Logo
Logo
×

বাতায়ন

নেতৃত্বের প্রশ্নেই যত সমস্যা

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নেতৃত্বের প্রশ্নেই যত সমস্যা

সপ্তাহ দুই আগে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। দুদিনের পরীক্ষা, তাই রাত যাপন করতে হবে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল শহরে একটি বড় এনজিওর রেস্টহাউজে। রাজধানী এবং নানা অঞ্চল থেকে আসা এনজিও কর্মকর্তারা এখানে যাত্রাবিরতি দেন। এমন একজন কর্মকর্তা আমাকে জানতেন। তাই আমি এসেছি জেনে আলাপ করতে আমার কক্ষে এলেন। মধ্যবয়সি কাওসার আহমদ সাহেব একসময় শিক্ষকতা করতেন, এখন পুরোদস্তুর এনজিও কর্মী। আমার লেখালেখির সঙ্গে নাকি তার অনেকদিনের পরিচয়। তাই আমার সঙ্গে কথা বলতে আসা।

যে কোনো আলাপচারিতায় বাঙালির প্রিয় প্রসঙ্গ রাজনীতি আসবেই। আর এখন তো নির্বাচনি মৌসুম। কাওসার সাহেব রাজনীতিসচেতন মানুষ। তবে বিশেষ কোনো দলীয় রাজনীতির প্রতি তার মোহ নেই। বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। বছর কয়েক আগে মারা গেছেন তিনি। কাওসার সাহেবের এ সময়ের চলমান চিন্তাই আজকের লেখার প্রধান উপজীব্য বিষয়।

রাজনীতি প্রসঙ্গ আসতেই তিনি যে আক্ষেপ করলেন, তা আমার চিন্তার সঙ্গে খুব মিলে গেল। আমি জানি, মোহমুক্ত অনেকের সঙ্গেই মিলবে। বললেন, রাজনীতির মাঠে আমাদের তো তেমন কোনো অপশন নেই। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া-আসার পথে হয় আওয়ামী লীগকে, না হয় বিএনপিকে সমর্থন দিতে হবে। বিএনপি তো ভুঁইফুঁড়ে বেরোনো দল। জন্ম থেকেই নানারকম কেলেঙ্কারি জড়িয়ে আছে দলটির সঙ্গে। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ছেলে হিসাবে আমার পক্ষে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়াটা কঠিন। দীর্ঘকাল পারিবারিকভাবেই সমর্থন দিয়ে এসেছি আওয়ামী লীগকে। কিন্তু এখন খুব সংকটে পড়েছি। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিচারে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। দেখলাম কাওসার সাহেবের মুখটি খুব বিমর্ষ হয়ে গেল। আমি কারণ জানতে চাইলাম। বললেন-দল, দলীয় নেতা আর মন্ত্রী-এমপিদের ওপর প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির তেমন নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আদর্শিক ঐক্য রয়েছে, কিন্তু একেবারে দলীয় নন এমন সব জ্ঞানী মানুষেরও সহযোগিতা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। অথবা আত্মম্ভরিতা ও দলীয়করণে অন্ধ আওয়ামী লীগ নেতারা থোড়াই কেয়ার করেন এসব জ্ঞানী মানুষকে। এসব কারণে ভুল শিক্ষানীতি একটি জ্ঞানহীন পরিবেশ তৈরি করছে প্রতিদিন। আমি বিশ্বাস করি, এ ধারার অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে কোনো উন্নয়নই স্থায়িত্ব পাবে না। কাওসার সাহেবের মতে শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ক্যারিশমার জন্য এখনো আওয়ামী লীগ অখণ্ড অবস্থায় আছে।

কাওসার সাহেব অসহায়ের মতো বললেন, বিশ্বাস ছিল কিছুটা ঘাত-প্রতিঘাত কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪-এর পর ক্ষমতায় এসে সুশাসনের পথে হাঁটবে। শক্ত হাতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কঠিন দলীয়করণের পথে না হেঁটে যোগ্য মানুষের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু কিছুই আমরা দেখতে পেলাম না। দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সুযোগে অনিয়ন্ত্রিত হলো ছাত্রলীগ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হতে লাগল বাজার নিয়ন্ত্রণে। সরকারি রাজনীতির সাইনবোর্ডে নানা ধারার দুর্বৃত্তের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ফল্গুধারার মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এখন বিস্ফোরণের পথে। এসব বাস্তবতা সরকার পক্ষ আমলে আনছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ফলে এখন দমবন্ধকর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। কাওসার সাহেব এবার একটি কঠিন সত্য উপস্থাপন করলেন। বললেন, আমরা যারা কোনো দলের প্রতি অন্ধ নই, শুধু আদর্শিক কারণে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি, তারা এখন এক কঠিন বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছি। আসন্ন নির্বাচনের আগে আমরা এখন একটি বিকল্প দলের প্রত্যাশা করি। কিন্তু তা সোনার পাথর বাটি। বিভ্রান্ত রাজনীতির মাঠে আমরা যাব কোথায়! তেমন বিকল্প দল গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখছি না। এ যে কত বড় কষ্টকর অবস্থা, তা কী করে বোঝাই!

কাওসার সাহেবের বিকল্প দল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার পেছনে যুক্তি রয়েছে। তার মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে এবং বিরোধী দল থেকে তেমন চাপ না থাকায় আওয়ামী লীগেরু নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রীরা লাগামহীনভাবে দাপুটে হয়ে গিয়েছেন। নানা অনাচারে ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক। তিনি শুধু চান প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগ চাপে থাকুক। এভাবে ফিরে আসুক আত্মচৈতন্যে। মানুষের মধ্যে দলটির প্রতি আবার আস্থার জায়গা তৈরি হোক।

কাওসার সাহেব চলে যাওয়ার পর তার আলোচনার সূত্রে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলন নিয়ে আমার মনে নানা ভাবনা যুক্ত হলো। আওয়ামী লীগের এসব ক্ষত কাজে লাগিয়ে বিএনপি কি সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে পারবে? বিএনপি মুখে যতই জনগণের কথা বলুক, এ আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষকে এখনো সম্পৃক্ত করতে পারল না দলটি। কেন? উত্তর খুব কঠিন নয়। বিএনপি নেতারা বক্তৃতার মঞ্চে, প্রতিদিন সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের সমালোচনায় মুখর। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা দৃশ্যমান উন্নয়নকেও এদেশের বিরোধীদলীয় চিরাচরিত স্টাইলে প্রশংসা না করে তির্যক মন্তব্য করছে; কিন্তু পাশাপাশি নিজেদের দীর্ঘ শাসনামলের বড় কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমকে উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করাতে পারছে না। কারণ, এ জায়গায় একটি বড় শূন্যতা রয়েছে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অগণতান্ত্রিক আচরণ, নির্বাচন গড়াপেটা করা, সন্ত্রাস-এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের সঙ্গে বিএনপির ক্ষমতাকাল কাটাকাটি করলে যোগফল শূন্য হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়ে রয়েছে উন্নয়ন কার্যক্রমের সাফল্য নিয়ে। এ জায়গায় অসহায় অবস্থায় বিএনপি। ফলে কোন ভরসায় বা আস্থায় জনগণ বিএনপির আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করবে!

মানতে হবে সাধারণ মানুষ খুব সাধারণ নয় এখন। তারা নানা হিসাবনিকাশ করতে জানে। শুধু বক্তৃতার ভাষায় মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। কিন্তু বিএনপির ভেতর কোনো মেধাবী নেতৃত্ব কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে টেলিভিশনে সংবাদ দেখার সময় নতুন শব্দাবলি পেলাম। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তো দলীয় উপাধি ‘দেশনেত্রী’ আছেই। এবার প্রথমবারের মতো শুনলাম বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলছেন ‘দেশনায়ক তারেক রহমান’। নেতৃত্বের এতটাই অথর্ব দশা। আশঙ্কা করছি, লন্ডন থেকে হয়তো এমন আদেশ এসেছে। তাহলে বলব বিএনপির বাংলাদেশের নেতারা এমনই অসহায় যে, তাদের তোতাপাখি হয়ে যেতে হচ্ছে। কোনো কিছু এডিট করে বলার ক্ষমতা নেই।

পাশাপাশি আমার ভাবনা হলো, বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হওয়া নানা বাম ও অন্যান্য ধারার রাজনীতিকদের নিয়ে তারা যদি নিজেরা যূথবদ্ধ হয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতেন, তাকে যৌক্তিক হিসাবে মানা যেত। মুখে তারা যেভাবেই বলুন, বিএনপির ছায়া তলেই আছেন। ফলে প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক আদর্শিক জায়গা থেকে কি তারা সরে এসেছেন? না হলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তারা কেমন করে পাকিস্তানপন্থি এবং নানা অপকর্মের কালোতিলক পরা বিএনপির নেতৃত্ব মেনে নিলেন! ধরে নিলাম আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হলো। তেমন হলে দেশ পরিচালনায় কর্তা হবে বিএনপি। তখন এসব সম্মানিত নেতার তো তারেক রহমানের কৃপা ভিক্ষা করতে হবে। স্লোগান দিতে হবে ‘দেশনায়ক তারেক রহমান’। বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ তো বসে থাকবে না। পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রবল আন্দোলন শানাতে সময় লাগবে না।

বাস্তবতা ভুলে গেলেন কেমন করে বাম ও সেমিবাম নেতারা। আমরা যারা কোনো দলের অন্ধ অনুসারী নই, তাদের বরাবরই বিএনপির সরকার পতনের একদফা আন্দোলন অসময়োচিত বলে মনে হয়েছে। অনেকদিন পর বিএনপি রাজনীতির মাঠে সরব হয়েছে। তাদের সময় নেওয়া উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ভুল ও অন্যায়কে পুঁজি করে ধীরে ধীরে জনমত গঠন করা যৌক্তিক ছিল। উচিত ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হেঁটে টার্গেট ঠিক করা। মাঠ ঠিক না করে রাত পেহালেই মসনদ পেয়ে যাব-এমন ভাবনা সুবিবেচনাপ্রসূত নয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। বিএনপি যদি সরকারের পতন ঘটাতে না পারে এবং নির্বাচনেও অংশ না নেয়, পাশাপাশি সরকার যদি মোটামুটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন করে ফেলতে পারে এবং বিএনপির অনমনীয়তাকে অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক আচরণ হিসাবে দেশবাসী ও বিশ্বনেতাদের কাছে প্রমাণ করতে পারে, তাহলে সহজেই ভিলেন করা সম্ভব হবে বিএনপিকে। তেমন হলে বিএনপি ও এর সমমনাদের পরিণতি কী হবে!

এমনটি হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও দেশবাসী। ক্ষমতার দম্ভে আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে চড়াও হচ্ছেন নানা পেশার মানুষের ওপর, বিরোধীদলীয় চাপ না থাকায় তাদের আরও দুর্দমনীয় হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন। সংসদে ও বাইরে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। ধরে নিই আসন্ন নির্বাচনের বৈতরণি পাড়ি দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করল, তখন আওয়ামী লীগ নেতারা যে যৌক্তিক পথে হাঁটবেন তেমন বল যায় না। এসব নিয়ে মুক্তচিন্তায় আমরা অনেক কিছুই ভাবতে পারি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হলে রাজনীতিকদেরই সক্রিয় হতে হবে। তবে হতাশা এখানেই, তেমন দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব কোথায়? নেতৃত্বের সমস্যা না কাটাতে পারলে কোনো পক্ষ থেকেই সুস্থ ধারা বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

নেতৃত্ব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম