাছপালাবিহীন সবুজহারা নগরে শোনা যায় না কোকিলের কুহুতান, কারও অন্তরে অনুরণিত হয়ে ওঠে না কোনো রাখালের মনকাড়া বাঁশির পাগলপারা সুর।

শহুরে নাগরিকদের বিবর্ণ শহরে ফাল্গুন লাগে না বনে বনে, ফুলে ফুলে পাতায় পাতায়। গানে গানে মেতে ওঠে না আগের মতো গাছপাখি; সৃষ্টি হয় না কারও দৃষ্টিতে আর আগের মতো গোলাপ ফুল। গানে গানে উদাস হয় না নিখিল, রঙে রঙে রঙিন হয় না ধোঁয়াশা আকাশ।

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে নগরকন্যারা এলোমেলো ধুলাময় বাতাসে উড়ায় না শাড়ির আঁচল, বসন্ত আসে না দুই চোখে মেখে দিতে ভালোবাসার কাজল। পোড়খাওয়া মানুষদের কণ্ঠে ঝংকৃত হয় না ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’

আগের মতো গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে না ‘বসন্ত এসে গেছে বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা’ কিংবা ‘পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়, রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।’ মন হয় না আপনহারা; হয় না বাঁধনছেঁড়া। ফাগুনের আবির মেখে প্রকৃতি দেয় না ধরা আপনরূপে।

ফাল্গুন কি শুধুই ধুলায় মলিন? তার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে জনজীবনের প্রতিটি পরত। আক্রায় বিবর্ণ-বিধ্বস্ত জনজীবন। ঝটিতে হানা দেওয়া করোনা মহামারির ছোবলের বিষ হজম করে উঠতে না উঠতেই সারা বিশ্বের সব দেশ ছোবলে পড়েছে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের,

অস্ত্রবিক্রেতা আর হিংসা চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় নামা গডফাদারদের। তাদের কারসাজিতে লেগে যাওয়া যুদ্ধের জাঁতাকলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বুকে বসে গেছে এক ভয়ংকর জগদ্দল পাথর, যে পাথরের চাপে পিষ্ট অর্থনীতি, ক্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য, সংকুচিত শিক্ষা, আড়ষ্ট সবকিছু। চারদিকে সংকট আর সংকট-জ্বালানি সংকট, উৎপাদন সংকট, মুদ্রাস্ফীতি সংকট, আয়-রুজির সংকট, আর এসবের ফলে তীব্র খাদ্য সংকট।

সংকটের আবর্তে বন্দিজীবন। নগরজীবনে আছে আরও বাড়তি সংকট। ঢাকাসহ ছোট-বড় সব কয়টি শহরে গিজগিজ করছে মানুষ। বেড়েছে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের তীব্রতা। বেশিরভাগ শহরে নেই কোনো সুপরিকল্পিত রাস্তা। ‘গ্যাসবোমার’ ওপর বসে থাকা রাজধানী শহর এখন ‘খ্যাত’ হয়ে গেছে বিস্ফোরণের শহর হিসাবে। রিকশার শহর হিসাবে আগের খ্যাতি তো একটুও কমেনি।

শুধু দূষণেই ঢাকা এক নম্বরে নয়, নোংরা-ময়লা-দুর্গন্ধেও সম্ভবত শীর্ষে। গণপরিবহণের অরাজক পরিস্থিতিও বহু পুরোনো। বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিতভাবে দালানকোঠা নির্মাণের দিক থেকে ঢাকা কত নম্বরে, সে তথ্য না থাকলেও খুব যে ভালো অবস্থানে নেই তা সহজেই অনুমেয়। কোনো রাস্তায় যদি একবার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়, সেখানে চলে ধুলাবালির তাণ্ডব। এ তাণ্ডব চলতেই থাকে, দেখার কেউ নেই।

পণ্যমূল্য প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণ নেই কোথাও। পরিষেবার দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, বরং সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন। প্রায় সর্বত্র সিন্ডিকেট, সংঘবদ্ধ-দলবদ্ধ প্রতারণা। বাটপার, জালিয়াত চক্রের অরণ্য এখন রাজধানী শহর। চারদিকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।

সব সংকটের মূলেও মানুষ। দিন দিন সোনার হরিণ হয়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। অথচ মানুষের আয়ের গতি ছুটছে পেছনে আর ব্যয়ের গতি ছুটছে সর্পিল গতিতে সামনের দিকে। মানুষের কাছে পৃথিবীটা হয়ে যাচ্ছে গদ্যময়। ঝলসানো রুটির মতো মনে হয় না পূর্ণিমার চাঁদটাকে; ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা আকাশ ভেদ করে চাঁদটাকে মনে হয় ফ্যাকাসে রুটির চিলতে।

এত কিছুর মধ্যে গভীর মন্দার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া মানুষ কীভাবে কোথায় খুঁজে পাবে ফাল্গুন হাওয়ায় ভর করে আসা বসন্তকে? বসন্তই বা কীভাবে সৌরভ ছড়াবে এমনতরো নুয়েপড়া অন্তরের মানুষের কাছে? যাদের চোখে নিত্য জলোচ্ছ্বাস, কীভাবে বসন্তের আগমনে উদ্বেলিত হবে তাদের উচ্ছ্বাস? নগরবাসীরা এখন পলাশের মাসে ধুলায় আর প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণায় ভরা মলয় বাতাসে ছাড়ে শুধুই দীর্ঘশ্বাস।

এরা চায়ের সঙ্গে ধুলা খায়, নাসারন্ধ্রে বিষ টানে, ফুসফুসে বিষ ছড়ায়। তাই ফাল্গুনের রঙিন বিহুর নেশা তাদের নিতে পারে না কোনো খোয়াবের আকাশে। প্রজাপতির রংবেরং ডানা নগরবাসীর আকাশ-চাওয়া চোখে মেখে দিতে পারে না রঙিন স্বপ্ন। নিত্য ক্ষয়ে যেতে থাকা হৃদয়ে ‘অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে’ না। ধরা দেয় না বসন্ত তার বাসন্তী রং নিয়ে।

প্রকৃতি আমাদের দিয়েছে অনেক, নিয়ে যায়নি কিছুই। আমরাই প্রকৃতির শ্যামল-সবুজ গায়ে লোভের ছোবল মেরেছি, গাছপালা উজাড় করে ইট-পাথরের দেওয়াল তুলেছি, রাঙামাটির চরণে বর্জ্যরে নহর বইয়ে দিয়ে ড্রেনগুলোর চলার গতি স্তব্ধ করে দিয়েছি, ফুটপাতে পসরা সাজিয়েছি, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খুঁেড় গর্ত বানিয়েছি,

রাস্তার মাটিকে ধুলারূপ দিয়ে ফাল্গুনের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছি, যত্রতত্র পলিথিন ফেলে নগর-পরিবেশকে ছিন্নভিন্ন করেছি, এককালের তিলোত্তমা বুড়িগঙ্গাকে কালোত্তমা করে ছেড়েছি, তুরাগকে নদীখেকো অজগরদের গ্রাস বানিয়েছি, আর হাট-বাজারকে বেপরোয়া যৌতুকলোভীদের মতো অযৌক্তিক মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছি।

এসবের মধ্য দিয়ে আমরা বসন্তকে অরণ্যের দিকে তাড়িয়ে দিয়েছি-যেখানে ফাল্গুন আছে, ফাল্গুন থাকবে তার মলয় বাতাস নিয়ে, ধারণ করবে বাসন্তীকে আনন্দ-শিহরণে।

নগরবাসীর হৃদয় তো এখন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শীত বোঝে না, তাপ বোঝে না। শরীর-মন এখন সবকিছু সয়ে সয়ে নির্বাক হয়ে আছে। জন্ম থেকে পাওয়া সবাক জীবন এখন অ-বাক চলচ্চিত্র।

তবুও মন স্বপ্ন দেখে। নিষ্ফল জেনেও আবেদন করে, নিবেদন করে এবং প্রত্যাশা করে। আশা করে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যারা জনমানুষের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সুমতি হবে, প্রশাসন জনতান্ত্রিক হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমাদের পুরোনো দিন ফিরে আসবে।

আকাশ ধোঁয়াশা কাটিয়ে শুভ্রোজ্জ্বল হবে, কাশবনে সাদারা লুটোপুটি খেলবে, প্রাণবন্ত কন্যারা আবার জেগে উঠবে, প্রাণবন্ত হবে, হলুদ মুকুট খোঁপায় লাগিয়ে বাসন্তী সাজে ঘুরে বেড়াবে। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে হাতে গোলাপ নিয়ে তরুণরা অপেক্ষায় থাকবে প্রিয়জনের আগমনের আশায়।

সবাই কোলাহলমুখরিত প্রশান্ত মন নিয়ে আলিঙ্গন করতে পারব চিরসবুজ বসন্তকে।

করোনা আর যুদ্ধের দামামার মধ্যেও আমরা কম পাইনি কিছু। পাইনি শুধু বসন্তে নেচে ওঠার স্বপ্নসুখ। একদিন পাব বসন্তকে আপন করে, যদি আমরা দেশের ৯৫ শতাংশ সম্পদ ৫ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধার বিন্দাচল হয়ে অটল দাঁড়াতে পারি,

সম্পদের সুষম বণ্টনের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো নির্মূল করতে পারি, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় স্ফীত হওয়া কর্তাব্যক্তিদের দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করিয়ে নিতে পারি, রাস্তায় রাস্তায় কাজের নামে খানাখন্দ তৈরি করে মাসের পর মাস ফেলে রাখার বাজিকরদের মুখ থুবড়ে দিতে পারি,

পরিবেশ নষ্টকারক পণ্য উৎপাদন বন্ধ করতে পারি, গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে সুস্থ-সবল করতে পারি, নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে আর মুখে মাস্ক পরে দমবন্ধ অবস্থায় রাস্তায় চলার ব্যাপারটিকে সেকেলে করে দিতে পারি, শহরের বেদখল হয়ে যাওয়া খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে জনগণের জন্য আবার সচল করে দিতে পারি,

রাস্তাঘাট-পার্ক-বাগানগুলোকে ধুলামুক্ত করতে পারি আর নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি।

যদি পারি, আবারও বলছি যদি পারি, তাহলে হয়তো আগামী কোনো এক ফাল্গুনে আবারও বসন্তের দেখা পাব। বাসন্তী রঙে সেজে আগুনঝরা ফাগুনে আমাদের প্রজন্ম গেয়ে উঠবে : ‘ফাগুন এসেছে বনে বনে, ফাগুন এসেছে নয়নে নয়নে, বসন্ত বাজাইছে বাঁশি কোকিলের কুহুতানে।’

ড. এম এ মাননান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন