Logo
Logo
×

বাতায়ন

রাজনৈতিক জোটে পরিণত হচ্ছে ব্রিকস?

Icon

রামজি বারউদ

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক জোটে পরিণত হচ্ছে ব্রিকস?

কে ভেবেছিল জি-৭ দেশগুলোর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হিসাবে বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে যাবে ব্রিকস? সংস্থাটি প্রতিশ্রুতিশীল ছিল বটে, তবে এর প্রকৃত সম্ভাবনা ছিল দূরবর্তী। তদুপরি ব্রিকসকে সবাই নিছক অর্থনৈতিক জোট হিসাবেই দেখে এসেছে এতদিন। সংগঠনটি যে সরাসরি বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে এবং তা এত তাড়াতাড়ি, সেটি আর যার কল্পনাতেই থাকুক, আমার ভাবনায় আসেনি ঘুণাক্ষরেও।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা-এই পাঁচটি দেশের আদ্যাক্ষর (ইংরেজি) দিয়ে গঠিত সংস্থা। অনেকে বলেন, ২০১১ সালে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে ধারণাটির প্রবর্তন করেন গোল্ডম্যান স্যাকসের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল। শুরুতে অবশ্য কেবল চারটি দেশের উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তখন এটা ছিল ব্রিক। পরে ‘এস’ যুক্ত হয় ২০১০ সালে; জোটটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগদানের মাধ্যমে। ব্রিকের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে। ওই সম্মেলনে যেসব আলোচনা হয় সেগুলোর মধ্যে কাজের কথা ছিল খুবই কম। অধিকাংশই ছিল বিমূর্ত অর্থনৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক আলোচনা। ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে কোনো সিরিয়াস আলোচনা দেখিনি আমি। ওই বছর প্রথম ব্রিকসের গঠন ও কর্মপ্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে সব সদস্য মিলে ৫০ বিলিয়ন ডলারের ভিত্তি বিনিয়োগ দিয়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করলে। বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ব্রিকসকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণের সূচনাটিও সেখান থেকেই।

ব্রিকস যখন নিজস্ব অর্থ দিয়ে নতুন ব্যাংক চালু করল, সেটির উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন : আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের বেলায় পশ্চিমা নীতি প্রভাবিত দুটি বিশেষ অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ওপর নির্ভরতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা। পরে আরও সম্প্রসারিত হয় ব্রিকসের কর্মপরিধি। এটি এখনো বাড়ছে। আমি বলব, এর পেছনের মূল কারণ, বৈশ্বিক সংঘাত, বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধটি ব্রিকসের বিস্তার ঘটাচ্ছে ব্যাপকভাবে। এমনকি তাদের সাফল্য দেখে আর্থিকভাবে শক্তিশালী কিছু দেশ যেমন আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো ও আলজেরিয়া বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। একই বিষয়ে সৌদি আরবেরও আংশিক আগ্রহ রয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়।

সাম্প্রতিককালে যেসব বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তথা জিডিপির দিক থেকে ব্রিকস এখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জিডিপি ব্লক। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর অবদান ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান রেখে এর পরের অবস্থানে রয়েছে জি-৭।

প্রতিষ্ঠার পর বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কিংবা সুযোগের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্রিকসকে। সেটি হচ্ছে, অনেক প্রতিশ্রুতিশীল দেশ এখন সংস্থাটির সদস্য হতে আগ্রহী। একদিক থেকে দেখলে এটি একটি সুযোগ। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে সদস্য ভিত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অব্যাহত রাখতে হবে চলতি প্রবৃদ্ধির হার। উপরন্তু নতুন সদস্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রতি দিতে হবে সজাগ দৃষ্টি। এটি বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি।

আইএমএফের ভূমিকা নিয়ে সারা বিশ্বেই কিছু আলোচনা-সমালোচনা আছে। কেউ কেউ বলেন, বিশেষত গ্লোবাল সাউথে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চেয়ে আইএমএফের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক বিবেচনা। ওই বিবেচনাটিকে তারপর লুকিয়ে ফেলা হয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চাদরে। অথচ গোটা প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেসরকারীকরণ এবং পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের কাছে বাজার উন্মুক্তকরণ। এদিক থেকে ব্রিকসের ব্যাপারে আশাবাদী অনেক দেশ। তারা মনে করে, ব্রিকস শক্তিশালী হলে একদিকে যেমন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মাতবরি কমবে; অন্যদিকে যেহেতু ব্রিকসের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, আবার স্থানীয় অর্থনীতিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের আগ্রহও লক্ষ করা যাচ্ছে না, সেহেতু ব্রিকস সবচেয়ে উপকারী হবে গরিব দেশগুলোর জন্য।

এরই মধ্যে পশ্চিমের বেশ কয়েকটি দেশ পড়েছে মূল্যস্ফীতির মুখে। তাতে কমেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা। এ সুযোগে ব্রিকসের সহায়তায় নিজস্ব একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে গ্লোবাল সাউথের একাধিক দেশ। এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, আগে ব্রিকস পুরোপুরি একটি অর্থনৈতিক সত্তা ছিল; এখন এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিশ্ব রাজনীতির মাত্রা।

ব্রাজিল ও চীনের মধ্যে নতুন এক অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে গত ৩০ মার্চ। চুক্তি অনুসারে দুই দেশই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে পারবে; ডলারের মধ্যস্থতা ছাড়াই। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে পারে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ। চীন-ব্রাজিল কর্তৃক নিজস্ব মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার এ সিদ্ধান্ত সর্বশেষ হবে না নিঃসন্দেহে। ৩০-৩১ মার্চ ইন্দোনেশিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের নিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন করে আসিয়ান। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে, আর্থিক প্লাবতার শক্তি বাড়াতে হবে। কী উপায়ে? অন্তত আসিয়ান অঞ্চলে আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের প্রচলন ঘটিয়ে। আর কোন কাঠামোর মাধ্যমে করা যেতে পারে সেটি? বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির মানচিত্রে সংশোধন আনতে উদ্যোগী হয়েছে একাধিক ব্রিকস সদস্য।

গ্লোবাল সাউথের এসব পরিবর্তন অবলোকন করে উদ্বিগ্ন হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। ওয়াশিংটনসহ ইউরোপের একাধিক রাজধানীর ভাবনায় পরিলক্ষিত হয় সেটি। গত বছর ডিসেম্বরে হোয়াইট হাউজে আফ্রিকার ৪০ জন রাষ্ট্রনেতাকে নিমন্ত্রণ জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাদের উপদেশ দেওয়া হয়, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ বিষয়ে কোনো পক্ষ যেন না নেয় আফ্রিকা। এরপর গত ২৬ মার্চ একই এজেন্ডা নিয়ে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

ফলে ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক গ্রুপ, এ কথা এখন আর পুরো সত্য প্রকাশ করে না। বরং আমি বলব, এরই মধ্যে ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতিতে গ্লোবাল সাউথের নতুন প্ল্যাটফর্ম এখন ব্রিকস। অনেক পশ্চিমা গণমাধ্যম হয়তো আমার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করবে। তবে এতে ব্রিকসকে পুনরায় নিছক অর্থনৈতিক সত্তায় পর্যবসিত করা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ এরই মধ্যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় বাস্তবিকই ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে ব্রিকস।

গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ড. রামজি বারউদ : ফিলিস্তিনি সাংবাদিক; সম্পাদক, প্যালেস্টাইন ক্রোনিকেল

 

ব্রিকস

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম