Logo
Logo
×

বাতায়ন

‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির জন্য কে কতটা দায়ী

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির জন্য কে কতটা দায়ী

জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এটি ঘিরে বাড়ছে জল্পনা-কল্পনা। দেশের বাইরে শুধু নয়, ভেতর থেকেও জল্পনা-কল্পনানির্ভর ভিডিও কনটেন্ট ও প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে। এর ভোক্তাও বহু। এতে করে আসছে নির্বাচন সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে ধারণা স্পষ্ট হওয়ার বদলে বিভ্রান্তি বাড়ছে বরং। মাঠের বিরোধী দল যে বিএনপি, তাতে কারও সন্দেহ নেই এবং তারা এ বক্তব্য আরও দৃঢ়ভাবে দিচ্ছে যে, একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচনে দলটি অংশ নেবে না। এর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনেই অংশগ্রহণ করেছিল। তখন সরকারের তরফ থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। সেটা কতখানি হয়েছে-শুধু বিরোধী দল নয়, সরকারি দলের নেতাকর্মী আর সমর্থকরাও তা কমবেশি জানে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলে বিবেচিত একটি দেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে খোলামেলা মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় ২০১৮-এর নির্বাচনের মান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলেও স্বস্তি নেই এবং এটি তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যেও টের পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনের আগে একটি বড় সমঝোতা হয়েছিল বলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কথা চালু আছে। তখন কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় ফিরে আসার নিশ্চয়তার পাশাপাশি বিএনপি জোটের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সম্মানজনক আসন রাখার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রের খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। নির্বাচনের ফলে তার কোনো প্রতিফলন অবশ্য দেখা যায়নি।

যা হোক, তেমন কোনো নির্বাচন আর হবে না বা এমনকি ২০১৪ সালে যে মানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তারও পুনরাবৃত্তি হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে এখন কথা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে যারা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ দেখতে চায়, সেই আন্তর্জাতিক আর আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও দেওয়া হচ্ছে একই প্রতিশ্রুতি। কিন্তু মাঠের যে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে এসব করা হচ্ছে, তারা কোনোভাবেই আর দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছে না। কিছু দিনের মধ্যে দেশের পাঁচ সিটিতে যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতেও বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না। তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে এবং তৃণমূলে এ ধরনের নির্বাচনে কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণের পক্ষে একটি অভিমত অবশ্য রয়েছে। তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ প্রশ্নে ইতোমধ্যে নিয়েছে দৃঢ় অবস্থান। ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত এমন সিটি নির্বাচনে বিএনপি কিন্তু অংশ নিয়েছিল। তাতে নির্বাচন হয়ে উঠেছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং ভোটারদের জন্য কিছুটা হলেও আকর্ষণীয়।

এবার নতুন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে অনুষ্ঠেয় পাঁচ সিটির নির্বাচনে তার বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। কাউন্সিলর পদে কোথাও কোথাও বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে গেলেও কোনো সিটিতে মেয়র পদে দলের কেউ অংশ নিচ্ছেন না। সবশেষে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সিলেট সিটি মেয়রও জানিয়ে দিলেন, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। তার মতে, দেশের কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। ভোটারদের মধ্যেও কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা সত্য, মাঠের বিরোধী দলের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ না থাকলে কোনো নির্বাচনই ভোটারদের জন্য আকর্ষণীয় হয় না এবং তা অর্থবহও হয়ে ওঠে না। তাই নির্বাচনকে করে তুলতে হয় সব দিক থেকে অংশগ্রহণমূলক। বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলে দেখা যায়, যারা একতরফা নির্বাচন করছে- তাদের বাঁধা ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না। ‘নিয়মরক্ষা’র কিছু একতরফা উপনির্বাচনে খুবই কম ভোট পড়তে দেখা গেছে, যা বেদনাদায়ক। সম্ভাব্য সব পক্ষের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ ও উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশ পেলে এ দেশের মানুষ কী বিপুলভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে এগিয়ে আসে, সেটি ইতোপূর্বে একাধিকবার দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে। ওই ধরনের সরকারের অধীনে সবশেষ নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে এবং তাতে ৮৭ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ে। তাতে আজকের বিরোধী দল বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেলেও (কিছু অভিযোগসহ) নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে সংসদে গিয়ে বসে। সেই সংসদ কতখানি কার্যকর হয়েছিল, এ প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভেতর দিয়ে গঠিত সংসদও এ দেশে তেমন কার্যকর হয়নি। সংসদ কার্যকর না হওয়ার জন্য সরকারি ও বিরোধী দল বরাবরই পরস্পরকে দায়ী করে আসছে-আর সব বিষয়ে তাদের গতানুগতিক বাদানুবাদের মতোই। এ বিষয়ে তুলনামূলক দলনিরপেক্ষ সুশীল সমাজেরও পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

সেটি এক অর্থে ভিন্ন প্রসঙ্গ, কেননা ২০০৮-এর পর অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ধারার প্রথম নির্বাচনটি সরকারকে করতে হয় বিরোধী পক্ষের তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে। রাজধানীর বাইরে নজিরবিহীন সহিংসতা হয়েছিল তখন এবং সে কারণে সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোটই হতে পারেনি। এ ধরনের নির্বাচন আর কখনো অনুষ্ঠিত হতেও দেখা যায়নি দেশে। এর দায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা উভয় পক্ষের ওপরই কমবেশি বর্তায়। তা সত্ত্বেও এর ভেতর দিয়েই সরকার গঠিত হয় এবং সেটি পুনঃনির্বাচিত হয় ২০১৮-এর নির্বাচনে, যাতে বিএনপি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়ে অংশ নিয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকে অবশ্য বলা হয়ে থাকে, জোরালোভাবে অংশগ্রহণের বদলে বিএনপি এমনভাবে অংশ নিয়েছিল-যাতে নির্বাচনটি বিতর্কিত হয়। বিএনপি অবশ্য বলে থাকে, সরকার পক্ষের আগ্রাসী আচরণের কারণেই ওই নির্বাচন বিতর্কিত হয়।

যা হোক, বিতর্কিত হলেও নির্বাচন অবৈধ হয়নি এবং সরকার গঠনও আটকে থাকেনি। তবে নিশ্চয়ই ভালো হতো-যদি নির্বাচনটিতে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি যেভাবেই হোক, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন পেয়ে সংসদে এসে বসত এবং সেখানে জোরালো ভূমিকা রাখতে হতো উদ্যোগী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪-এর নির্বাচন সর্বশক্তি দিয়েও প্রতিহত করতে না পেরে ক্রমে একটি দুর্বল বিরোধী দল হয়ে পড়েছিল বলেই পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল দলের বাইরের সমমনা নেতা ড. কামাল হোসেনের অভিভাবকত্বে। সেটি ভুল পদক্ষেপ ছিল বলে বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে এখন বলা হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন পেয়ে সংসদে যেতে পারলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিলেও নিতে পারত। ২০১৪-এর ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের একটি সংশোধনও হয়ে যেতে পারত ২০১৮-তে বিএনপি শক্তিশালী বিরোধী দলের জায়গায় যেতে পারলে। সমঝোতার ভেতর দিয়ে হলেও শান্তিপূর্ণ পথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এতে একটি অগ্রগতি হলেও হতে পারত।

ক্ষমতাসীন দলেরই উচিত ছিল যুদ্ধাস্ত্র ফেলে নির্বাচনে ফেরায় বিএনপিকে তার সে জায়গাটা দেওয়া, যাকে জনমতের এক ধরনের প্রতিফলন বলেও নেওয়া যেতে পারে। তাতে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং তা টেকসই হওয়ার ব্যাপারে জনমনে একটা ন্যূনতম আস্থা সৃষ্টি হতে পারত। সেটাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ না করা কিংবা তাতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ এমন এক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগ দায় নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে। তাদের আন্দোলনে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ‘সংবিধানের অঙ্গীভূত’ হয়েছিল, সেটি আবার তাদেরই হাতে বাতিল হওয়ার ঘটনা তো ব্যাপক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের উপায় বের করা গেলে হয়তো ভিন্ন হতো পরিস্থিতি। সেটি হয়নি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের সদিচ্ছা ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা দু’য়েরই অবনতি লক্ষ করা গেছে ক্রমে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও আগেকার মান ধরে রাখা যায়নি। সেগুলো ঘিরে বরং আরও বেশি সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি নিজ দলে এবং তা বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন দল তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারলেও এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো কিছুটা এড়ানো যেত।

সংবিধানের বিধিবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একসময় তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপিও একরোখা অবস্থান নিয়েছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এ ক্ষেত্রে আরও একরোখা মনোভাব প্রদর্শন করে চলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো নয়ই-কোনো ধরনের দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে তার বিরাট অনীহা। এ ক্ষেত্রে যেন কাজ করছে আরও বেশি শঙ্কা। এ দেশে বিশেষত জাতীয় নির্বাচনে কেউই পরাজিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ, কোনোমতে সরকার গঠন করলেও ক্ষমতাসীন দল সবকিছু দখলে নিয়ে বিরোধী দলকে একেবারে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে। তিন দফায় একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকার পর বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা স্বভাবতই অনেক বেশি। এ মানসিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিএনপির দায়ও কম নয়। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারা ক্ষমতায় থাকাকালে তখনকার বিরোধী নেত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল খোলামেলা সমাবেশে। সেটি ছিল বিরোধী দলকে নির্মূল করতে না পারলেও তাদের নেতৃত্বহীন ও স্থায়ীভাবে দুর্বল করে ফেলার এক ভয়াবহ চেষ্টা। ন্যায়বিচারের বদলে এটি আবার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যেভাবেই হোক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেলে ২০১৪-এর নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টার বদলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে একটি বড় বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারলেও দেশের বর্তমান পরিণতি বোধকরি এড়ানো যেত। বিএনপিকেও হয়তো এত বাধাবিপত্তি ও বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হতো না।

এখন পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, উভয় পক্ষের জন্যই তা ‘ডু অর ডাই’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিএনপির ভালোই জনসমর্থন রয়েছে; কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তার নেই। এদিকে সরকার পক্ষ মনে হয় নির্ভর করে আছে এক কাতারে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ এবং একাধিক আঞ্চলিক শক্তির ওপর। এ অবস্থায় কোনো দৃশ্যমান সমাধান-সূত্রের বদলে বেশি করেই যেন ছড়াচ্ছে জল্পনা-কল্পনা ও গুজবের ডালপালা। একটি সম্ভাবনাময় দেশ ও জনগোষ্ঠীর জন্য এ পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে দুর্ভাগ্যজনক।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম