Logo
Logo
×

বাতায়ন

ফোকাল পয়েন্ট

সাধারণ মানুষ যেন টার্গেট না হয়

Icon

আসিফ রশীদ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণ মানুষ যেন টার্গেট না হয়

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় অবরোধ (ব্লকেইড) বলতে বোঝায় কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বল প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্য, পণ্য, যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রভৃতির সরবরাহ ও যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া। এক্ষেত্রে কোনো দেশের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট এলাকা অবরোধ করা হয়ে থাকে। এটি ভেতর থেকে অথবা কোনো বহির্শক্তি দ্বারা হতে পারে। যেমন: ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে মিত্রবাহিনী ঢাকা অবরোধ করেছিল। তবে একটি পুরো দেশকে ভেতর থেকে অবরোধ করা যায় না। গোটা দেশকে অবরোধ করতে হলে তা করতে হবে বাইরে থেকে এবং অবশ্যই তা ভিন্ন রাষ্ট্র দ্বারা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আরেক ধরনের অবরোধ (এমবারগো বা স্যাংকশন) আছে, যা হলো বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ। এক বা একাধিক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ হিসাবে। যেমন: কিউবার ওপর মার্কিন অবরোধ, বর্তমানে ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা অবরোধ, ইসরাইল কর্তৃক গাজা অবরোধ ইত্যাদি।

বর্তমানে দেশে দু-একদিন বিরতি দিয়ে টানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। তবে এ অবরোধ উপরের অবরোধের কোনো সংজ্ঞায় পড়ে না। ধারণা করা যায়, ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি দীর্ঘদিন যে টানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে, এর পুনরাবৃত্তি ঘটছে এবারও। ওই কর্মসূচি ছিল অনেকটা আমাদের বহুল পরিচিত হরতালের মতোই। মনে আছে, ওই কর্মসূচি পালনকালে মারাত্মক সহিংস পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। এতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে নিরীহ মানুষ, যাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল বা রাজনীতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না।

সাধারণ মানুষের এই ক্ষতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন লেনিনগ্রাদ অবরোধের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাসে আলোচিত অবরোধগুলোর অন্যতম ওই লেনিনগ্রাদ অবরোধ। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অবরোধ হিসেবে বিবেচিত। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকেও এটি ভয়াবহতম। এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো গা শিউরে ওঠার মতো। ১৯৪১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৭২ দিন অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর স্থায়ী ছিল এ অবরোধ। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ৮ লাখ মানুষ (মতান্তরে ১৫ লাখ)। আরও ১৪ লাখ মানুষ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, যাদের অনেকেই মারা যায় ক্ষুধা ও বোমা হামলায়। নগরীর চারপাশে অবস্থিত রাজপ্রাসাদগুলোসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক ভবন লুটপাট ও ধ্বংস করা হয়। এছাড়া বিমান হামলা চালিয়ে নগরীর ভেতরের অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কলকারখানাসহ বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়।

এ অবরোধ ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী। জার্মানি তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দখল করতে করতে রাশিয়ায় প্রবেশ করেছে। জার্মানির ‘অপারেশন বারবারোসা’র তিনটি প্রধান কৌশলগত লক্ষ্যের একটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী লেনিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) দখল করা। কিন্তু লেনিনগ্রাদবাসী জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়। সোভিয়েত সৈন্যরা নগরীটির চারপাশ ঘিরে এমন শক্ত ব্যূহ তৈরি করেছিল যে, জার্মান সৈন্যদের পক্ষে এটি দখল করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই জার্মানির ‘আর্মি গ্রুপ নর্থ’ সিদ্ধান্ত নেয় লেনিনগ্রাদ অবরোধের। রাশিয়ার সাবেক রাজধানী এবং রুশ বিপ্লবের কেন্দ্র হিসাবে নগরীটির একটি বিশেষ রাজনৈতিক মর্যাদা ছিল। এছাড়া সোভিয়েত বাল্টিক নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি হিসাবে এর ছিল সামরিক গুরুত্ব। এ নগরীতে আরও ছিল সামরিক কারখানাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সব মিলে লেনিনগ্রাদ জার্মানির কাছে ছিল লোভনীয় একটি নগরী। নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার নাকি লেনিনগ্রাদ দখলের ব্যাপারে এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি এ নগরীর হোটেল আসতোরিয়ায় বিজয় উৎসব উদ্যাপন করবেন বলে অতিথিদের জন্য আমন্ত্রণপত্রও ছাপিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকি দখলের পর নগরীর নাম পালটে হিটলারের নামে ‘অ্যাডলফস্বার্গ’ করারও পরিকল্পনা ছিল নাৎসিদের। এটিকে জার্মানির নতুন প্রদেশ জেনারেলপ্লান অস্টের রাজধানীও করতে চেয়েছিল নাৎসিরা। তবে এর আগে নগরীর অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিলেন হিটলার।

অবরোধের পরিকল্পনা অনুযায়ী লেনিনগ্রাদের বাইরের উত্তর দিকের ভূখণ্ড জার্মান অনুগত ফিনল্যান্ডের সামরিক বাহিনী এবং দক্ষিণের ভূখণ্ড দখল করে নেয় নাৎসি বাহিনী। এভাবে লেনিনগ্রাদকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এর সব ধরনের যোগাযোগ ও রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জার্মান পরিকল্পায় লেনিনগ্রাদের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র ছিল খাদ্য। জার্মান বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বলেছিলেন, অবরোধের কয়েক সপ্তাহ পরই নগরীতে খাদ্যাভাব দেখা দেবে। ঘটেওছিল তাই।

কেমন ছিল অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদে মানুষের জীবন? কীভাবে কেটেছিল তাদের আড়াইটি বছর? এ সম্পর্কে যেসব তথ্য পরে প্রকাশ পায় তা অকল্পনীয়। লোম খাড়া হওয়ার মতো সেসব ঘটনা। ৮৭২ দিনের অবরোধে পানি, জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ থাকায় লেনিনগ্রাদে অচিন্তনীয় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধায় নগরবাসী লেনিনগ্রাদের সব পাখি, ইঁদুর, পোষা প্রাণী, নিজেদের জামা, জুতা খেয়ে শেষ করার পর মানুষ হত্যা করে তার মাংস খাওয়া শুরু করে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত সাবেক সোভিয়েত আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির নথিপত্রে লেনিনগ্রাদ অবরোধ চলাকালে মানুষের মাংস খাওয়ার তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এনকেভিডির দলিলে ১৯৪১ সালের ১৩ ডিসেম্বরে সংঘটিত এ ধরনের প্রথম কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আছে। এর একটি হলো, এক মা তার ১৮ মাসের শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে, এরপর তার মাংস দিয়ে বাকি তিন সন্তানের খাদ্যের জোগান দেয়। আরেক ঘটনায় দেখা যায়, এক কলমিস্ত্রি স্ত্রীকে হত্যা করে তার ছেলেদের খাদ্য জুগিয়েছে। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এনকেভিডি ২ হাজারেরও বেশি ‘মানুষখেকো’ মানুষকে গ্রেফতার করে, অবশ্য তাদের একটি অংশ ছিল মৃতদেহ ভক্ষণকারী। অনেকে রেশন কার্ড ছিনিয়ে নিতে গিয়েও মানুষ হত্যা করে।

দুর্ভিক্ষে কীভাবে একের পর এক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এর একটি খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে তানিয়া সাভিচেভা নামে ১১ বছরের এক কিশোরীর ডায়েরিতে। সে এতে লিখে রেখেছিল (যথাক্রমে): ‘আজ আমার বোন মারা গেল’, ‘আজ দাদি মারা গেলেন’, ‘আজ আমার ভাই চলে গেলেন’, ‘আজ মারা গেলেন চাচা’, ‘আরেক চাচার মৃত্যু হলো আজ’, ‘আজ আমার মা মারা গেলেন’। এক জায়গায় তানিয়া লিখেছে: ‘সাভিচেভস (তানিয়ার বাবা) মারা গেলেন’, ‘সবাই মারা গেছে’, ‘শুধু বাকি আছে তানিয়া’। এরপর তারও মৃত্যু হয়। এ ডায়েরি পরবর্তী সময়ে সাক্ষী হিসাবে নুরেমবার্গ ট্রায়াল তথা যুদ্ধাপরাধের বিচারে উপস্থাপন করা হয়।

সেন্ট পিটার্সবার্গের শুধু পিসকারিওভোস্কয়ে কবরস্থানেই রয়েছে দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া ৫ লাখ ব্যক্তির সমাধি। অর্থনৈতিক ক্ষতি ও নিহতের সংখ্যার দিক থেকে লেনিনগ্রাদ অবরোধ ছাড়িয়ে গেছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর আনবিক বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের পরিসংখ্যানকেও।

লেনিনগ্রাদ অবরোধ ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর একটি। অনেক ইতিহাসবিদ এই অবরোধকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ, এ অবরোধ ছিল জাতিগত বিদ্বেষমূলক। বর্তমানে ইসরাইল কর্তৃক গাজা অবরোধের পরিণতিও দেখছে বিশ্ব। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইসরাইলের গাজা অবরোধকে লেনিনগ্রাদ অবরোধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এসব অবরোধের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিত অবরোধের কোনো তুলনা চলে না। তবে প্রায়োগিক দিক থেকে এর সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিল দেখা গেছে। গাজা বা লেনিনগ্রাদ অবরোধে মানুষ ও সম্পদের ক্ষতির দিকটি মোটেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। দেশে বিগত অবরোধেও সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচিত হয়নি। সাধারণ মানুষ বহনকারী যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অরাজনৈতিক মানুষ। অবরোধে শুধু বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নয়, নিম্ন-আয়ের দিনমজুর থেকে শুরু করে কৃষকের আয়ের পথও হয়ে পড়ে রুদ্ধ। স্থবিরতা নেমে আসে শিক্ষাব্যবস্থায়।

বর্তমানে দেশের অর্ধনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সরকার এর দায় এড়াতে পারে না অবশ্যই। তবে দেশ আবারও ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধের কবলে পড়লে শুধু আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম নয়, দেশের অভ্যন্তরেও পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। ফলে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে। রুদ্ধ হবে দিনমজুরের আয়ের পথও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূলত সাধারণ মানুষই। বিরোধী দলের আন্দোলন তো সরকারের বিরুদ্ধে। তাই তাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ যেন এর টার্গেট না হয়। মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। যা কিছু করার তা মানুষকে সঙ্গে নিয়েই করতে হয়, মানুষকে প্রতিপক্ষ করে নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেন এ সত্যটি অনুধাবন করেন।

আসিফ রশীদ : লেখক; উপসম্পাদক, যুগান্তর

arbangladesh@gmail.com

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক অবরোধ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম