প্রতি শনিবার হোক ‘গ্রন্থাগার দিবস’
সরকারি অফিসে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন। ২০২২ সালের শেষদিকে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই নিয়ম চালু করে। চলতি বছর ছুটির তালিকায় এটি স্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীরা আগে সপ্তাহে এক দিন ছুটি পেত, এখন পাচ্ছে দুদিন। শাস্ত্রে আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’, অর্থাৎ ছাত্রদের প্রধান কাজ অধ্যয়ন, তপস্যা এবং অবশ্যই তা বই পড়ে। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা শনিবার কী কাজ করবে, কীভাবে সময় কাটাবে? আমরা কি তাদের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছি? না, দেইনি।
তাই আমাদের প্রস্তাব হলো, শনিবার দিন তারা বই পড়বে। সিলেবাসের বাইরে জীবনঘনিষ্ঠ বই। এ বই হতে পারে ইতিহাস, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, জীবনী, পুরাকীর্তি, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ের। এভাবেই তারা জ্ঞানার্জন করবে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাঠক তৈরির মূল উৎস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ ‘শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার’। এ ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা মুখ্য। তবে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, অন্যান্য শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া গ্রন্থাগারিকের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
প্রতিষ্ঠানভেদে বার্ষিক ছুটি কমবেশি হয়, যেমন-
১. প্রাথমিক বিদ্যালয় : সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান, দুই ঈদ, পূজা-পার্বণ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় দিবস মিলে বছরে ছুটি ৫৪ দিন। এর সঙ্গে যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১০৪ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৫৮=২০৭ দিন। শিক্ষার্থীরা যদি শনিবার বই পড়ে, তাহলে বছরে অন্তত ১২টি বই পড়তে পারবে। এতে তাদের জ্ঞান বাড়বে।
২. মাধ্যমিক বিদ্যালয় : সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস, ধর্মীয় উৎসব মিলে বছরে ছুটি ৭৬ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৭৮ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৭৮=১৮৭ দিন। শিক্ষার্থীরা মাসে দুটি করে বই পড়লে বছরে অন্তত ২৪টি বই পড়তে পারবে।
৩. মাদ্রাসা : ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম ও কামিল মাদ্রাসায় ধর্মীয় উৎসব ও ইভেন্ট মিলে ছুটি ৬৩ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৬৭ দিন। মোট
কর্মদিবস ৩৬৫-১৬৭=১৯৮ দিন। মাসে একটি বই পড়লে বছরে অন্তত ১২টি।
৪. কলেজ : সরকারি-বেসরকারি কলেজে ইভেন্ট-ফেস্টিভ্যাল মিলে ছুটি ৭১ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৭৫ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৭৫=১৯০ দিন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়তি বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। তাই শনিবারকে বাধ্যতামূলক ‘বুক রিডিং ডে’ বা ‘বই পড়া দিবস’ ঘোষণা করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
পরামর্শ : ১. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিনে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ সাবজেক্ট রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ২. প্রতি বৃহস্পতিবার প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অবশ্যই গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। শনিবার অবশ্যই বই পড়তে হবে। এভাবেই পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে।
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস : সরকার ২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, সরকার ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেছে এবং এ তারিখকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো একযোগে দিবসটি উদযাপন করে।
গ্রন্থাগারিকের পদ : গ্রন্থাগারিকের উপযোগিতা উপলব্ধি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম) ও উচ্চমাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) স্তরে সহকারী গ্রন্থাগারিক/ক্যাটালগারের পদ সৃষ্টি করা হয়। পদটি এমপিওভুক্ত। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সমমানের ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় এ পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে কাক্সিক্ষত ফল অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ ‘পাঠক’ (পড়ুয়া) তৈরি হচ্ছে না। আমরা এ স্তরে গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জানামতে, দেশে সরকারি-বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত সব মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয় এক লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার। ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সাত হাজার ৭৯১টি, বর্তমানে ২০ হাজার ৮৪৯টি। কলেজ ছিল ৫২৬টি, বর্তমানে চার হাজার ৬৯৯টি। বর্তমানে আলিয়া ও দাখিল মাদ্রাসা আছে ৯ হাজার ৩০৫টি। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫৮টি।
পদবি পরিবর্তন : ২০২১ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় গ্রন্থাগারিকদের নতুন পদবি দেওয়া হয় ‘সহকারী শিক্ষক (তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা)’।
বঙ্গবন্ধু কর্র্নার : দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এক হাজার গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি : ‘জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি’ ২০০১ সালের ২৮ মে অনুমোদিত হয়। সে সময় বাংলাদেশ ছিল স্বলোন্নত দেশ। ইতোমধ্যে সেই প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। রূপকল্প ২০৪১-এর পথ ধরে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে। উন্নত দেশের সারিতে উন্নীত হওয়া এখন আর স্বপ্ন নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জীবন সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মুনষ গড়াটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র পরীক্ষিত পথ জ্ঞাননির্ভর, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক সমাজ গড়া। এ ক্ষেত্রে মানবসভ্যতার বিকাশের সূচনালগ্ন থেকে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অবিসংবাদিত।
রূপকল্প ২০৪১-এর মুখবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, আলোকোজ্জ্বল ভষ্যিতের দিকে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ঐতিহাসিক কালপর্ব। নিঃসন্দেহে এ স্বপ্নযাত্রার ভিত্তি আলোকিত মানুষ। সেই আলোকিত মানুষ গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গ্রন্থাগারমুখী অবারিত ও আনন্দময় স্বশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশের এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বিকাশে, সর্বস্তরের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এবং জনগণের জীবনব্যাপী স্বশিক্ষায় সহায়তা প্রদানে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে, অর্জিত শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে, কূপমণ্ডূকতা ও কুসংস্কারের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক চেতনা-মুক্তচিন্তার বিকাশে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার
emdadhb@yahoo.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রতি শনিবার হোক ‘গ্রন্থাগার দিবস’
সরকারি অফিসে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন। ২০২২ সালের শেষদিকে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই নিয়ম চালু করে। চলতি বছর ছুটির তালিকায় এটি স্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীরা আগে সপ্তাহে এক দিন ছুটি পেত, এখন পাচ্ছে দুদিন। শাস্ত্রে আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’, অর্থাৎ ছাত্রদের প্রধান কাজ অধ্যয়ন, তপস্যা এবং অবশ্যই তা বই পড়ে। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা শনিবার কী কাজ করবে, কীভাবে সময় কাটাবে? আমরা কি তাদের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছি? না, দেইনি।
তাই আমাদের প্রস্তাব হলো, শনিবার দিন তারা বই পড়বে। সিলেবাসের বাইরে জীবনঘনিষ্ঠ বই। এ বই হতে পারে ইতিহাস, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, জীবনী, পুরাকীর্তি, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ের। এভাবেই তারা জ্ঞানার্জন করবে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাঠক তৈরির মূল উৎস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ ‘শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার’। এ ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা মুখ্য। তবে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, অন্যান্য শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া গ্রন্থাগারিকের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
প্রতিষ্ঠানভেদে বার্ষিক ছুটি কমবেশি হয়, যেমন-
১. প্রাথমিক বিদ্যালয় : সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান, দুই ঈদ, পূজা-পার্বণ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় দিবস মিলে বছরে ছুটি ৫৪ দিন। এর সঙ্গে যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১০৪ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৫৮=২০৭ দিন। শিক্ষার্থীরা যদি শনিবার বই পড়ে, তাহলে বছরে অন্তত ১২টি বই পড়তে পারবে। এতে তাদের জ্ঞান বাড়বে।
২. মাধ্যমিক বিদ্যালয় : সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস, ধর্মীয় উৎসব মিলে বছরে ছুটি ৭৬ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৭৮ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৭৮=১৮৭ দিন। শিক্ষার্থীরা মাসে দুটি করে বই পড়লে বছরে অন্তত ২৪টি বই পড়তে পারবে।
৩. মাদ্রাসা : ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম ও কামিল মাদ্রাসায় ধর্মীয় উৎসব ও ইভেন্ট মিলে ছুটি ৬৩ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৬৭ দিন। মোট
কর্মদিবস ৩৬৫-১৬৭=১৯৮ দিন। মাসে একটি বই পড়লে বছরে অন্তত ১২টি।
৪. কলেজ : সরকারি-বেসরকারি কলেজে ইভেন্ট-ফেস্টিভ্যাল মিলে ছুটি ৭১ দিন, যোগ হবে শুক্রবার ৫২+শনিবার ৫২ দিন=১৭৫ দিন। মোট কর্মদিবস ৩৬৫-১৭৫=১৯০ দিন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়তি বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। তাই শনিবারকে বাধ্যতামূলক ‘বুক রিডিং ডে’ বা ‘বই পড়া দিবস’ ঘোষণা করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
পরামর্শ : ১. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিনে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ সাবজেক্ট রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ২. প্রতি বৃহস্পতিবার প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অবশ্যই গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। শনিবার অবশ্যই বই পড়তে হবে। এভাবেই পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে।
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস : সরকার ২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, সরকার ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেছে এবং এ তারিখকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো একযোগে দিবসটি উদযাপন করে।
গ্রন্থাগারিকের পদ : গ্রন্থাগারিকের উপযোগিতা উপলব্ধি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম) ও উচ্চমাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) স্তরে সহকারী গ্রন্থাগারিক/ক্যাটালগারের পদ সৃষ্টি করা হয়। পদটি এমপিওভুক্ত। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সমমানের ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় এ পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে কাক্সিক্ষত ফল অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ ‘পাঠক’ (পড়ুয়া) তৈরি হচ্ছে না। আমরা এ স্তরে গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জানামতে, দেশে সরকারি-বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত সব মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয় এক লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার। ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সাত হাজার ৭৯১টি, বর্তমানে ২০ হাজার ৮৪৯টি। কলেজ ছিল ৫২৬টি, বর্তমানে চার হাজার ৬৯৯টি। বর্তমানে আলিয়া ও দাখিল মাদ্রাসা আছে ৯ হাজার ৩০৫টি। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫৮টি।
পদবি পরিবর্তন : ২০২১ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় গ্রন্থাগারিকদের নতুন পদবি দেওয়া হয় ‘সহকারী শিক্ষক (তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা)’।
বঙ্গবন্ধু কর্র্নার : দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এক হাজার গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি : ‘জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি’ ২০০১ সালের ২৮ মে অনুমোদিত হয়। সে সময় বাংলাদেশ ছিল স্বলোন্নত দেশ। ইতোমধ্যে সেই প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। রূপকল্প ২০৪১-এর পথ ধরে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে। উন্নত দেশের সারিতে উন্নীত হওয়া এখন আর স্বপ্ন নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জীবন সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মুনষ গড়াটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একমাত্র পরীক্ষিত পথ জ্ঞাননির্ভর, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক সমাজ গড়া। এ ক্ষেত্রে মানবসভ্যতার বিকাশের সূচনালগ্ন থেকে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অবিসংবাদিত।
রূপকল্প ২০৪১-এর মুখবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, আলোকোজ্জ্বল ভষ্যিতের দিকে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ঐতিহাসিক কালপর্ব। নিঃসন্দেহে এ স্বপ্নযাত্রার ভিত্তি আলোকিত মানুষ। সেই আলোকিত মানুষ গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি গ্রন্থাগারমুখী অবারিত ও আনন্দময় স্বশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশের এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার বিকাশে, সর্বস্তরের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এবং জনগণের জীবনব্যাপী স্বশিক্ষায় সহায়তা প্রদানে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে, অর্জিত শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে, কূপমণ্ডূকতা ও কুসংস্কারের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক চেতনা-মুক্তচিন্তার বিকাশে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার
emdadhb@yahoo.com