Logo
Logo
×

বাতায়ন

ফোকাল পয়েন্ট

ইতিহাসের এক অবিচার থেকে শত অন্যায়ের জন্ম

Icon

আসিফ রশীদ

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসের এক অবিচার থেকে শত অন্যায়ের জন্ম

ইসরাইলি হামলার কারণে গাজার যে এলাকাগুলো এখন ঘনঘন সংবাদে আসছে, তার একটি রাফাহ্। মিসরসংলগ্ন এ সীমান্তটি সম্প্রতি কিছু সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল বিদেশি পাসপোর্টধারীদের গাজা ত্যাগের সুযোগ করে দিতে। গাজার এই রাফাহ্ শহরেই জন্ম ড. মোহাম্মদ শাহতা জারাবের। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক এই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতকে অনেকেরই হয়তো মনে আছে। তিনি এদেশে ২০ বছরেরও বেশি রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্ত ছিলেন। এদেশের সঙ্গে তার এক ধরনের হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন (বিদেশি কূটনীতিকদের প্রধান) হিসাবে কূটনৈতিক মহলে তার সরব উপস্থিতি ছিল। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে আমি তার এক বিশদ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ফিলিস্তিন ইস্যুতে। সেসময় চারপক্ষীয় (জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও রাশিয়া) মধ্যপ্রাচ্য শান্তি উদ্যোক্তার মাধ্যমে ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শান্তির জন্য সংগ্রাম করছি। আমরা একসঙ্গে বসবাস করতে চাই। আমি আমার কন্যার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে আমরা একটি মহান ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়তে পারব। কারণ, আমাদের সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে’ (প্রথম আলো বিশেষ সাক্ষাৎকার, ০২.১০.০৫)। বিদায়কালে তিনি আমার দুই হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিনে আপনি আমন্ত্রিত।’ স্পষ্ট দেখেছিলাম, তার চোখ দুটি চকচক করছে।

ড. শাহতা জারাবের চোখে সেদিন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আজ ১৮ বছর পরও তা বাস্তবে পরিণত হওয়া দূরে থাক, এ বিষয়ে সামান্যতম অগ্রগতিও হয়নি, বরং আরও অবনতি হয়েছে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আসলে গাজা, পশ্চিমতীরসহ অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন কবে বাস্তবায়িত হবে, তা কেউ জানে না। আর যতদিন ফিলিস্তিন স্বাধীন না হচ্ছে, ততদিন ইসরাইলি হামলা সহ্য করে, হামলার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নিরাপত্তাহীন-অরক্ষিত জীবন কাটাতে হবে ফিলিস্তিনিদের। পশ্চিমতীর ও গাজার যে সামান্য কিছু অংশ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অধীনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে কেবল পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীন দেশের রাজধানী হিসাবে পেতে চায়। অথচ ইসরাইল নামের গোটা দেশটিই একসময় ছিল ফিলিস্তিন।

একটি ভূখণ্ডে শতাব্দীর পর শতাব্দী বংশানুক্রমে বসবাস করে আসা জনগোষ্ঠীকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করে সেখানে বহিরাগতদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং বৈশ্বিক শক্তিবলে এর ‘বৈধতা’ দেওয়ার মতো নির্মম অবিচার পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসে আর একটিও নেই-যা ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে। এ অন্যায়-অবিচার নিয়েই পৃথিবী পার করেছে ৭৫টি বছর। আজ দেড় মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের যে নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, প্রকৃতপক্ষে তা নতুন কিছু নয়। এমন ঘটনা কয়েক বছর পরপরই ঘটছে সেখানে। মাঝে কিছু বিরতি পেলে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আবার শুরু হয় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যালীলা। প্রতিবারই হামলা চালানো হয় নিরাপত্তার নামে। আর সব ক্ষেত্রে ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষার ‘জিম্মাদার’ হয় যুক্তরাষ্ট্র। এখনো যখন ইসরাইল গাজায় ক্রমাগত ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে, নির্বিচারে বেসামরিক নারী-শিশু-পুরুষ হত্যা করছে, এমনকি হাসপাতালগুলোকেও করা হচ্ছে টার্গেট; তখনো যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার কথা বলে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে উচ্চকণ্ঠে।

বস্তুত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি অন্য কারও ওপর নয়, সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু অসলো শান্তি চুক্তি ছাড়া এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০২ সালের ২৪ জুন এক ভাষণে ইসরাইলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন, যার খসড়াটি তৈরি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা ডোনাল্ড ব্লোম। ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল এর চূড়ান্ত টেক্সটি প্রকাশ করা হয়। এ পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ‘রোডম্যাপ’ নামে পরিচিত। এ রোডম্যাপও পড়ে অচলাবস্থায় এবং কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পরপর মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বড় বড় কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমাদের মনে আছে, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের একটি ফিলিস্তিনি উদ্যোগে তিনি ভেটো প্রদানের হুমকি দিয়েছিলেন। অনেকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে যখন ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় থাকে, তখন ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মার্কিন রাজনীতিতে রিপাবলিকানদের চেয়ে বরং ডেমোক্রেটদের ওপর ইহুদি লবির প্রভাব বেশি। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারই আন্তরিকভাবে ফিলিস্তিনি সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধান চায়নি এবং তা কেবল ইহুদি লবির কারণে নয়, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের কারণেও। এই একই কারণে আজ ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতময় ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে।

ফিলিস্তিনি সমস্যার সৃষ্টি ও তা জিইয়ে রাখার জন্য মূলত দুটি রাষ্ট্র দায়ী-একটি যুক্তরাজ্য, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র। সেই ইতিহাস বড়ই নির্মম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ফিলিস্তিনে সংখ্যায় কম হলেও জায়নবাদীদের অভিবাসন ও হিব্রু ভাষার পুনরুজ্জীবন শুরু হতে থাকে। এর প্রতি ব্রিটেনের প্রকাশ্য সমর্থন ছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফুর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা ব্যারন রোদসচাইল্ডকে এক চিঠিতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা এবং তাতে ব্রিটেনের সর্বাত্মক সহযোগিতার ইচ্ছা তুলে ধরেন। ১৯২২ সালে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন শাসনের ম্যান্ডেট পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের ওপর তার ম্যান্ডেট ত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, সেসময় গোটা ফিলিস্তিনে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ফিলিস্তিনি। আর ইহুদির সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ, যাদের বেশির ভাগই এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ থেকে। তা সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য-বিপর্যয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ইসরাইল একে একে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডগুলো নিজ করায়ত্তে নিয়ে নিতে থাকে এবং এ সময় অন্তত ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরাইল বাকি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডও দখল করে নেয় এবং সেসব স্থানে বসতি গড়ে তোলে।

এ পটভূমিতেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রাম। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)। পিএলও আগে ইসরাইলের অস্তিত্ব তথা দুই রাষ্ট্রের ধারণা মেনে নেয়নি এবং তা যুক্তিসংগত কারণেই। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করে যেভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছে, তা মোটেই ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কিন্তু ইসরাইলি দখলদারত্বের মাত্রা দিনদিন বাড়তে থাকায় এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রায় নীরব ভূমিকা পালন করায় ফিলিস্তিনিরা বাধ্য হয়ে সামান্য কিছু বিচ্ছিন্ন অংশের সমন্বয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা মেনে নেয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত রূপরেখাটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কেন হয়নি, তা ড. শাহতা জারাবের ১৮ বছর আগের বক্তব্য থেকেই তুলে ধরছি। লক্ষ করুন, যে সময় ওই রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছিল এটি সেসময়ের কথা। ড. শাহতা জারাব বলেন, ‘আমি আপনাকে খোলাখুলিই বলতে পারি, রোডম্যাপের ভবিষ্যৎ আছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। যুক্তরাষ্ট্র শ্যারনকে (তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী) আলোচনার টেবিলে বসাতে রাজি করিয়েছে। এ রোববার ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও শ্যারনের মধ্যে নির্ধারিত বৈঠকটি গাজায় গত কয়েকদিনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে স্থগিত হয়ে গেছে। হয়তো পরে নতুন তারিখ নির্ধারণ হবে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়।’

হ্যাঁ, ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের মূল চাবিটি এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা। এ ইচ্ছার অভাবেই ফিলিস্তিনিদের এত দুর্দশা। ১৯৪৮ সালের পর থেকে যখনই ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের অন্যায় দখলদারত্বের বিষয়ে জাতিসংঘে কোনো নিন্দা প্রস্তাব উঠেছে, প্রতিবার এর বিরুদ্ধে একটি হাত উঠে গেছে। সেই হাতটি জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের। মার্কিন আশকারা পেয়ে পেয়েই ইসরাইল আজ দানবের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে জানে, বিশ্বের আর একটি দেশও যদি তার পাশে না থাকে, যুক্তরাষ্ট্র তার পাশে আছে, পাশে থাকবে। এ কারণে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন, ন্যায়নীতি-কোনো কিছুরই পরোয়া করে না ইসরাইল।

তাই ড. শাহতা জারাবের স্বপ্ন কবে বাস্তবাতি হবে, তা কেউ জানে না। এ স্বপ্ন সমগ্র গাজাবাসীর, পশ্চিমতীরবাসীর-গোটা ফিলিস্তিনি জাতির। একমাত্র স্বাধীনতাই ইসরাইলি সন্ত্রাসের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা দিতে পারে। আজ ইসরাইলি বর্বরতায় গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। এখনই সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়ে একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার। কিন্তু বিশ্ব যে অন্যায় ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাতে সেই সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

আসিফ রশীদ : উপসম্পাদক, যুগান্তর; লেখক

ইসরাইল হামলা গাজা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম