আশেপাশে চারপাশে
জনগণের মঙ্গলই হোক সর্বোচ্চ আইন
চপল বাশার
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আর চার মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যে কোনোদিন নির্বাচন হবে। তফসিল ঘোষণা করা হবে অক্টোবরে। নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে।
নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ততই বাড়ছে। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি এক বছর আগেই আন্দোলনে নেমেছে। গত ডিসেম্বর থেকে বিএনপি সমমনা দল ও জোট নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া শুরু করেছে। বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচি এখন পর্যন্ত জনসমাবেশ ও মিছিলে সীমিত আছে। গত ২৯ জুলাই ঢাকার পাঁচ প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিও নিয়েছিল তারা। তেমন সাড়া পায়নি।
আওয়ামী লীগও বসে নেই। তারা বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে পালটা কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতেও ছিল জনসমাবেশ, মিছিল বা বিক্ষোভ মিছিল। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ইস্যু হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত প্রতিরোধ। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সব নেতাই বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তারা মানবেন না। আসন্ন সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত যদি সন্ত্রাসের পথে যায়, বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তাদের আর রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না।
দুই দলের কর্মসূচি চলছেই
আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা করেছিল, শোকের মাস আগস্টে তারা কোনো বিক্ষোভ বা আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করবে না। কিন্তু বিএনপি তাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখায় আওয়ামী লীগও ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে এবং করছে। ২৫ আগস্ট বিএনপি রাজধানী ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণে তাদের দাবির সমর্থনে ‘কালো পতাকার গণমিছিল’ করেছে। দুটি মিছিলেই যথেষ্টসংখ্যক কালো পতাকা ও ব্যানার ছিল, লোকসমাগমও ভালোই ছিল। তবে মিছিলে অংশগ্রহণকারী সবাই ছিলেন বিএনপির কর্মী, ক্যাডার ও সমর্থক। জনগণ বা সাধারণ মানুষ ছিল না।
পালটা কর্মসূচি হিসাবে আওয়ামী লীগ ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। সেখানে লোকসমাগম ছিল মোটামুটি ভালো। বিশাল নয়। দলীয় কর্মী, সমর্থক, ক্যাডাররাই সমাবেশস্থল পূর্ণ করেছিলেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীরা রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে সতর্ক অবস্থানে ছিলেন, যাতে বিএনপি-জামায়াত কোনো অঘটন না ঘটায়। সেদিন দুই দলের কর্মসূচিই শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে গেছে। কোথাও অবাঞ্ছিত কিছু ঘটেনি। তদুপরি দিনটি ছিল শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই রাজপথে ভয়াবহ যানজট হয়নি।
আওয়ামী লীগ তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের মহাসমাবেশ হবে। সেখানে সারা দেশ থেকে পাঁচ লাখ ছাত্রছাত্রী জমায়েত করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। পরদিন ২ সেপ্টেম্ব আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্যমেলা মাঠে আওয়ামী লীগ ‘সুধী সমাবেশ’ করবে। উভয় কর্মসূচিতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন। এ দুই অনুষ্ঠানে ব্যাপক জনসমাবেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শোডাউন করে তাদের শক্তি প্রদর্শন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপি ওই সময়ে কী করবে এখনো কিছু বলেনি।
আন্দোলন, পালটা আন্দোলন
জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বাড়বে, তারা সভা-সমাবেশ-মিছিল করবে। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে নির্বাচনি প্রচার চালাবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বেড়েছে ঠিকই, দলগুলো সভা-সমাবেশ-মিছিল করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে; কিন্তু এটা নির্বাচনি তৎপরতা নয়। এটি আন্দোলন ও পালটা আন্দোলন। ইস্যু হচ্ছে নির্বাচনের পদ্ধতি। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করবেন না। অনেক নেতা বলতে শুরু করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’ কীভাবে তারা নির্বাচন প্রতিহত করবেন তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন, আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
আন্দোলনের তীব্রতা বিএনপি কতদূর নিয়ে যাবে বা নিতে পারবে, সেটি না বললেও অনুমান করা যায়। তারা হয়তো অবস্থান ধর্মঘট, ঘেরাও বা হরতাল পর্যন্ত করার চেষ্টা করতে পারে, যা অতীতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কি নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে? তাদের দলও শক্তিশালী। তাহলে তো সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যা জনগণের কাম্য নয়। হরতাল মানুষের জন্য কতটা দুর্ভোগ সৃষ্টি করে সে অভিজ্ঞতা দেশবাসীর রয়েছে। জনগণ কেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির কারণে দুর্ভোগ পোহাবে? এমন দুর্ভোগের কারণেই জনগণ রাজনৈতিক দল ও রাজনীতির ওপর আস্থা হারায়।
মানুষ যাবে কোথায়?
রাজনৈতিক সংকট ছাড়াও দেশ এখন সার্বিকভাবে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিুবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সব মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছর করোনা মহামারি জনজীবন কার্যত অচল করে রেখেছিল। করোনা বিদায় হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গু মহামারি, যা এখনো চলছে। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি করোনা-ডেঙ্গুর প্রকোপ, মানুষ যাবে কোথায়? এর ওপর যদি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়, তাহলে জনগণ পুরোপুরি রাজনীতিবিমুখ হবে। সেটি কি রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ভালো হবে?
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। ঢাকার বাইরে আরও কয়েকটি উপনির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি যথেষ্ট ছিল না। মানুষ যে নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়ছে এবং এটি যে রাজনীতিবিমুখতার পূর্বলক্ষণ, তা সহজেই বোধগম্য। জনগণ যদি রাজনীতির সঙ্গে না থাকে, নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাহলে রাজনৈতিক নেতারা কাদের নিয়ে নির্বাচন করবেন, কীভাবে ক্ষমতায় যাবেন? দলীয় কর্মী-ক্যাডার ও সমর্থক নিয়ে রাজপথে শোডাউন করলেই বলা যাবে না যে এ দলটি জনপ্রিয়। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কয়েক লাখ কর্মী-ক্যাডারকে রাস্তায় নামাতে পারে, কিন্তু তারাই সব নয়। তারা জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষমতার উৎস জনগণ, ১৭ কোটি মানুষ। জনগণ যদি সঙ্গে না থাকে, সেই রাজনীতি অর্থহীন, কখনোই তা ফলপ্রসূ হয় না। জনগণের শক্তি কত বেশি, তা অতীতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
জনগণের মঙ্গল চাই
রাজনীতি করতে হলে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে, জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুইজারল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবনের সদর দুয়ারের উপরে রোমান দার্শনিক মার্কাস টুলিয়াস সিসেরোর একটি বিখ্যাত উক্তি লেখা আছে। সেটা হচ্ছে Salus Publica Suprema Lex Esto. লাতিন ভাষায় লেখা উদ্ধৃতির বঙ্গানুবাদ হচ্ছে : ‘জনগণের মঙ্গলই হোক সর্বোচ্চ আইন’। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপলব্ধি করতে হবে সিসেরোর উল্লিখিত উক্তির মর্মার্থ। এটাই হতে হবে রাজনীতির দিকনির্দেশক। জনগণের মঙ্গলই রাজনীতির শেষকথা।
সংঘাত নয়, সমঝোতা
রাজনীতিকরা যদি সত্যিই জনগণের মঙ্গল চান, তাহলে তাদের সংঘাত-সহিংসতার পথে না গিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে। কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়, যদি সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকে। যুক্তিসংগত কারণেই আওয়ামী লীগের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এখন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়; কারণ, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী বিষয়টি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে একটি ছোট আকারের নির্দলীয় বা বহুদলীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে নির্বাচনকালীন স্বল্প সময়ের জন্য। এ সরকারের কাজ হবে রুটিন ও দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাওয়া। নির্বাচনে এ অস্থায়ী সরকার কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করবে না। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য। এসব ব্যবস্থা থাকলেই ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন সম্ভব হতে পারে, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
যা বলা হলো, তা একটি পরামর্শ বা প্রস্তাব মাত্র। সংশ্লিষ্ট মহল ভেবে দেখতে পারে এবং আরও ভালো ও উন্নত ফর্মুলা দিতে পারে, যাতে একটি সমাধানে পৌঁছানো যায়। আসল কথা হচ্ছে, প্রধান দুই দলকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সমঝোতায় আসতে হবে। এটি করতে হবে জনগণের মঙ্গলের স্বার্থে।
চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com