Logo
Logo
×

বাতায়ন

সবাই আছে যার যার তালে

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সবাই আছে যার যার তালে

এদেশের সব পক্ষের রাজনীতিকরা একটি জপমালা গলায় ধারণ করে আছেন, আর তা হচ্ছে ‘জনগণ’। সবাই জনগণের পক্ষে লড়াই করছেন! বিএনপি আন্দোলন করছে জনগণকে নিয়ে। আওয়ামী লীগ জনগণের কল্যাণে জীবনপাত করছে! ইসলামি দলগুলোর পাশেও আছেন জনগণ। বিএনপির সঙ্গে থাকা কয়েকটি ছোটখাটো দলের নেতারাও বক্তৃতায় বলতে চান জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। ২৮ অক্টোবরে এরকম এক-দুটি বাম ধারার দলের ‘জনসভা’ হচ্ছিল ঢাকার কোনো এক প্রান্তে। এক টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম সে সভায় বড়জোড় জনা শতেক পুরুষ-মহিলা ‘জনগণ’ আছেন। সাংবাদিক তাদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। দেখা গেল অধিকাংশই জানেন না তারা কেন এখানে এসেছেন। তাদের কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কেউ বাসাবাড়ির গৃহকর্মী। কোনো এক ঠিকাদার তাদের এনেছেন। এ সভার নেতারাও জানালেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা লড়াই করছেন।

এর মধ্যে নির্বাচন সামনে নিয়ে বিএনপি-জামায়াত আর তাদের সহযোগীরা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন করে যাচ্ছেন; কিন্তু বাস্তবে আন্দোলন দলীয় নেতাকর্মী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমর্থকদের মধ্যেই আটকে আছে। শুধু নেতাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় ‘জনগণ’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনে। এসব দেখে-শুনে ধারণা হয়, এ দেশে কয়েক স্তরের জনগণ রয়েছে। কেউ আওয়ামী লীগের জনগণ, কেউ বিএনপির জনগণ, কেউ বাম নেতাদের জনগণ, আবার কেউ ইসলামি দলগুলোর জনগণ। বিএনপি নেতারা যখন বলেন, ‘জনগণ’ এ সরকারকে আর চায় না, তখন জানতে ইচ্ছে করে এমন তথ্য তারা পেলেন কেমন করে? এ ইস্যুতে তারা কি কোনো গণভোট নিয়েছেন? আবার আওয়ামী লীগ নেতারা যখন বলেন, বিএনপির নৈরাজ্য জনগণকে নিয়ে প্রতিহত করা হবে, তখন একই প্রশ্ন তাদের কাছেও থাকে।

এর মধ্যে বিএনপির বড় নেতাদের অনেকেই আটক আছেন। বাইরে আছেন রিজভী আহমেদ। তিনিই অনলাইনে একের পর এক অবরোধের ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। এবার তফশিল ঘোষণার পর অনলাইনে রিজভী আহমেদকে দুদিন দেখলাম সংবাদ সম্মেলনের নামে স্ক্রিনে আসতে। কিন্তু কোনো সাংবাদিক দেখলাম না। সাংবাদিকদের প্রশ্নও পেলাম না। একটি ধোঁয়াশা ছিল, মানুষ মনে করত এ হরতাল-অবরোধ বিএনপির পক্ষ থেকে রিজভী আহমেদই ডাকছেন। এবার তিনি পরিষ্কার করলেন। বললেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ‘দেশনেতা’ তারেক রহমান ডাক দিয়েছেন। এতদিন দেশনেত্রী, জননেত্রী, দেশরত্ন এসব দলীয় উপাধি শুনে এসেছি, এবার জানলাম বিএনপির প্রবাসী নেতাও ইতোমধ্যে উপাধি পেয়েছেন ‘দেশনেতা’। শুনে আমার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা মনে পড়ল। তার ক্ষমতাকালীন দৈনিক ইত্তেফাকে নিবন্ধ লিখে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন এ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দুর্ভাগ্য জিয়াউর রহমানের, মৃত্যুর আগে তিনি জেনে যেতে পারেননি তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। খালেদা জিয়ার আমলে মেধাবী নেতারা জিয়াউর রহমানের সেক্টর কমান্ডারের গৌরব নিয়ে সন্তুষ্ট হলেন না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের বড় ভাগ নেওয়ার জন্য স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় পুরো দলটিকেই দাঁড় করিয়ে দিলেন। একইভাবে খালেদা জিয়ার সময় ‘রাজনীতিতে নাবালক’ তারেক জিয়া অনেক সিনিয়র নেতাকে ডিঙিয়ে বিএনপির বড় নেতা হয়েছিলেন। অবস্থার ফেরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উচ্চ আদালতে অপরাধী হিসাবে শাস্তি পেয়ে তিনি লন্ডনে পালিয়ে যান। এদেশের পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক আসামি। তবে লন্ডনে বেশ আরাম-আয়েশে আছেন। আওয়ামী লীগের আমলে বিচারে অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার বিকল্পে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয় প্রবাসী তারেক রহমানকে; কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত আসামি বলে এ দেশে তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। আজকে রিজভীর মুখে জানলাম বিএনপির এমন এক নেতা খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন ‘দেশনেতা’। আমি জানি না কী অবদানের কারণে এসব উপাধি পাওয়া যায়!

কথা বলার লাইসেন্স লাগে না বলে বিজভী আহমেদ তার কথিত সংবাদ সম্মেলনে জানালেন দেশের ১২ কোটি ভোটার নাকি ঘৃণাভরে তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, আমার চেয়েও অঙ্কে কাঁচা আরও মানুষ আছেন। আমি হিসাব মেলাতে পারলাম না এই ভেবে, দেশের সব ভোটার যদি তফশিল প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে টিভিতে যে দেখলাম সারা দেশে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী তফশিলকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করলেন। তবে তারা কারা?

গত শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম। ইমাম সাহেব হাদিস-কুরআনের আলোকে মিথ্যা বলার জন্য পাপের কথা বলছিলেন। এমনও বললেন, শিশুকে মিছেমিছি প্রবোধ দিয়ে কান্না থামানের চেষ্টা করলেও নাকি মিথ্যা বলার শাস্তি পেতে হবে। অথচ দেখলাম ইসলামি আন্দোলনের বড় মিছিলের অগ্রভাগে থাকা নেতৃস্থানীয় আলেমরা বলছেন, জনগণ তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব আলেম জনমত জরিপ করলেন কখন? অন্তত আওয়ামী লীগ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪ দলের পক্ষে কি জনগণের কোনো অংশ নেই! অন্যসব রাজনৈতিক নেতার মতো তারাও রাজনৈতিক বক্তব্যের নামে মিথ্যা বলতে পারছেন কেমন করে?

জামায়াতে ইসলামীর কথা আলাদা। পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশের সাধারণ মানুষ ইসলামি দল হিসাবে এদের স্বীকৃতি দেয়নি। এ কথা বলার ভিত্তি হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে যে কটি নির্বাচন হয়েছে, সেখানে খুব কম আসন লাভ করেছে জামায়াত। বাংলাদেশেও এ দলটি একক নির্বাচনে সুবিধা করতে না পেরে স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে ছিল বিএনপির সঙ্গে। এ কারণেই কয়েকটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন জামায়াত নেতারা। শুনেছি পির সাহেবদের দল ইসলামি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নাকি জামায়াতে ইসলামের আদর্শিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। ধর্মগ্রন্থে পড়েছি অনুমান করে কথা বলাও নাকি ইসলাম অনুমোদন করে না। তাই জনগণ যে তফশিল প্রত্যাখ্যান করেছে, জনজরিপ না করে অমন কথা ইসলামি দলের নেতারা বলেন কেমন করে? তাদের কি পাপের ভয় নেই?

জনগণের নাম ভাঙাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের কসরতও কম না। তারাও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিরোধীদের সন্ত্রাস মোকাবিলা করবে। জনমত যাচাই তারা কীভাবে করলেন আমাদের জানা নেই। প্রধানমন্ত্রী মহান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, বিএনপির মতো সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তফশিল ঘোষণার পর বলেন, সবার জন্যই নির্বাচনে আসার দরজা খোলা আছে।

রিজভী আহমেদ তার অনলাইন বক্তব্যে বলছিলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবারও আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে চায়। কথাটি হয়তো সত্য। কিন্তু এর দায় কি বিএনপির নেই? ২০১৪ সঙ্গে জ্বালাও-পোড়াও করে নির্বাচন বন্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কারসাজিতে হোক বা যে কোনো হিসাব না মেলায় নির্বাচন থেকে সরে এসেছিল বিএনপি। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনেই যায়নি। আর সে নির্বাচন নিয়ে তো অনেকের মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এবারও এখন পর্যন্ত বিএনপি একদফা আদায়ে ব্যস্ত। অতীতের মতো এবারও সরকার নির্বাচন গড়াপেটা করবে এমন একটি ধারণা থেকেই বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে না। তাহলে একতরফা নির্বাচনের পথ কি বিএনপি করে দিচ্ছে না! ধরে নিলাম বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে গেল না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কয়েকটি দল নির্বাচনে গেল, এমন অবস্থায় এ নির্বাচন একতরফা হবে কেন?

এবার অন্যভাবে বলি। ধরি, ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে গেল। জামায়াত ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচন কমিশন নির্ভার হয়ে দৃশ্যত অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন করে ফেলল। দেশবিদেশের মিডিয়া বড় দাগে দোষ খুঁজে পেল না। নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন কমিশনের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে বলে মত প্রকাশ করল। তখন কি বিএনপি নেতারা নির্বাচন নিয়ে বড় কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন? এমনটি হলে দেশের নানা অঞ্চলের বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। এ বাস্তবতায় নিজেদের রাজনৈতিক মৃত্যু ঠেকাতে অনেক বিএনপির স্থানীয় নেতা ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিলে বিস্মিত হব না। এ বাস্তবতায় সাত-সমদ্দুর তেরো নদীর ওপারে থাকা তাদের ‘দেশনেতা’র নেতৃত্বে দলের সংহতি রক্ষা করা যাবে? এ অবস্থায় দল হিসাবে বিএনপির ক্ষতি হবে ঠিকই, তার চেয়েও বড় ক্ষতি হবে এদেশের মানুষের এবং রাজনীতির। একটি শক্ত বিরোধী দল দাঁড়ানোর সম্ভাবনার আলো অনেকটাই ফিকে হয়ে যাবে। তখন সরকারের আচরণ অনেক বেশি স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দেবে।

আমাদের বরাবরের মতই প্রত্যাশা থাকে, সব পক্ষের রাজনৈতিক নেতারাই স্বার্থবাদী বদ্ধচিন্তার অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসবেন। শুধু সরকার গঠন করতে হবে কেন, সবাইকে বিরোধী দলে থাকার মানসিকতা রাখতে হবে। যে দলই করি, সে দলের আদর্শকে ভালোবেসে সমর্থন দিতে হবে। এখন বিএনপির দেশনেতা মনে করেন, দল ক্ষমতায় এলে তার সব মামলা আর শাস্তি খারিজ হয়ে যাবে, তিনি দেশে এসে রাজদণ্ড হাতে নিয়ে সিংহাসনে বসবেন, তাই মহান নেতার জন্য দেশের কর্মীরা পঙ্গপালের মতো জীবন দিক, কারাভোগ করুক, এটিই হবে পুণ্যের কাজ। কোনো ছাত্রদলের মেধাবী কর্মী মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারব, তাই এখন দেশনেতা জিন্দাবাদই বলতে হবে। একইভাবে কোনো আওয়ামী লীগ মানসিকতার আমলা মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আমার প্রমোশন আটকে যাবে। কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ঋণখেলাপি মনে করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে আমার দুর্দিন নেমে আসবে। তাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ কারণে যে যার মতো কসরত করে যাচ্ছেন দলের হয়ে। সাধারণ মানুষ যা ভাবার ভাবুক, তারা এখন যা কিছু বলার লাইসেন্স ব্যবহার করে যাবেন রাজনীতির মাঠে। এমনটি অব্যাহত থাকলে দেশের ভাগ্যাকাশে কোনো পরিবর্তন আসবে না। জানি না, এ অন্ধকার কেটে সূর্য উঠবে কবে!

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম