ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা মোটেই অসম্ভব নয়
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর এর ভয়ংকর রূপ আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে আসলেই এর সমাধান কোথায়? আমাদের দেশে এমনিতেই ডাক্তার ও সেবিকার তীব্র সংকট যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে হাসপাতাল আর হাসপাতালে স্পেসিফিক রোগের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা স্রোতের মতো বৃদ্ধি পাওয়ায় যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই অসম্ভব। ডেঙ্গু রোগীর চাপে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে মানুষ দিশেহারা। করোনা মহামারির সময় করোনা ইউনিটে সেবাদানকারী কোনো ডাক্তার বা নার্সকে যেমন ভয় পেতাম, স্বয়ং আজরাইলকে হয়তো তেমন ভয় পেতাম না। এরূপ ডাক্তার বা নার্সকে ভাড়া বাসা থেকে বের করে দেওয়ার মতোও নিষ্ঠুর ঘটনা আমরা দেখেছি। কারণ ছিল ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। তাহলে আজ যে ভয়ংকর বাহক এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে, তাকে কীভাবে সাদরে বংশবিস্তারের সুব্যবস্থা করে দিচ্ছি? করোনার সময় নিজের জন্মদাতা বাবা ও গর্ভধারিণী মাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছি সব মানবিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে, সেখানে তার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে ওঠা ভাইরাসের লালনপালনকারী এডিস মশার প্রতি কেন এত সখ্য? প্রতিটি ধর্মই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আর ইসলাম ধর্মে তো বলাই আছে ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ’। ধর্মের প্রতিটি কথাই বৈজ্ঞানিক ও মানবতার পরিশুদ্ধতার পরিচায়ক। আমরা কি পারি না করোনার সময় যেভাবে নিজেদের এলাকায় লকডাউন করে বাইরের মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছিলাম, ঠিক একইভাবে ভাইরাস বহনকারী মশার প্রজনন ক্ষেত্র বিলুপ্ত করে মশার অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে? আমরা কি পারি না করোনার সময় যেভাবে অনেক কষ্ট করে নিজেদের মাস্ক দিয়ে আবৃত করে রেখেছিলাম, তেমন করে নিজেদের এ শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত মশারি ব্যবহার করতে? করোনার সময় যেভাবে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলাম কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত হাত ধোয়ার জন্য, একইভাবে কি পারি না প্রতিদিন একবার করে নিজ নিজ বাড়ির সামনে-পেছনে, ভেতরে-বাইরে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে? করোনার সময় আমরা যেভাবে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকিং করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে নিজেদের কমিউনিটিতে সংক্রমণের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছি, তেমনিভাবে কি আমরা পারি না সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব খেলার মাঠ, বিনোদনের জন্য পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ সব ধরনের মানুষ চলাচলের স্থাপনা আর স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে।
করোনার সময় যেভাবে আমরা মাস্ক ও পিপিই পরে জনসমাগমস্থলে না গিয়ে নিজেকে রক্ষা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি, ঠিক তেমনইভাবে কি আমরা পারি না নতুন করে গড়ে তোলা সব ইমারত ও স্থাপনার পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা জোরদার করে জমে থাকা পানির যথাযথ নিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে?
করোনাভাইরাস আমাদের অনেকটা অসামাজিক করে তুলেছিল, পারিবারিকভাবে দেখা-সাক্ষাৎ আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। বন্ধ ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, জনসংযোগ ও জনসমাগম, এমনকি সব ধর্মীয় কার্যকলাপও সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের স্বার্থেই আর আমরাও সেটা মেনে নিয়েছিলাম। এখন সেটাকে পুষিয়ে নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরস্পরকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আর এডিস মশার হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পেতে পারি তা আলোচনা করা দরকার। এভাবে কোভিড-১৯-এর সময় বাইরে থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের পরিধানকৃত কাপড়চোপড় এমনকি জুতাও আলাদাভাবে নিরাপদে রেখে সঠিকভাবে গোসল করে তারপর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি, মিশেছি। ঠিক একইভাবে যদি প্রতিদিন বাইরে থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়িতে সম্ভাব্য পানি জমে থাকার জায়গাগুলো একবার পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গোসলটা সেরে ফ্রেশ হওয়াটা কি খুবই কঠিন কাজ? মোটেও না। চাই একটু সচেতনতা। এখন যেহেতু পুরো দেশেই এডিস মশা ও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে, সেহেতু অবশ্যই স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গুর কার্ভ যেহেতু মারাত্মকভাবে ঊর্ধ্বমুখী, তাই রাজধানীসহ যেসব হটস্পট চিহ্নিত হয়েছে, সেসব জায়গায় হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে প্রয়োজন অনুসারে আমাদের চৌকশ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করার জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সক্রিয় সম্পৃক্ততায় উদ্বুদ্ধ ও প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় মৃত্যুর হারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর নির্মম ঘটনা আমাদের দেখতেই হবে।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম
