Logo
Logo
×

বাতায়ন

বঙ্গবন্ধুর শান্তি-দর্শন কেন এখনো প্রাসঙ্গিক

Icon

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর শান্তি-দর্শন কেন এখনো প্রাসঙ্গিক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার গ্রহণের সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন ২০২৩ সালের ২৩ মে। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় এ দিন তার হাতে আনুষ্ঠানিভাবে এ পদক তুলে দেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র।

শান্তি পদক গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিহত করে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি জাতীয় স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে আছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি আর আঞ্চলিক স্বাধীনতার অপরিহার্যতা।’ তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনে যুক্তদের সহকর্মী হিসাবে অভিহিত করে বলেন, এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ব শান্তি পরিষদ পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল, পাশে ছিল। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরুর দেড় মাস যেতে না যেতেই হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদ শান্তি সম্মেলন আয়োজন করেছিল, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। ২৫ মার্চের পর এটাই ছিল কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ।

খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ও তার স্ত্রী ইরিন কুরি রসায়নে অবদান রাখার জন্য যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। জুলিও কুরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। একই সঙ্গে তিনি আরও অনেক সহকর্মীর সঙ্গে বিজ্ঞানের অর্জনকে মানবতার কল্যাণে কাজে লাগাতে ছিলেন সক্রিয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, যা মুহূর্তে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর প্রাণ কেড়ে নেয় এবং অপরিমেয় সম্পদের বিনাশ ঘটায়। ১৯৪৫ সালের আগস্টে যুদ্ধের অবসানের পর শান্তি আন্দোলন সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়, সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে সামনের সারিতে থাকেন জুলিও কুরি। ১৯৫৮ সালে তার মৃত্যুর পর বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম পরিবর্তন করে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার রাখে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সর্বদা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য স্বাধীনতা চেয়েছেন তরুণ বয়সেই। কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, বরাবর আস্থা রেখেছেন শান্তিপূর্ণ পন্থায়। অশান্তির পথে বরাবর চলছিল পাকিস্তানের শাসকরা। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা কর্মসূচি প্রদান করলে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র-জনতা তাকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে এবং বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসাবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন-প্রতিপক্ষের একজনও ‘যদি ন্যায্য কথা বলে, মেনে নেব।’ একই সঙ্গে তার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিল-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে তিনি শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন-যদি গুলি চলে, তাহলেই কেবল যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। তিনি জনগণকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করেছিলেন যে ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ আপামর জনতা অস্ত্র তুলে নিতে মুহূর্ত দেরি করেনি।

বিজয়ের পর শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রিয় স্বদেশে পা রাখার আগেই তিনি লন্ডন ও দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ঘোষণা করেন এভাবে-সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাবেন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে, এ সংকল্পও ব্যক্ত হয়। শান্তির প্রতি তার এ অঙ্গীকার আকস্মিক ছিল না। ১৯৫২ সালে, বয়স যখন মাত্র ৩২ বছর-পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তিনি সমাজতান্ত্রিক চীনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। ৩৭টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের বার্তা ছিল-বিশ্বশান্তির জন্য লড়তে হবে সম্মিলিতভাবে। এ শান্তি সম্মেলনকে বিষয় করে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সঙ্গে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি।... যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লাখ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে।’ (পৃষ্ঠা ১৯)

বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিলেন। পরে রাশিয়া, চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়েও তিনি শান্তি ও বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি পাকিস্তানে শান্তি পরিষদ সংগঠিত করার কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করার ঘটনা তাই আকস্মিক ছিল না।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে তিনি বলেছিলেন, ‘আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি ও আনবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারি ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব, যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আনবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে।’

জাতির পিতা চীনে বক্তব্য রেখেছেন সাত দশকেরও বেশি আগে। জাতিসংঘে ভাষণেরও পাঁচ দশক পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু এখনো শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বিশ্ব সুদূরপরাহত হয়ে আছে। যুদ্ধ সম্পদ ও প্রাণের বিনাশ ঘটায়। একই সঙ্গে তার থাকে ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বঙ্গবন্ধু এসবের প্রতি যথাযথভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি রমেশ চন্দ্র ঢাকায় পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তাকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসাবে অভিহিত করায় বিস্ময়ের কিছু ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার তো এরই ধারাবাহিকতা। তিনি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর অত্যাচারে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয় দিয়েছেন, খাদ্য-বাসস্থান-চিকৎসার ব্যবস্থা করেছেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উৎপীড়নের নীতির কারণে আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির প্রতি যে গুরুতর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে সেটাও তুলে ধরছেন।

বিশ্ববন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শান্তি-দর্শন মানবজাতির জন্য সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেবে, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আর এ কারণেই দিবসটি উদ্যাপন নিছক আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকবে না। পরিশেষে বলি-আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গীকার স্মরণীয় করে রাখার জন্য জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সংস্থা বঙ্গবন্ধু শান্তি পদক চালু করার প্রস্তাব বিবেচনা করতেই পারে।

অজয় দাশগুপ্ত : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

বঙ্গবন্ধু

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম