নতুন প্রস্তাবে খেলাপি ঋণের গতি রোধ হবে কি?
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশে খেলাপি ঋণের গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়। বরং দিনকে দিন তা ভয়ানক আকার ধারণ করছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, গত দশ বছরে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।
২০১২ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। তবে আদালতের স্থগিতাদেশ আছে এমন ঋণ, পুনঃতফশিলকৃত ঋণ ও মারপ্যাঁচের ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হলে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা হবে বলে গবেষকরা মনে করেন। দেশের এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট প্রদত্ত ঋণের ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রতিবেদন বলছে, আমাদের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির নাম খেলাপি ঋণ; যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি বিষফোড়া।
পাশাপাশি এতে কর্মসংস্থানের গতি কমে গিয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাজস্ব আয় নিম্নগামী হয়ে পড়ে এবং জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থিতিশীল হয়ে পড়ে; যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, খেলাপি ঋণের আকার এত বিশাল হওয়ার কারণ হলো-রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনের ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানি পরিচয় ইত্যাদি।
অর্থনীতিতে এ রকম দুরবস্থার বিষয়ে সরকারি মহল অবগত। এ কারণে তারা মাঝেমধ্যে নেড়েচেড়ে বসতে চায়। তবে দেশের কোনো গবেষক বা বিশেষজ্ঞের মতামতকে আমলে নিতে দেখিনি। একমাত্র আইএমএফ-এর ঋণ শর্তের কারণে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কথা সামান্য হলেও ভাবছে সরকার। সেই ভাবনার অংশ হিসাবে গত ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের’ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে কয়েকটি পরিবর্তন আনার জন্য একটি প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদন পেয়েছে, যা বিল আকারে সংসদে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রস্তাবটির বেশকিছু অংশ এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ ও যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। কেউ কেউ আশার আলোও দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু সত্য হলো, ঋণখেলাপি হওয়ার প্রকৃত কারণগুলো চিহ্নিত না করে অনেকটা দায়সারাভাবে আইএমএফকে কিছুটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলামের সম্প্রতি একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটি যাদের নজরে এসেছে তারা প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন এবং সেই দুরবস্থা জানার মধ্য দিয়ে নতুন করে উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত হয়েছেন।
অধ্যাপক মইনুল ইসলামের মতে, প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো নেহায়েতই কতগুলো ‘কসমেটিক পরিবর্তন’। এ পরিবর্তন দিয়ে ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাবে না। প্রস্তাবনার মধ্যে আছে, কোনো পরিবার থেকে পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনা, গাড়ি-বাড়ি ও কোম্পানির মালিকানা নেওয়ায় বাধা, ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কিছুটা সংকুচিত করা, কিছু রাজনৈতিক বিধিনিষেধ, বিদেশে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা, নতুন ঋণ নেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ইত্যাদি। অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, আসলে সমস্যার মূল জায়গাটাতে হাতই দেওয়া হয়নি। সমস্যার মূলে রয়েছে, শত শত বা হাজার হাজার খেলাপি ঋণ মামলা বছরের পর বছর অমীমাংসিতভাবে ঝুলিয়ে রাখা। এর ফলে ঋণখেলাপিরা তাদের আর্থিক ক্ষমতা, ঘুস-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে ‘খেলাপি ঋণ ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি’ অব্যাহত রাখতে পারে। এ সমস্যাটি কার্যকরভাবে মোকাবিলার কোনো প্রস্তাবিত পরিবর্তন খসড়া বিলে দেখা যাচ্ছে না।
অধ্যাপক ইসলামের মতে, বর্তমান অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিবান্ধব। ঋণখেলাপিদের প্রতি তার একধরনের দুর্বলতা কিংবা প্রীতি কাজ করে। তিনি ঋণখেলাপিদের বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক ইসলামের ভাষ্যমতে, দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন তার আমলে খেলাপি ঋণ ১ টাকাও বাড়বে না, যদিও তিনি এ চ্যালেঞ্জ রাখতে পারেননি। অতি দ্রুত তিনি যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করেছিলেন তার মধ্যে আছে-১. ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত তিন ধরনের শ্রেণিকরণের নিয়ম পরিবর্তন করে ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণ শ্রেণিকরণের নতুন নিয়ম চালু করা : এক. আগে নির্দিষ্ট মেয়াদের তিন মাস পর যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হতো, সেগুলোকে ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, নতুন নিয়মে তিন মাসের পরিবর্তে সময়টা ছয় মাস করা হয়েছে; দুই. আগে নির্দিষ্ট মেয়াদের ছয় মাসের বেশি যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হতো, সেগুলোকে ‘ডাউটফুল ঋণ’ বলা হতো, নতুন নিয়মে নয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ‘ডাউটফুল’ শ্রেণীকরণ করা হচ্ছে; তিন. আগের নিয়মে নয় মাসের বেশি কোনো ঋণ খেলাপি হলে ‘মন্দ ঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, নতুন নিয়মে সময় পরিবর্তন করে করা হয়েছে এক বছর বা তার বেশি। তার মানে হলো, কোনো পাবলিক পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪০ নম্বর পাশ মার্ক নির্ধারণ করায় ১০ জন ছাত্র ফেল করেছে। শিক্ষার উন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে পাশ মার্ক কমিয়ে ২০ নম্বর করে দেওয়া হলো। ফলে ফেলের সংখ্যা কমে গেল। কিন্তু তাতে শিক্ষার গুণগত মানের পরিবর্তন হলো কি? এভাবে ঋণখেলাপিদের সহায়তা প্রদান কাঙ্ক্ষিত নয়। অথচ ২০১২ সালের নিয়মটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোনো শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে ফিরে যায়। চার. এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দ ঋণ ‘রাইট-অফ’ বা অবলোপনের নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করল : আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দ ঋণ ‘রাইট-অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হতো, সেক্ষেত্রে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও অবলোপন করায় কোনো বাধা থাকল না। পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে সংরক্ষণ করা। ‘রাইট-অফ’ করার দুটি শর্ত হলো : ক. ওই ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্য ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, খ. যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট-অফ’ করা হয় তার সমপরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো, ওই পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। রাইট-অফ করার ফলে ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড ঋণের পরিমাণ ঠিক ততটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব নতুন নিয়ম চালু করে ক্লাসিফায়েড ঋণ কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আরেকটি ঘোষিত সুবিধা হলো, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্য আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ৫০ হাজার টাকা, সেটাকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা। পাঁচ. তারপর ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ প্রথম কিস্তিতে শোধ করলে ঋণখেলাপিকে ১০ বছর সময় দেওয়া হবে, যার মধ্যে তিন মাসের কিস্তিতে মাত্র ৭ শতাংশ বাকি ঋণ শোধ করা যাবে (পরে তিনি বলেন, সুদের হার ৯ শতাংশ হবে)।
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর শতভাগ খেলাপিদের স্বার্থরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। গত চার বছরে খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো ধরনের গতি সঞ্চারিত হয়নি। দেশের মানুষ যৌক্তিভাবেই মনে করে, এ খেলাপি ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১০টি দেশের নাম এসেছে, যেখানে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে। দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। দেশের রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। আর এ হুন্ডি প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা পাচারকারীদের জন্য সহজ হয়ে গেছে। এর সমাধান হিসাবে বিশ্লেষকরা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন, যাতে করে খেলাপি মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, দেশের ঋণগ্রহীতাদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হলো গরিব ও নিম্ন-আয়ের মানুষ, অপরটি হলো উচ্চবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির মানুষ। প্রথমটিতে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় স্বল্প আকারে এনজিওগুলো থেকে ঋণ নেওয়া হয়, দ্বিতীয়টিতে ব্যাংক থেকে বড় আকারের ঋণ নেওয়া হয়। খেলাপের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই। ক্ষুদ্রঋণের আওতায় একজন দরিদ্র মানুষ ২ হাজার টাকার খেলাপি হলে তাকে বেঁধে আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়, অপরদিকে ধনিক শ্রেণির ২ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিকে সরকারি উপর মহলের সঙ্গে পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনার করতে দেখা যায়। ধনী-গরিবের প্রতি এ বৈষম্যমূলক আচরণই কি তাহলে উন্নয়নের রোল মডেলের একমাত্র বৈশিষ্ট? এ প্রশ্ন সাধারণ জনগোষ্ঠীর।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
