জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একাধারে রাজনীতিক, দার্শনিক, জনসেবক ও দক্ষ প্রশাসক। তার রাজনৈতিক দর্শন একদিকে যেমন আমাদের সংগ্রামের পথ দেখায়, তেমনি তার প্রশাসনিক জ্ঞান ও দক্ষতা আমাদের মুক্তির পথ বাতলে দেয়। তার ভাবনা ও দর্শন সব স্থান, কাল ও পাত্রভেদে প্রাসঙ্গিক এবং সেগুলো আমাদের আলোর পথ দেখায়। বঙ্গবন্ধুর মানবতার ভাবনা, তার বিশ্ব ও শান্তির দর্শন এবং জনসেবার মানস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তো বটেই, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর অবদান ছাড়া যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ কল্পনাতীত, তার রাষ্ট্রীয় দর্শন, মানবতার ভাবনা ও ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজের চিন্তা ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারে না। তার অনুসৃত ভাবনা আর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা বাঙালির মধ্যে ছিল না। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কী ধরনের আচরণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়, সে সম্পর্কে কোনো বাস্তব জ্ঞান ছিল না। প্রশাসনের অংশ হিসাবে কী করতে হবে, সে বিষয়টি আরও কঠিন ছিল। ফলে সরকারি কর্মচারীদের জনসেবায় অনুপ্রাণিত করা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। তাত্ত্বিকভাবে সরকারি কর্মচারী প্রত্যয়টির সঙ্গে জনসেবা শব্দটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কর্মচারীদের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের বিকাশও জনসেবার জন্য। আমলাতন্ত্রের মধ্যে কাজের বিভাজন এবং ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ সিস্টেমের উদ্ভাবন হয়েছে রাষ্ট্রের সেবাকে পদ্ধতিগতভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে আমরা যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নয়ন দেখতে পাই, সেটির বিকাশও জনসেবার লক্ষ্যে। সংবিধানে সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সেবক বলা হয়েছে এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণের সেবা করা বলে উল্লেখ আছে। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
বঙ্গবন্ধু সবসময়ই চাইতেন জনকল্যাণের ভিত্তিতে একটি আধুনিক রাষ্ট্র; যেখানে মানবাধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতা হবে অবাধ ও স্বচ্ছ। এ লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। স্বাধীনতার পর জাতি গঠন প্রক্রিয়া, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনর্গঠন, সমাজসংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও আইনি বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি জনসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের যে সংবিধান প্রণয়ন করা, সেখানে তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনমুক্তিসংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ যুক্ত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য তিনি সংবিধানে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের জনগণের সেবক বলে অভিহিত করেন এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণের সেবা করা-এটি নির্ধারণ করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, আমলা, মন্ত্রী, ডাক্তার, প্রকৌশলী সবাই জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। মেন্টালিটি আমাদের চেইঞ্জ করতে হবে। আর যাদের পয়সায় আমাদের সংসার চলে, যাদের পয়সায় আমরা গাড়ি চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রল খরচ করি, আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম সেটাই আজ বড় জিনিস।’ ১৯৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। ‘সরকারি কর্মচারীগণ জনগণের সেবক’ শীর্ষক ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।’
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ থেকে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, সরকারি কর্মচারীকে জনগণের সেবক বলার মাধ্যমে তিনি আমলাদের উপর জনগণকে স্থান দিয়েছেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ জনগণের সেবা ও কল্যাণ সাধন সেটি প্রমাণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে জনগণের কাছে সরকারি কর্মচারী ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন হয় ও রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহ হয়। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও রাষ্ট্র নিজে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে বলেছিলেন। তৃতীয়ত, দায়বদ্ধতার মাধ্যমে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। চতুর্থত, ‘আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়’-এ উক্তির মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের কথা বলেছিলেন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। পঞ্চমত, তিনি অত্যন্ত জোরালোভাবে উল্লেখ করেন, সব আইনের উৎস জনগণ। প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র যাতে আইন তাদের হাতে নিতে না পারে, সে লক্ষ্যে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়।’ ষষ্ঠত, ‘সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’-এ বিষয়টি তিনি বারবার কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তার ভাষণে। সপ্তমত, স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে যেন কেউ বিচ্যুত না হয়, সেজন্য তিনি উদাত্ত কণ্ঠে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল, আমার অনুরোধ রইল, আমার আদেশ রইল, আপনারা মানুষের সেবা করুন।’
বঙ্গবন্ধু সরকারের নীতি ছিল স্বাধীনতার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আর এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা দরকার সরকারি কর্মচারীদের। এজন্য তিনি সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেন জনগণের সঙ্গে মিশে কাজ করার মাধ্যমে তাদের আত্মত্যাগের প্রতিদান দিতে। তিনি স্বদেশের কল্যাণে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও সততার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। জনসাধারণের কল্যাণ সাধন না করে যারা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ সন্ধান করছে, তাদেরও কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে উপলব্ধি করেছিলেন, আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অন্যতম বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছিল দৃঢ় অবস্থান। বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতিতে ও লেখায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন। আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান, করাপশন। খাদ্য কিনতে যান, করাপশন। জিনিস কিনতে যান, করাপশন। বিদেশে গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে।’
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও সামাজিক সমতার নীতিতে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুস্থ, জ্ঞানভিত্তিক, চেতনাসমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন, শোষণহীন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মানুষের উন্নত-সমৃদ্ধ এক আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তার ভাবনার জগৎজুড়ে ছিল বাঙালির মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও উন্নয়ন এবং বৈষম্যহীন একটি সোনার বাংলা। এজন্য বঙ্গবন্ধু জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বাঙালি জাতির জন্য একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে দিতে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই তিনি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের স্বকীয় অস্তিত্বের জানান দেন। জনসেবাকেন্দ্রিক বঙ্গবন্ধুর ভাবনা তাকে জ্ঞান ও মেধাভিত্তিক একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়