পয়েন্ট অব নো রিটার্নের আন্দোলন ঝড়ো না হলে থিতিয়ে যায়
দিন কয়েক আগে কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম। একজন মাঝবয়সি সবজি বিক্রেতা, কেনাকাটার সূত্রে আমার পরিচিত; প্রশ্ন করলেন, স্যার বিএনপির আন্দোলন কি শেষ হয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? ভদ্রলোক বললেন-না, আগে তো দেখেছি জেলায় জেলায় বড় বড় মিছিল করেছে বিএনপি। ঢাকাতেও করেছে। এখন আওয়ামী লীগও বড় বড় মিছিল করে। বিএনপির তোড়জোড় কি আগের মতো আছে? প্রায় কাছাকাছি প্রসঙ্গে কিছু দিন আগে কথা হচ্ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। যৌবনে তিনি বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন আর রাজনীতিতে আগ্রহ নেই। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে অবসরটা ভালোই কাটছে। তিনি বেশ মজার মানুষ; বললেন বামরা তো আদর্শচ্যুত হয়ে গেছে। দেখেন না স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষক এবং কিছুকাল আগে স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে একটেবিলে বসে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার আশায় ঘাম ঝরিয়েছেন আমাদের বাম ব্রাদাররা। তারা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলন করছেন না কেন? অবশ্য সমমনা দল পাবেনইবা কোথায়!
সাবেক এ শিক্ষক বিএনপি ও এর সমমনাদের আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না। আমি জানতে চাইলাম কেন? বললেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে রিদম কোথায়! চালুনি আর ঝাঁঝরের মধ্যে পছন্দ করার কোনো অপশন থাকে না। আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বেশ কতগুলো সাফল্য রয়েছে। এসব গুণের কথা বাদ দিয়ে দোষ ধরতে গেলেও কম ধরা যাবে না। চালুনি দিয়ে চাললে অনেক দোষ ও ব্যর্থতার বিষ টপটপ করে পড়বে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃতাধীন চারদলীয় জোট সরকারের দীর্ঘ ক্ষমতাকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে দলটির ছিল ঝাঁঝর-আচরণ। অন্যায়-অবিচার আর দুঃশাসনের বিষ সেখান থেকেও প্রচুর নির্গত হয়েছে। তাহলে মানুষ কোন ভরসায় চালুনি থেকে বাঁচতে ঝাঁঝরকে কাছে টেনে নেবে? মন্দের ভালো খুঁজতে গেলে সরকার পরিবর্তনে তাদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। তাছাড়া বিএনপি নেতারা নির্বাচনে যেতে চাইছেন, ভাব দেখে মনে হচ্ছে না।
এবার আমার এক সাবেক ছাত্রের জবানিতে আসি; ক্যাম্পাস জীবনে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিল। দলীয় নেতাকর্মীরা সাধারণত আফিমের ঘোরে থাকেন। অনেককাল পর্যন্ত সেই ঘোর থেকে যায়। নিজ দলের অন্যায় চোখে দেখলেও মনে জায়গা দিতে চান না। দল অন্তঃপ্রাণ এ ছেলেটি সরকারি চাকুরে হওয়ায় ওর দলপ্রীতি এখন প্রকাশ্য নয়। আমি আগ্রহভরে জানতে চাইলাম, ওদের সরকার পতনের আন্দোলনের বর্তমান গতি-প্রকৃতি কেমন? খুব হতাশা প্রকাশ পেল ওর কণ্ঠে। দলের কর্মসূচির প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দেখতে পায় ও। মুখে যতই গণআন্দোলন ও সাধারণ মানুষের কথা নেতারা বলুন না কেন-ওই অর্থে তারা দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেননি। সাধারণ মানুষের আন্তরিক সম্পৃক্ততা ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো দল ও সরকারি শক্তির বিরুদ্ধে সফল হওয়া কঠিন।
আমাদের মনে হয়, বিএনপির আন্দোলন ও এর পরিণতি নিয়ে ভাবতে গেলে এ তিনটি উদাহরণই যথেষ্ট। আন্দোলনের অপরিণত শিশুকে ইনকিউবিটরে রেখে একদফার মতো পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ধারার আন্দোলনের অন্তিম হাঁকডাক অসাড় তর্জন-গর্জনই বলা যাবে। আমরা ১৯৬৯ আর ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছি। সে সময়ের আন্দোলনগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন। দল-মত নির্বিশেষে দেশের বেশির ভাগ মানুষ সরকারের পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। তাই তারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আজ বিএনপি নেতারা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, মানুষ সরকার পরিবর্তন চায় আর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ঘটাবেন, তখন সেই সবজি বিক্রেতার বক্তব্য সামনে চলে আসে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি এ সবজি বিক্রেতাদের ধারণাই নেই আন্দোলন এখন কোন পর্যায়ে আছে। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া তো দূরের কথা। আর যদি প্রবীণ স্কুলশিক্ষকের উপমা গ্রহণ করি, তাহলে রাজনীতিতে চালুনি আর ঝাঁঝর এর মধ্যে পার্থক্য কী! এ অবস্থায় মাঠের রাজনীতিতে জীবনপাত করার আগ্রহ কি সাধারণ মানুষের থাকার কথা?
এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি আগেও আশঙ্কার সঙ্গে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় ও অভিজ্ঞ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শানাতে হলে ধাপে ধাপে কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল। আন্দোলন যৌক্তিক ভিত্তিতে থাকলে ধীরে ধীরে জনসম্পৃক্ততা বাড়ত। সরকার পতনের একদফা আন্দোলন তো হবে শেষ ধাক্কা। এ ধাক্কা সফল হয় আন্দোলন ঝড়ো গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পর। এটি হওয়ার কথা বিমান আকাশে ওঠার আগে রানওয়েতে শেষ তীব্র দৌড়ের মতো। দৌড়ের মাঝপথে থেমে যাওয়ার মতো বিরতি নিলে কি আর আকাশে ওড়ার সাফল্য পাওয়া সম্ভব? বিএনপির এখন চলছে বিরতিযুক্ত সরকার পতনের আন্দোলন। আন্দোলন জমানোর আগেই সূচনায় একদফার আন্দোলনের অর্থ কী? এসব কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, ছাত্রদলের সাবেক কর্মী ছাত্রটির মতো হতাশা এখন বিএনপি সমর্থক অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে।
অনেক উত্থান-পতনের পর এক যুগেরও আগে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সরকারের সামনে অনুকূল অবস্থা ছিল। প্রধান বিরোধী দল তখন অনেকটা কোণঠাসা। জামায়াতে ইসলামী দলটিও নানা দুর্বিপাকে। সরকারের আস্থায় ছিল জাতীয় পার্টি। তখন আমরা যারা কাগজে লেখালেখি করে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এবারই সরকারের মাহেন্দ্রক্ষণ দলতন্ত্রে আটকে না থেকে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। সরকারবিরোধীদের সবল উপস্থিতি না থাকায় সরকার এবারই পারবে দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য শক্ত হাতে প্রশাসন পরিচালনা করতে। দলতন্ত্রের কণ্টকময় বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে এসে একটি সর্বজনীন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে। এমনটি হলে আওয়ামী লীগের ভিত্তি অনেক বেশি শক্ত হতো। এতে করে বিরোধী শক্তির বিরোধিতা তেমন কোনো সংকটে ফেলত না আওয়ামী লীগ এবং এর সরকারকে। আমরা অবশ্য আশাও করি না, এমন অভাজনদের কথা জ্ঞানী রাজনীতিকরা আমলে আনবেন।
তাই দেখলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-আদর্শে তেমন পরিবর্তন এলো না। কঠিন দলতন্ত্রে নিজেদের বন্দি করে ফেলল। অনেকটা প্রাচীন স্পার্টার রাজাদের মতো। এরা স্পার্টার ক্ষমতা দখল করে স্থানীয় মানুষ-যারা হেলট নামে পরিচিত, তাদের ওপর অত্যাচারের খড়্গ চালাতে থাকে। হেলটদের অভ্যুত্থানের ভয়ে এমন সব কঠিন নীতি অবলম্বন করে যে, ইতিহাসবিদদের ভাষায় প্রকারান্তরে রাজারাই নিজেদের জালে যেন বন্দি হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগের অবস্থাও অনেকটা তেমন। সাধারণ মানুষের সামনে সুযোগ থাকার পরও উন্মুক্ত না হওয়ায় দলতন্ত্রের গণ্ডিতেই বন্দি হয়ে পড়ল। এ কারণে ক্ষমতায় থেকে অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিএনপির আন্দোলনেও ঘাম ঝরাতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদের।
বিএনপি কিন্তু এখনো তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি বা অপরাধ খণ্ডনের জন্য যোগ্য জবাব দিতে পারেনি। জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থি শাহ আজিজুর রহমানকে কেন স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এর উত্তর পাওয়া যায়নি। গোপন বিচারে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধসমর্থক সেনা কর্মকর্তাদের কেন হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান, এর উত্তর বিএনপি নেতারা দিতে পারেননি। ক্ষমতায় থেকেও ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ও ঘৃণ্য হত্যার বিচার করেননি রাষ্ট্রপতি জিয়া। বরঞ্চ হত্যাকারীদের যাতে বিচার না করা যায়, তার জন্য ইনডেমনিটি জারি করেন। পাশাপাশি হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেন বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে। এর জবাবও জাতি এ পর্যন্ত বিএনপির কাছ থেকে পায়নি।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-আলবদররা কেন জেলখানার বদলে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেল? পাকিস্তানপন্থিরা কেন রাষ্ট্রীয় আদর-আপ্যায়ন গ্রহণ করতে পারল-এর জবাবও দিতে পারেনি বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে বিএনপি আন্দোলনে আওয়াজ তুলছে, বিএনপি সরকারের সময়ে সেসব অপকর্ম কি চালু ছিল না? বিএনপি সরকারের তত্ত্বাবধানে ভোট চুরি-ভোট ডাকাতি কি হয়নি? দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হয়নি কি বাংলাদেশ? ফখরুদ্দীন আহমদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কি বিএনপি নেতা-মন্ত্রীদের ভয়ানক দুর্নীতির খতিয়ান মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়নি?
সুতরাং, যার যার আমলনামার জবাব একদিন তাদেরই দিতে হবে। আজ বিএনপির সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ঢেউ এসব কারণে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছা খুব কঠিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোচালকের দর্শনকে কি উপেক্ষা করতে পারি? তিনি বলেছেন, বিএনপি নেতারা যে বলেন, মেগা প্রকল্প নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা মেগা দুর্নীতি করছেন; বিএনপি আমলেও তো এ দলের নেতারা মেগা দুর্নীতি করেছেন, তখন দেশের উল্লেখযোগ্য তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করলেও বড় বড় উন্নয়নও করেছে। যার সুফল মানুষ ভোগ করছে। চেটেপুটে খেয়ে কিছু না করার চেয়ে নিজেদের পেট ভরার পর দেশের ও জনগণের কল্যাণে কিছু করা অনেক ভালো। তাই আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করলেও বিএনপির ডাকে মানুষ সাড়া দেবে কেন?
তার পরও মানতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-দুর্নীতির ফাটলকে ব্যবহার করে বিএনপির আন্দোলন অনেক দূর এগোতে পারত। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে তা এখন সন্দেহের দোলাচলে দুলছে। একদফার মতো সরকার পতনের আন্দোলন এক নিঃশ্বাসে ঝড়োগতিতে এগিয়ে লক্ষ্য ভেদ করার কথা; কিন্তু বিরতি নিয়ে নিয়ে এমন আন্দোলন একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, অন্যদিকে হতাশ করে তোলে দলীয় নেতাকর্মীদের। বিএনপি নেতারা কি এমন সংকট কাটাতে পারবেন?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
পয়েন্ট অব নো রিটার্নের আন্দোলন ঝড়ো না হলে থিতিয়ে যায়
এ কে এম শাহনাওয়াজ
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দিন কয়েক আগে কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম। একজন মাঝবয়সি সবজি বিক্রেতা, কেনাকাটার সূত্রে আমার পরিচিত; প্রশ্ন করলেন, স্যার বিএনপির আন্দোলন কি শেষ হয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? ভদ্রলোক বললেন-না, আগে তো দেখেছি জেলায় জেলায় বড় বড় মিছিল করেছে বিএনপি। ঢাকাতেও করেছে। এখন আওয়ামী লীগও বড় বড় মিছিল করে। বিএনপির তোড়জোড় কি আগের মতো আছে? প্রায় কাছাকাছি প্রসঙ্গে কিছু দিন আগে কথা হচ্ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। যৌবনে তিনি বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন আর রাজনীতিতে আগ্রহ নেই। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে অবসরটা ভালোই কাটছে। তিনি বেশ মজার মানুষ; বললেন বামরা তো আদর্শচ্যুত হয়ে গেছে। দেখেন না স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষক এবং কিছুকাল আগে স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে একটেবিলে বসে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার আশায় ঘাম ঝরিয়েছেন আমাদের বাম ব্রাদাররা। তারা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলন করছেন না কেন? অবশ্য সমমনা দল পাবেনইবা কোথায়!
সাবেক এ শিক্ষক বিএনপি ও এর সমমনাদের আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না। আমি জানতে চাইলাম কেন? বললেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে রিদম কোথায়! চালুনি আর ঝাঁঝরের মধ্যে পছন্দ করার কোনো অপশন থাকে না। আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বেশ কতগুলো সাফল্য রয়েছে। এসব গুণের কথা বাদ দিয়ে দোষ ধরতে গেলেও কম ধরা যাবে না। চালুনি দিয়ে চাললে অনেক দোষ ও ব্যর্থতার বিষ টপটপ করে পড়বে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃতাধীন চারদলীয় জোট সরকারের দীর্ঘ ক্ষমতাকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে দলটির ছিল ঝাঁঝর-আচরণ। অন্যায়-অবিচার আর দুঃশাসনের বিষ সেখান থেকেও প্রচুর নির্গত হয়েছে। তাহলে মানুষ কোন ভরসায় চালুনি থেকে বাঁচতে ঝাঁঝরকে কাছে টেনে নেবে? মন্দের ভালো খুঁজতে গেলে সরকার পরিবর্তনে তাদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। তাছাড়া বিএনপি নেতারা নির্বাচনে যেতে চাইছেন, ভাব দেখে মনে হচ্ছে না।
এবার আমার এক সাবেক ছাত্রের জবানিতে আসি; ক্যাম্পাস জীবনে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিল। দলীয় নেতাকর্মীরা সাধারণত আফিমের ঘোরে থাকেন। অনেককাল পর্যন্ত সেই ঘোর থেকে যায়। নিজ দলের অন্যায় চোখে দেখলেও মনে জায়গা দিতে চান না। দল অন্তঃপ্রাণ এ ছেলেটি সরকারি চাকুরে হওয়ায় ওর দলপ্রীতি এখন প্রকাশ্য নয়। আমি আগ্রহভরে জানতে চাইলাম, ওদের সরকার পতনের আন্দোলনের বর্তমান গতি-প্রকৃতি কেমন? খুব হতাশা প্রকাশ পেল ওর কণ্ঠে। দলের কর্মসূচির প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দেখতে পায় ও। মুখে যতই গণআন্দোলন ও সাধারণ মানুষের কথা নেতারা বলুন না কেন-ওই অর্থে তারা দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেননি। সাধারণ মানুষের আন্তরিক সম্পৃক্ততা ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো দল ও সরকারি শক্তির বিরুদ্ধে সফল হওয়া কঠিন।
আমাদের মনে হয়, বিএনপির আন্দোলন ও এর পরিণতি নিয়ে ভাবতে গেলে এ তিনটি উদাহরণই যথেষ্ট। আন্দোলনের অপরিণত শিশুকে ইনকিউবিটরে রেখে একদফার মতো পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ধারার আন্দোলনের অন্তিম হাঁকডাক অসাড় তর্জন-গর্জনই বলা যাবে। আমরা ১৯৬৯ আর ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছি। সে সময়ের আন্দোলনগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন। দল-মত নির্বিশেষে দেশের বেশির ভাগ মানুষ সরকারের পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। তাই তারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আজ বিএনপি নেতারা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, মানুষ সরকার পরিবর্তন চায় আর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ঘটাবেন, তখন সেই সবজি বিক্রেতার বক্তব্য সামনে চলে আসে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি এ সবজি বিক্রেতাদের ধারণাই নেই আন্দোলন এখন কোন পর্যায়ে আছে। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া তো দূরের কথা। আর যদি প্রবীণ স্কুলশিক্ষকের উপমা গ্রহণ করি, তাহলে রাজনীতিতে চালুনি আর ঝাঁঝর এর মধ্যে পার্থক্য কী! এ অবস্থায় মাঠের রাজনীতিতে জীবনপাত করার আগ্রহ কি সাধারণ মানুষের থাকার কথা?
এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি আগেও আশঙ্কার সঙ্গে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় ও অভিজ্ঞ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শানাতে হলে ধাপে ধাপে কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল। আন্দোলন যৌক্তিক ভিত্তিতে থাকলে ধীরে ধীরে জনসম্পৃক্ততা বাড়ত। সরকার পতনের একদফা আন্দোলন তো হবে শেষ ধাক্কা। এ ধাক্কা সফল হয় আন্দোলন ঝড়ো গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পর। এটি হওয়ার কথা বিমান আকাশে ওঠার আগে রানওয়েতে শেষ তীব্র দৌড়ের মতো। দৌড়ের মাঝপথে থেমে যাওয়ার মতো বিরতি নিলে কি আর আকাশে ওড়ার সাফল্য পাওয়া সম্ভব? বিএনপির এখন চলছে বিরতিযুক্ত সরকার পতনের আন্দোলন। আন্দোলন জমানোর আগেই সূচনায় একদফার আন্দোলনের অর্থ কী? এসব কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, ছাত্রদলের সাবেক কর্মী ছাত্রটির মতো হতাশা এখন বিএনপি সমর্থক অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে।
অনেক উত্থান-পতনের পর এক যুগেরও আগে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সরকারের সামনে অনুকূল অবস্থা ছিল। প্রধান বিরোধী দল তখন অনেকটা কোণঠাসা। জামায়াতে ইসলামী দলটিও নানা দুর্বিপাকে। সরকারের আস্থায় ছিল জাতীয় পার্টি। তখন আমরা যারা কাগজে লেখালেখি করে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এবারই সরকারের মাহেন্দ্রক্ষণ দলতন্ত্রে আটকে না থেকে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। সরকারবিরোধীদের সবল উপস্থিতি না থাকায় সরকার এবারই পারবে দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য শক্ত হাতে প্রশাসন পরিচালনা করতে। দলতন্ত্রের কণ্টকময় বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে এসে একটি সর্বজনীন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে। এমনটি হলে আওয়ামী লীগের ভিত্তি অনেক বেশি শক্ত হতো। এতে করে বিরোধী শক্তির বিরোধিতা তেমন কোনো সংকটে ফেলত না আওয়ামী লীগ এবং এর সরকারকে। আমরা অবশ্য আশাও করি না, এমন অভাজনদের কথা জ্ঞানী রাজনীতিকরা আমলে আনবেন।
তাই দেখলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-আদর্শে তেমন পরিবর্তন এলো না। কঠিন দলতন্ত্রে নিজেদের বন্দি করে ফেলল। অনেকটা প্রাচীন স্পার্টার রাজাদের মতো। এরা স্পার্টার ক্ষমতা দখল করে স্থানীয় মানুষ-যারা হেলট নামে পরিচিত, তাদের ওপর অত্যাচারের খড়্গ চালাতে থাকে। হেলটদের অভ্যুত্থানের ভয়ে এমন সব কঠিন নীতি অবলম্বন করে যে, ইতিহাসবিদদের ভাষায় প্রকারান্তরে রাজারাই নিজেদের জালে যেন বন্দি হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগের অবস্থাও অনেকটা তেমন। সাধারণ মানুষের সামনে সুযোগ থাকার পরও উন্মুক্ত না হওয়ায় দলতন্ত্রের গণ্ডিতেই বন্দি হয়ে পড়ল। এ কারণে ক্ষমতায় থেকে অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিএনপির আন্দোলনেও ঘাম ঝরাতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদের।
বিএনপি কিন্তু এখনো তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি বা অপরাধ খণ্ডনের জন্য যোগ্য জবাব দিতে পারেনি। জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থি শাহ আজিজুর রহমানকে কেন স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এর উত্তর পাওয়া যায়নি। গোপন বিচারে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধসমর্থক সেনা কর্মকর্তাদের কেন হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান, এর উত্তর বিএনপি নেতারা দিতে পারেননি। ক্ষমতায় থেকেও ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ও ঘৃণ্য হত্যার বিচার করেননি রাষ্ট্রপতি জিয়া। বরঞ্চ হত্যাকারীদের যাতে বিচার না করা যায়, তার জন্য ইনডেমনিটি জারি করেন। পাশাপাশি হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেন বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে। এর জবাবও জাতি এ পর্যন্ত বিএনপির কাছ থেকে পায়নি।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-আলবদররা কেন জেলখানার বদলে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেল? পাকিস্তানপন্থিরা কেন রাষ্ট্রীয় আদর-আপ্যায়ন গ্রহণ করতে পারল-এর জবাবও দিতে পারেনি বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে বিএনপি আন্দোলনে আওয়াজ তুলছে, বিএনপি সরকারের সময়ে সেসব অপকর্ম কি চালু ছিল না? বিএনপি সরকারের তত্ত্বাবধানে ভোট চুরি-ভোট ডাকাতি কি হয়নি? দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হয়নি কি বাংলাদেশ? ফখরুদ্দীন আহমদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কি বিএনপি নেতা-মন্ত্রীদের ভয়ানক দুর্নীতির খতিয়ান মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়নি?
সুতরাং, যার যার আমলনামার জবাব একদিন তাদেরই দিতে হবে। আজ বিএনপির সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ঢেউ এসব কারণে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছা খুব কঠিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোচালকের দর্শনকে কি উপেক্ষা করতে পারি? তিনি বলেছেন, বিএনপি নেতারা যে বলেন, মেগা প্রকল্প নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা মেগা দুর্নীতি করছেন; বিএনপি আমলেও তো এ দলের নেতারা মেগা দুর্নীতি করেছেন, তখন দেশের উল্লেখযোগ্য তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করলেও বড় বড় উন্নয়নও করেছে। যার সুফল মানুষ ভোগ করছে। চেটেপুটে খেয়ে কিছু না করার চেয়ে নিজেদের পেট ভরার পর দেশের ও জনগণের কল্যাণে কিছু করা অনেক ভালো। তাই আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করলেও বিএনপির ডাকে মানুষ সাড়া দেবে কেন?
তার পরও মানতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-দুর্নীতির ফাটলকে ব্যবহার করে বিএনপির আন্দোলন অনেক দূর এগোতে পারত। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অদূরদর্শিতার কারণে তা এখন সন্দেহের দোলাচলে দুলছে। একদফার মতো সরকার পতনের আন্দোলন এক নিঃশ্বাসে ঝড়োগতিতে এগিয়ে লক্ষ্য ভেদ করার কথা; কিন্তু বিরতি নিয়ে নিয়ে এমন আন্দোলন একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, অন্যদিকে হতাশ করে তোলে দলীয় নেতাকর্মীদের। বিএনপি নেতারা কি এমন সংকট কাটাতে পারবেন?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023