সোমেন চন্দ আজও প্রাসঙ্গিক
jugantor
সোমেন চন্দ আজও প্রাসঙ্গিক

  ড. আতিউর রহমান  

১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষাংশে এ ভূখণ্ডে সাম্যবাদী রাজনীতির আলোচনায় যে নামটি বিশেষভাবে উল্লিখিত হয় তা সোমেন চন্দ।

মাত্র ২২ বছর বয়সে ৮ মার্চ ১৯৪২-এ ফ্যাসিস্টদের আঘাতে মৃত্যু হয় এই শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক এবং সাম্যবাদী সাহিত্যিকের।

উদার ও সাম্যবাদী কর্ম ও লেখাই কাল হয়েছিল সোমেন চন্দের জন্য। এ লেখাটির তাড়না বিশেষভাবে অনুভব করেছি এবারের অমর একুশে বইমেলায় সোমেন চন্দ চর্চাকেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘শতবর্ষে সোমেন’ বইটি পাঠ করার পর। অকালে হারানো এ তরুণ বিপ্লবীর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত গ্রন্থটি দুই বাংলার ২৬ জন গুণী মানুষ তাকে নিয়ে যে লেখালেখি করেছেন, সেটির একটি সমৃদ্ধ ও সুসম্পাদিত সংকলন। বইটি পাঠ করার পর নতুন করে সোমেন চন্দকে অনুভব করতে পেরেছি বলে মনে হয়। আর সেই উপলব্ধিটুকু পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করার প্রয়াস হিসাবেই এ লেখা।

১৯৩০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সোমেন চন্দ কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করে, মার্কস ও লেনিনের পথনকশায় সাম্যবাদের পথে আগ্রহী ও ব্রতী হয়ে উঠেছিলেন। তখন তার ১৮-১৯ বছর বয়স। ঢাকার ছেলে। বাবা রেলের কর্মচারী। বয়স আর সামাজিক অবস্থানের বিচারে সোমেনের এহেন রাজনৈতিক আগ্রহ আমাদের মোটেও অবাক করে না। তবে সাম্যবাদী রাজনীতিতে আগ্রহী সে সময়কার অন্যসব প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের মধ্যেও তিনি ছিলেন আলাদা। সোমেনের এ অনন্যতার প্রধান কারণ তিনি শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে মেহনতি শ্রমিক শ্রেণির সংযোগ সাধনে নিয়োজিত হয়েছিলেন। আর এজন্য তার ‘পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজম’ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ভূমিকা রেখেছে তার সাহিত্যও।

সারা বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সেকালে সাম্যবাদ আর কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে মরিয়া ছিল। বিশেষত উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সাম্যবাদের পথে ধাবিত হওয়ার শঙ্কায় শাসক শ্রেণি সেসময় ভীষণ বিচলিত ছিল। এ ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক শাসকরা তাই কমিউনিস্ট পার্টি আর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ওপর ভীষণ খড়্গহস্ত হয়েছিল। নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। তারা ছিলেন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় রেল মজদুরদের সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সদ্যই কৈশোর পেরোনো তরুণ সোমেন চন্দ। বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে মজদুরদের সংযোগ রক্ষার এ মহতী দায়িত্ব তিনি খুবই কার্যকরভাবে পালন করেছিলেন ওই অল্প বয়সে। মেহনতি মানুষের এত কাছাকাছি ছিলেন বলে তার সাহিত্যে বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের মর্মবেদনা ও শ্রেণিচেতনা খুব প্রকট ও সহজবোধ্যভাবে হাজির হতে দেখি। একই সঙ্গে তার লেখার সাহিত্যগুণ ছিল সুরক্ষিত। মোটেও তা প্রচারণামূলক ছিল না। তাই তার লেখার আবেদন আজও পাঠকের কাছে সমান তালে টিকে আছে।

শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের প্রশ্নকে তিনি সাহিত্যের বিষয় হিসাবে এনেছেন। এভাবে উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে শ্রমিক প্রশ্ন, সাম্যবাদের প্রশ্নকে কেন্দ্রীয় বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আবার এটিও ঠিক যে, শ্রমিক রাজনীতির কর্মসূচিকে কেবল রাজপথের বা মাঠে-ময়দানের বিষয় হিসাবে না রেখে শিল্প-সাহিত্যকেও রাজনীতির অস্ত্রে/কৌশলে পরিণত করেছেন। বলা যায়, শ্রমিক নেতা সোমেন চন্দ এবং সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক, অর্থাৎ এখানে তার এ দুটি পরিচয় পরস্পরকে ‘রি-ইনফোর্স’ করেছে। একে অপরকে শক্তি জুগিয়েছে।

সমগ্র উপমহাদেশে যে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ সেকালে গণমুখী সাহিত্যচর্চার প্রসার ঘটাচ্ছিল, সোমেন ঢাকায় তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাজনৈতিক কর্মী ও লেখক-লেখিকাদের মধ্যে একটি সংযোগ সেতু হিসাবে এক অনন্য ভূমিকা সে সময় তিনি রেখেছিলেন। সেসময় যারা সোমেনের সহযোদ্ধা ছিলেন তারা সবাই কেবল বয়সে তরুণ ছিলেন তাই নয়, তাদের চিন্তাও ছিল যুগান্তকারী। ঔপনিবেশিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নিছক লেখালেখির সীমা অতিক্রম করে তারা সবাই তখন সমাজের সাম্যবাদী রূপান্তরের জন্য লিখতে শুরু করেন।

স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রগতিবাদী লেখালেখিতে যে ধারার উন্নতি সাধন করেছেন বলে আমরা জানি, তার শুরু কিন্তু হয়েছিল সোমেন চন্দের লেখালেখির ভেতর দিয়েই। আদতে ১৯৩০-এর দশকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা একটি ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক ‘এনলাইটেনমেন্টে’র সীমা অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যে তখন দরকার ছিল কিছু গণবৈপ্লবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার। সেখানেই সবাইকে পথ দেখিয়েছেন সোমেন চন্দ। কবিতার ক্ষেত্রে কাজটি করেছেন আরেক অকালে হারানো তরুণ বিপ্লবী সুকান্ত ভট্টাচার্য। এ প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন-‘প্রবীণ-প্রবীণারা যেখানে এসে অনেকে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন সাময়িকভাবে, সেখানে এই দুই বয়ঃকনিষ্ঠ শিল্পীর পদক্ষেপ অল্পবয়সি হওয়া সত্ত্বেও ছিল অসংশয়।’

স্বাধীনতা ও সাম্যবাদের আদর্শের পতাকাবাহী হিসাবে সোমেনের কাজকর্ম পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে যাদের উদ্বুদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে আছেন-মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সানাউল হক, কবীর চৌধুরী এবং সরদার ফজলুল করিম। এ প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিম ১৯৮২ সালে লিখেছেন-‘সোমেনের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায়ই হয়তো চুম্বকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল প্রগতি লেখক সংঘের অনুষ্ঠানে, আলোচনায়, ক্রিয়াকর্মে। আমার ভাগ্য যে, আমিও সে আহ্বানের বাইরে সেদিন থাকতে পারিনি।’

সোমেন তার পড়ালেখা, রাজনৈতিক কাজ, এবং সর্বোপরি আপসহীন জীবনাচরণ দিয়ে সেকালের তরুণদের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই একটি সময়োপযোগী উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র সরকার লিখেছেন-‘গোপন ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্রে’র প্রকাশ্য শাখা ছিল প্রগতি পাঠাগার। অবিলম্বেই সোমেন এ পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব পান। ... এ তরুণটির মধ্যে জেদ ও সংকল্পের দৃঢ়তা ছিল, ছিল জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও বহু-অধ্যয়নজনিত এক গভীর আত্মপ্রত্যয়। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯৪১ সালে। তখন এ সদস্যপদ খুব সহজলভ্য ছিল না।’ এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায় যে, ১৯৪২ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো যে ‘সোভিয়েত মেলা’ হয়েছিল, সেটিরও প্রধান আয়োজক কর্মী ছিলেন সোমেন চন্দই। এভাবেই লেখালেখির পাশাপাশি ‘করে দেখিয়ে’ সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সোমেন চন্দ।

ফ্যাসিবাদের নির্মম আঘাতে সোমেন চন্দকে অকালে হারিয়েছিল এ দেশ। যে বিপ্লবী পার্টির স্বপ্ন তিনি ও তার সহযোদ্ধারা দেখে গেছেন, সে রকম রাজনৈতিক শক্তিও খুব একটা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু সোমেনের সাহিত্য তো রয়ে গেছে। যে সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার চর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং বিপ্লবী রাজনৈতিক বার্তার বাহক। সোমেন সে কালে মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বেপথু করতে শাসক শ্রেণির যত রকম অপচেষ্টা সেগুলোকে প্রতিরোধ করাকে যেমন নিজের সাহিত্যের বিষয় করেছেন, তেমনি তার গল্পে-সাহিত্যে এসেছে প্রকৃত শ্রেণিচেতনার উন্মেষের জন্য জরুরি বিষয়গুলো। আলোচ্য বইটিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যে লেখাটি সংকলিত হয়েছে, সেখানে সোমেন চন্দের সাহিত্যের এ দিকগুলোর ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সহজপাঠ্য আর সংক্ষিপ্ত কলেবরের এ লেখাটি সোমেনের সাহিত্য সম্পর্কে আজকের তরুণদেরও আগ্রহী করে তুলতে পারে। সেই বিচারে সোমেন সাহিত্য আজও খুবই প্রাসঙ্গিক বলা যায়।

চল্লিশের দশকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক বড় সংকট হিসাবে হাজির হয়েছিল। সোমেনের গল্প ‘দাঙ্গা’তে সেই ভয়াবহতাকে দেখা হয়েছে একজন পরিবর্তনকামী শ্রেণিসচেতন তরুণ রাজনীতিকের চোখ দিয়ে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন, গল্পকার গল্পের প্রোটাগনিস্ট অশোককে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ‘হিন্দু সোশ্যালিস্ট’ ছোট ভাইয়ের উদ্দেশে বলাচ্ছেন-‘আজ বাদ কালের কথা মনে পড়ে, যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে? ... স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? প্যালেস্টাইনের কথা জানিস? জানিস আয়ারল্যান্ডের কথা, মূর্খ।’ একইভাবে সোমেন তার ‘ইঁদুর’ গল্পে দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, এ দেশের মেহনতির শত্রু হলো দারিদ্র্য। এ গল্পে নিুমধ্যবিত্তের ঘরে ইঁদুরের উৎপাত এসেছে পুঁজিবাদের রূপক হয়ে। যে পুঁজিবাদ মেহনতি মানুষকে কুরে কুরে খেয়ে শোষণ করে। সেই ইঁদুরের উৎপাত আজও বহাল আছে বিশ্বজুড়েই।

সোমেনের গল্প ‘সংকেত’ এক্ষেত্রে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ এখানে বিপ্লবের স্বার্থে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যের অপরিহার্যতার ওপর জোর দিতে দেখি সোমেন চন্দকে। পশ্চিমে কমিউনিস্ট আন্দোলন এ ভুখণ্ডের তরুণদের উৎসাহিত করেছিল ঠিকই। তবে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে বিপ্লবের জন্য যে শ্রমিকের পাশে কৃষককেও চাই, তা সোমেন বুঝে নিয়েছিলেন ওই অল্প বয়সেই। তাই ‘সংকেত’ গল্পে দেখিয়েছেন, শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মালিকপক্ষ গ্রামের কৃষিজীবীদের শ্রম কিনতে চাইছে অল্প দামে। গ্রামের ওই মানুষগুলো যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে আগে থেকেই পরাভূত আর নিরুপায়।

সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা আর সমকালীন বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল সাহিত্য আমাদের জন্য রেখে গেছেন বলে সোমেন চন্দ বহুকাল পরেও সাহিত্যিকদের, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যিকদের কাছে প্রিয় হয়ে থেকে গেছেন। যতীন সরকার তার ‘সোমেন চন্দের উত্তরাধক চাই’ শিরোনামের লেখায় এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এনেছেন সমকালে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। তরুণ কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র ভূমিকায় লিখেছেন-‘সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরই নিুমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুজীবন নামে তিনটি গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি।’

সোমেন চন্দ চর্চাকেন্দ্রের উদ্যোগে ‘শতবর্ষে সোমেন’ শিরোনামের এ গ্রন্থটির যিনি প্রধান কান্ডারি, সেই কামাল লোহানী আজ আমাদের মাঝে নেই। এ বইতে সোমেন চন্দকে নিয়ে তার একটি অসাধারণ লেখাও সংকলিত হয়েছে। সেখানে অকালে হারানো সোমেন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ভারত ভাগ হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে রাজনৈতিক বিরোধীদের হাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে রেলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তরুণ সাহিত্যিক ও শ্রমিক নেতা সোমেন চন্দ খুন হলেন নির্মমভাবে। তার ধীশক্তি, সংগঠন গড়ার মুনশিয়ানা, লেখায় প্রাসঙ্গিক বাস্তবকে উপস্থাপন করাই ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই লেখায় ঘুণে ধরা সমাজের ব্যবচ্ছেদ আছে, আছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ-কী করতে হবে তার কথা।’

সোমেনের রাজনীতি ও সাহিত্য ছিল মাটিঘেঁষা, জনসংশ্লিষ্ট। অল্প বয়সে খুন না হয়ে গেলে সোমেন এ ভূখণ্ডের রাজনীতি ও সমাজে যে ভূমিকা রাখতে পারতেন তা ‘স্পেকুলেট’ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। সোমেন নিয়ে অত গভীর কোনো জানাশোনা আমার নেই। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেয়েছি-অভাজন শ্রেণি থেকে উঠে আসা একজন মাটিঘেঁষা তরুণ রাজনীতিক যদি পরিণত বয়স পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পারেন, তাতে কী দারুণ পরিবর্তনই না সম্ভব! মানুষের মুক্তি ও সাম্যের যারা শত্রু, তারা বঙ্গবন্ধুকেও শারীরিকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সমাজতন্ত্র’ও আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন আমাদের সামনে আজও টিকে আছে। ঠিক যেমন আমাদের সামনে আছে সোমেন চন্দের স্বপ্নের প্রতিলিপি হিসাবে তার সাহিত্যগুলো।

আমাদের যারা স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সোমেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য-এ নিয়ে সন্দেহ নেই। আর এ সত্যও স্বীকার করতে হবে যে, আজকের দিনেও সামাজিক ন্যায়বিচার আর সাম্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে কিন্তু রয়েই গেছে। গণমুখী রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে খানিকটা। তবু মৌলবাদী বিভাজনের রাজনীতির অভিশাপও বিদ্যমান। ইদানীং তো তথাকথিত উন্নত বিশ্বেও এমন সংরক্ষণবাদী আর জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির আশঙ্কাজনক উত্থান দেখি। তাই সোমেনের চিন্তা আর তার দেখানো পথ এখনো একই রকম প্রাসঙ্গিক। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে সোমেন সাহিত্যচর্চার আহ্বান জানাই।

ড. আতিউর রহমান : অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

সোমেন চন্দ আজও প্রাসঙ্গিক

 ড. আতিউর রহমান 
১৬ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষাংশে এ ভূখণ্ডে সাম্যবাদী রাজনীতির আলোচনায় যে নামটি বিশেষভাবে উল্লিখিত হয় তা সোমেন চন্দ।

মাত্র ২২ বছর বয়সে ৮ মার্চ ১৯৪২-এ ফ্যাসিস্টদের আঘাতে মৃত্যু হয় এই শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক এবং সাম্যবাদী সাহিত্যিকের।

উদার ও সাম্যবাদী কর্ম ও লেখাই কাল হয়েছিল সোমেন চন্দের জন্য। এ লেখাটির তাড়না বিশেষভাবে অনুভব করেছি এবারের অমর একুশে বইমেলায় সোমেন চন্দ চর্চাকেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘শতবর্ষে সোমেন’ বইটি পাঠ করার পর। অকালে হারানো এ তরুণ বিপ্লবীর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত গ্রন্থটি দুই বাংলার ২৬ জন গুণী মানুষ তাকে নিয়ে যে লেখালেখি করেছেন, সেটির একটি সমৃদ্ধ ও সুসম্পাদিত সংকলন। বইটি পাঠ করার পর নতুন করে সোমেন চন্দকে অনুভব করতে পেরেছি বলে মনে হয়। আর সেই উপলব্ধিটুকু পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করার প্রয়াস হিসাবেই এ লেখা।

১৯৩০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সোমেন চন্দ কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করে, মার্কস ও লেনিনের পথনকশায় সাম্যবাদের পথে আগ্রহী ও ব্রতী হয়ে উঠেছিলেন। তখন তার ১৮-১৯ বছর বয়স। ঢাকার ছেলে। বাবা রেলের কর্মচারী। বয়স আর সামাজিক অবস্থানের বিচারে সোমেনের এহেন রাজনৈতিক আগ্রহ আমাদের মোটেও অবাক করে না। তবে সাম্যবাদী রাজনীতিতে আগ্রহী সে সময়কার অন্যসব প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের মধ্যেও তিনি ছিলেন আলাদা। সোমেনের এ অনন্যতার প্রধান কারণ তিনি শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে মেহনতি শ্রমিক শ্রেণির সংযোগ সাধনে নিয়োজিত হয়েছিলেন। আর এজন্য তার ‘পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজম’ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ভূমিকা রেখেছে তার সাহিত্যও।

সারা বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সেকালে সাম্যবাদ আর কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে মরিয়া ছিল। বিশেষত উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সাম্যবাদের পথে ধাবিত হওয়ার শঙ্কায় শাসক শ্রেণি সেসময় ভীষণ বিচলিত ছিল। এ ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক শাসকরা তাই কমিউনিস্ট পার্টি আর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ওপর ভীষণ খড়্গহস্ত হয়েছিল। নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। তারা ছিলেন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় রেল মজদুরদের সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সদ্যই কৈশোর পেরোনো তরুণ সোমেন চন্দ। বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে মজদুরদের সংযোগ রক্ষার এ মহতী দায়িত্ব তিনি খুবই কার্যকরভাবে পালন করেছিলেন ওই অল্প বয়সে। মেহনতি মানুষের এত কাছাকাছি ছিলেন বলে তার সাহিত্যে বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের মর্মবেদনা ও শ্রেণিচেতনা খুব প্রকট ও সহজবোধ্যভাবে হাজির হতে দেখি। একই সঙ্গে তার লেখার সাহিত্যগুণ ছিল সুরক্ষিত। মোটেও তা প্রচারণামূলক ছিল না। তাই তার লেখার আবেদন আজও পাঠকের কাছে সমান তালে টিকে আছে।

শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের প্রশ্নকে তিনি সাহিত্যের বিষয় হিসাবে এনেছেন। এভাবে উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে শ্রমিক প্রশ্ন, সাম্যবাদের প্রশ্নকে কেন্দ্রীয় বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আবার এটিও ঠিক যে, শ্রমিক রাজনীতির কর্মসূচিকে কেবল রাজপথের বা মাঠে-ময়দানের বিষয় হিসাবে না রেখে শিল্প-সাহিত্যকেও রাজনীতির অস্ত্রে/কৌশলে পরিণত করেছেন। বলা যায়, শ্রমিক নেতা সোমেন চন্দ এবং সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক, অর্থাৎ এখানে তার এ দুটি পরিচয় পরস্পরকে ‘রি-ইনফোর্স’ করেছে। একে অপরকে শক্তি জুগিয়েছে।

সমগ্র উপমহাদেশে যে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ সেকালে গণমুখী সাহিত্যচর্চার প্রসার ঘটাচ্ছিল, সোমেন ঢাকায় তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাজনৈতিক কর্মী ও লেখক-লেখিকাদের মধ্যে একটি সংযোগ সেতু হিসাবে এক অনন্য ভূমিকা সে সময় তিনি রেখেছিলেন। সেসময় যারা সোমেনের সহযোদ্ধা ছিলেন তারা সবাই কেবল বয়সে তরুণ ছিলেন তাই নয়, তাদের চিন্তাও ছিল যুগান্তকারী। ঔপনিবেশিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নিছক লেখালেখির সীমা অতিক্রম করে তারা সবাই তখন সমাজের সাম্যবাদী রূপান্তরের জন্য লিখতে শুরু করেন।

স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রগতিবাদী লেখালেখিতে যে ধারার উন্নতি সাধন করেছেন বলে আমরা জানি, তার শুরু কিন্তু হয়েছিল সোমেন চন্দের লেখালেখির ভেতর দিয়েই। আদতে ১৯৩০-এর দশকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা একটি ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক ‘এনলাইটেনমেন্টে’র সীমা অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যে তখন দরকার ছিল কিছু গণবৈপ্লবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার। সেখানেই সবাইকে পথ দেখিয়েছেন সোমেন চন্দ। কবিতার ক্ষেত্রে কাজটি করেছেন আরেক অকালে হারানো তরুণ বিপ্লবী সুকান্ত ভট্টাচার্য। এ প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন-‘প্রবীণ-প্রবীণারা যেখানে এসে অনেকে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন সাময়িকভাবে, সেখানে এই দুই বয়ঃকনিষ্ঠ শিল্পীর পদক্ষেপ অল্পবয়সি হওয়া সত্ত্বেও ছিল অসংশয়।’

স্বাধীনতা ও সাম্যবাদের আদর্শের পতাকাবাহী হিসাবে সোমেনের কাজকর্ম পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে যাদের উদ্বুদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে আছেন-মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সানাউল হক, কবীর চৌধুরী এবং সরদার ফজলুল করিম। এ প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিম ১৯৮২ সালে লিখেছেন-‘সোমেনের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায়ই হয়তো চুম্বকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল প্রগতি লেখক সংঘের অনুষ্ঠানে, আলোচনায়, ক্রিয়াকর্মে। আমার ভাগ্য যে, আমিও সে আহ্বানের বাইরে সেদিন থাকতে পারিনি।’

সোমেন তার পড়ালেখা, রাজনৈতিক কাজ, এবং সর্বোপরি আপসহীন জীবনাচরণ দিয়ে সেকালের তরুণদের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই একটি সময়োপযোগী উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র সরকার লিখেছেন-‘গোপন ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্রে’র প্রকাশ্য শাখা ছিল প্রগতি পাঠাগার। অবিলম্বেই সোমেন এ পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব পান। ... এ তরুণটির মধ্যে জেদ ও সংকল্পের দৃঢ়তা ছিল, ছিল জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও বহু-অধ্যয়নজনিত এক গভীর আত্মপ্রত্যয়। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯৪১ সালে। তখন এ সদস্যপদ খুব সহজলভ্য ছিল না।’ এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায় যে, ১৯৪২ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো যে ‘সোভিয়েত মেলা’ হয়েছিল, সেটিরও প্রধান আয়োজক কর্মী ছিলেন সোমেন চন্দই। এভাবেই লেখালেখির পাশাপাশি ‘করে দেখিয়ে’ সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সোমেন চন্দ।

ফ্যাসিবাদের নির্মম আঘাতে সোমেন চন্দকে অকালে হারিয়েছিল এ দেশ। যে বিপ্লবী পার্টির স্বপ্ন তিনি ও তার সহযোদ্ধারা দেখে গেছেন, সে রকম রাজনৈতিক শক্তিও খুব একটা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু সোমেনের সাহিত্য তো রয়ে গেছে। যে সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার চর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং বিপ্লবী রাজনৈতিক বার্তার বাহক। সোমেন সে কালে মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বেপথু করতে শাসক শ্রেণির যত রকম অপচেষ্টা সেগুলোকে প্রতিরোধ করাকে যেমন নিজের সাহিত্যের বিষয় করেছেন, তেমনি তার গল্পে-সাহিত্যে এসেছে প্রকৃত শ্রেণিচেতনার উন্মেষের জন্য জরুরি বিষয়গুলো। আলোচ্য বইটিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যে লেখাটি সংকলিত হয়েছে, সেখানে সোমেন চন্দের সাহিত্যের এ দিকগুলোর ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সহজপাঠ্য আর সংক্ষিপ্ত কলেবরের এ লেখাটি সোমেনের সাহিত্য সম্পর্কে আজকের তরুণদেরও আগ্রহী করে তুলতে পারে। সেই বিচারে সোমেন সাহিত্য আজও খুবই প্রাসঙ্গিক বলা যায়।

চল্লিশের দশকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক বড় সংকট হিসাবে হাজির হয়েছিল। সোমেনের গল্প ‘দাঙ্গা’তে সেই ভয়াবহতাকে দেখা হয়েছে একজন পরিবর্তনকামী শ্রেণিসচেতন তরুণ রাজনীতিকের চোখ দিয়ে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন, গল্পকার গল্পের প্রোটাগনিস্ট অশোককে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ‘হিন্দু সোশ্যালিস্ট’ ছোট ভাইয়ের উদ্দেশে বলাচ্ছেন-‘আজ বাদ কালের কথা মনে পড়ে, যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে? ... স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? প্যালেস্টাইনের কথা জানিস? জানিস আয়ারল্যান্ডের কথা, মূর্খ।’ একইভাবে সোমেন তার ‘ইঁদুর’ গল্পে দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, এ দেশের মেহনতির শত্রু হলো দারিদ্র্য। এ গল্পে নিুমধ্যবিত্তের ঘরে ইঁদুরের উৎপাত এসেছে পুঁজিবাদের রূপক হয়ে। যে পুঁজিবাদ মেহনতি মানুষকে কুরে কুরে খেয়ে শোষণ করে। সেই ইঁদুরের উৎপাত আজও বহাল আছে বিশ্বজুড়েই।

সোমেনের গল্প ‘সংকেত’ এক্ষেত্রে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ এখানে বিপ্লবের স্বার্থে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যের অপরিহার্যতার ওপর জোর দিতে দেখি সোমেন চন্দকে। পশ্চিমে কমিউনিস্ট আন্দোলন এ ভুখণ্ডের তরুণদের উৎসাহিত করেছিল ঠিকই। তবে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে বিপ্লবের জন্য যে শ্রমিকের পাশে কৃষককেও চাই, তা সোমেন বুঝে নিয়েছিলেন ওই অল্প বয়সেই। তাই ‘সংকেত’ গল্পে দেখিয়েছেন, শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মালিকপক্ষ গ্রামের কৃষিজীবীদের শ্রম কিনতে চাইছে অল্প দামে। গ্রামের ওই মানুষগুলো যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে আগে থেকেই পরাভূত আর নিরুপায়।

সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা আর সমকালীন বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল সাহিত্য আমাদের জন্য রেখে গেছেন বলে সোমেন চন্দ বহুকাল পরেও সাহিত্যিকদের, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যিকদের কাছে প্রিয় হয়ে থেকে গেছেন। যতীন সরকার তার ‘সোমেন চন্দের উত্তরাধক চাই’ শিরোনামের লেখায় এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এনেছেন সমকালে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। তরুণ কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র ভূমিকায় লিখেছেন-‘সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরই নিুমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুজীবন নামে তিনটি গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি।’

সোমেন চন্দ চর্চাকেন্দ্রের উদ্যোগে ‘শতবর্ষে সোমেন’ শিরোনামের এ গ্রন্থটির যিনি প্রধান কান্ডারি, সেই কামাল লোহানী আজ আমাদের মাঝে নেই। এ বইতে সোমেন চন্দকে নিয়ে তার একটি অসাধারণ লেখাও সংকলিত হয়েছে। সেখানে অকালে হারানো সোমেন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ভারত ভাগ হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে রাজনৈতিক বিরোধীদের হাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে রেলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তরুণ সাহিত্যিক ও শ্রমিক নেতা সোমেন চন্দ খুন হলেন নির্মমভাবে। তার ধীশক্তি, সংগঠন গড়ার মুনশিয়ানা, লেখায় প্রাসঙ্গিক বাস্তবকে উপস্থাপন করাই ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই লেখায় ঘুণে ধরা সমাজের ব্যবচ্ছেদ আছে, আছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ-কী করতে হবে তার কথা।’

সোমেনের রাজনীতি ও সাহিত্য ছিল মাটিঘেঁষা, জনসংশ্লিষ্ট। অল্প বয়সে খুন না হয়ে গেলে সোমেন এ ভূখণ্ডের রাজনীতি ও সমাজে যে ভূমিকা রাখতে পারতেন তা ‘স্পেকুলেট’ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। সোমেন নিয়ে অত গভীর কোনো জানাশোনা আমার নেই। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেয়েছি-অভাজন শ্রেণি থেকে উঠে আসা একজন মাটিঘেঁষা তরুণ রাজনীতিক যদি পরিণত বয়স পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পারেন, তাতে কী দারুণ পরিবর্তনই না সম্ভব! মানুষের মুক্তি ও সাম্যের যারা শত্রু, তারা বঙ্গবন্ধুকেও শারীরিকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সমাজতন্ত্র’ও আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন আমাদের সামনে আজও টিকে আছে। ঠিক যেমন আমাদের সামনে আছে সোমেন চন্দের স্বপ্নের প্রতিলিপি হিসাবে তার সাহিত্যগুলো।

আমাদের যারা স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সোমেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য-এ নিয়ে সন্দেহ নেই। আর এ সত্যও স্বীকার করতে হবে যে, আজকের দিনেও সামাজিক ন্যায়বিচার আর সাম্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে কিন্তু রয়েই গেছে। গণমুখী রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে খানিকটা। তবু মৌলবাদী বিভাজনের রাজনীতির অভিশাপও বিদ্যমান। ইদানীং তো তথাকথিত উন্নত বিশ্বেও এমন সংরক্ষণবাদী আর জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির আশঙ্কাজনক উত্থান দেখি। তাই সোমেনের চিন্তা আর তার দেখানো পথ এখনো একই রকম প্রাসঙ্গিক। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে সোমেন সাহিত্যচর্চার আহ্বান জানাই।

ড. আতিউর রহমান : অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন