খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে
ড. মো. আল-মামুন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যাদের সবার জন্য খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার সফল অভিযোজনের ফলে বর্তমানে দেশ কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক লাগসই প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে দেড় শতাধিক, যা সার্বিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছে। এছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভাসমান চাষ, বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন, ট্রান্সজেনিক জাত উদ্ভাবন, পাটের জেনোম সিকোয়েন্স উম্মোচন ও মেধাস্বত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত ফসলি জমির পরিমাণ কমে গেলেও স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশগুণ। প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষি আজ জীবিকানির্ভর কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ধান ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম স্থানের পাশাপাশি ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও মাছ উৎপাদনে ২য় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। বিশ্ব খাদ্য সংকটের এ ক্রান্তিলগ্নে দেশের এ অর্জন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসাবে প্রচার করছে।
মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান ১১.৫০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪০.৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ৮৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২৫ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। প্রায় সব শিল্পই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মীপিছু কৃষি জিডিপি ১ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমে দশমিক ৩৯ শতাংশ। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষিনীতিতে নতুন করে ন্যানো প্রযুক্তির মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক ও নিরন্তর গবেষণার ফলে ধানসহ বিভিন্ন ফলদ ও শাকসবজির জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। ফলে সারা বছর শাকসবজি ও ফল-ফলাদির চাষ হচ্ছে, যা দেশের সার্বিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাতের মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান (জিংক, আয়রন, প্রোটিন, মিনারেলসহ শরীরের অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদানগুলো) দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণ বৃদ্ধি এবং বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজির ব্যবহার, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, সুষম সার ব্যবস্থাপনা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বায়োফর্টিফিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান সমৃদ্ধ শস্য উৎপাদনে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধকরণে দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এর ফলে কৃষিপণ্য বা খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করাসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
দেশের উপকূলীয় এলাকায় জোয়ার-ভাটা এবং জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি কৃষিজমিতে প্রবেশ করায় আবাদি জমি ক্রমাগত লবণাক্ত হয়ে পড়ছে এবং তা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। হাওড় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা, বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা এবং দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার কারণে ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক না হলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১৪০ লাখ হেক্টর, যার মধ্যে বন্যাকবলিত জমির পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর। এছাড়া প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন পর্যায়ের খরায় আক্রান্ত হয়। ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুযায়ী দেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল নাগাদ ১ মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে প্রায় ৩০০০ মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে এবং সার্বিক উৎপাদন শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাব বিস্তার পড়ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষির ফলন, পুষ্টি উপাদান এবং উৎপাদনশীলতার ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতিবছর প্রায় ০.৭ শতাংশ হারে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে, অর্থাৎ প্রায় ২৩ লাখ। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বহু দেশে অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য গমজাতীয় খাদ্যের বাজার ও পরিশোধিত তেলের মূল্য বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে নানা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যের সংকট খাদ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার পরিধি সম্প্রসারিত করে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিতে উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং খাদ্য সরবরাহে সুষম বণ্টনে সবাইকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত অগ্রগতি ও সফলতার ফলে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বর্তমানে সন্তোষজনক হলেও ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার চাপ সামলানো অধিকতর কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টিহীনতার কারণে অনেক মানুষ নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষিনীতি, জাতীয় বীজনীতি, জাতীয় খাদ্যনীতি ও এসডিজির সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, পশ্চাৎপদ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের বাগান সৃজন ও সবজি আবাদের বিস্তার এবং অনুন্নত চর ও হাওড় অঞ্চলে সমন্বিত কৃষি সহায়ক প্রকল্পসহ বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এক ও দুই ফসলি জমিগুলোকে চার ফসলি জমিতে পরিণত করে শস্যের নিবিড়তা উন্নীত করতে হবে।
জনবহুল এদেশের সীমিত চাষের জমি, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে টেকসই কৃষি উন্নয়নে রয়েছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাফল্য অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও অধিক বিনিয়োগ ও অংশীদারত্ব প্রয়োজন। দেশের আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসলের আবাদ নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট
