প্রাথমিকের নিয়োগবিধি হোক শিশু শিক্ষাবান্ধব
মো. সিদ্দিকুর রহমান
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকের শিশু আগামীর দেশ ও জাতি গড়ার রূপকার। আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগরদের জন্য শিশুশিক্ষার সব কার্যক্রম গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২৩’ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া সর্বস্তরে চরম অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহামেদের বক্তব্যটি যথার্থ। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক অংশীজনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকা স্বাভাবিক। প্রত্যেক স্টেকহোল্ডার শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখেন।’ এ মানসিকতা তাই কারও থাকা কাম্য নয়। প্রাথমিকের নিয়োগবিধির মাধ্যমে শিশু শিক্ষাবান্ধব প্রশাসন গড়ে আগামী দিনে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়ে সুদৃষ্টি দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০৪১ সালে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষা পরিবারের সব সদস্যকে তাই একযোগে এগিয়ে যেতে হবে।
শিশু শিক্ষা আধুনিক যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায় থেকে মজবুত নিয়োগ ব্যবস্থাসহ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পদোন্নতির স্থবিরতায় মেধাবী শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বিসিএসসহ নানা পেশায় চলে যাচ্ছে। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রাথমিকে অধ্যয়নরত শিশু। শিশু শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে পরবর্তী শিক্ষার ভিত নড়বড়ে হবে। হাঁস-মুরগি, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান। কিন্তু প্রাথমিকের স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। বিষয়টি ক্ষোভ ও দুঃখের। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দক্ষ ও পারদর্শী, তবে তাদের তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের বিষয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। অনেকটা ‘বাবু মাঝি’ কবিতার সাঁতার না জানা বাবুর মতো। পিটিআই ও ইউআরসিগুলো প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদানের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ সেখানেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাহীন জনবল। সর্বস্তরে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে মেধাবী, অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়োগ দিলে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার হয়ে উঠবে শিশু শিক্ষার স্বর্গরাজ্য। অপরদিকে মেধাবীদের পদচারণায় সমৃদ্ধ হবে প্রাথমিক শিক্ষা। তাই শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাবিহীন কোনো ক্যাডার কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
নিয়োগবিধি ২০২৩ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৭৭টি স্টেকহোল্ডারের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ-পদোন্নতির বিষয়টি নেই। কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষকদের এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে বোধগম্য নয়। হয়তো প্রাথমিক শিক্ষকরা সব শিক্ষিত নাগরিকের শিক্ষক বিধায় তাদের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আলাদা নিয়োগবিধি দেওয়া হয়েছে। তবে সাবেক নিয়োগবিধির আলোকে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি চলমান। এতে ৮০ শতাংশ সিনিয়র সহকারী শিক্ষক/প্রধান শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। যদিও দীর্ঘ এক যুগ ধরে এ পদোন্নতি বন্ধ ছিল। ইদানীং লক্ষ্মীপুর জেলায় পদোন্নতির চাঁদ দেখা গেছে। অন্যান্য জেলায় এ চাঁদ অমাবস্যার কালো ছায়ায় ঢাকা পড়ল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মেধাবী, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘ এক যুগ পদোন্নতির অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কর্তৃপক্ষ তবুও কেন প্রশিক্ষণহীন, অনভিজ্ঞ একই ডিগ্রিধারীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা বহিরাগতের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে? প্রশাসন যদি কোনো সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়, তবে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে ১৫-৩৫ বছরের অভিজ্ঞ সহকারী শিক্ষকের ছাত্র, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তখন পদোন্নতি বঞ্চিত কোনো শিক্ষকের মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা গভীরভাবে উপলব্ধির পরামর্শ রইল। শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক, কর্মকর্তা-অভিজ্ঞ শিক্ষক-কর্মকর্তার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়। এ প্রেক্ষাপটে সিনিয়র সহকারী শিক্ষককে শতভাগ প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি সুযোগ দেওয়া উচিত।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষক সিইনএড, ডিপইনএড, বিএড, এমএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ। এ শিক্ষকদের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অনভিজ্ঞ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী ইন্সট্রাক্টর কতটুকু ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ প্রদানে যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখাবে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। শুধু প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নির্ধারণ করে বয়স ও অভিজ্ঞতা বেঁধে দেওয়া অযৌক্তিক। উপরস্থ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বয়সে বাঁধা নেই, অবসরের আগের দিনও পদোন্নতির নজির আছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের বয়স ও অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা অমানবিক। প্রাথমিক শিক্ষকদের পরিচালক পর্যন্ত কাজ করার স্বপ্ন শুধুই যেন রূপকথার গল্প। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি বিধিমালা ঘিরে রয়েছে চরম অসন্তোষ। মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষা ও প্রশাসন ক্যাডার। বিভিন্ন পদে বিভাগীয় পদোন্নতির পরিবর্তে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ অবারিত করায় প্রাথমিকের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ। বয়সসীমা ও সিনিয়রিটি নির্ধারণ এবং বিভিন্ন পদের যোগ্যতা হিসাবে বাধ্যতামূলক বিএড, প্রাথমিকের প্রশিক্ষণ একেবারে গুরুত্বহীন করায় প্রাথমিক শিক্ষা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে এ নিয়োগবিধি। প্রশাসন ক্যাডার ও সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারদের কারোরই এ নিয়ে চিন্তা নেই। তাদের চিন্তা প্রাথমিকের ওপর কর্তৃত্ব করে স্বীয়স্বার্থ হাসিল করা। নতুন বিধিমালার ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন প্রেষণে বদলির মাধ্যমে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রেষণে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলির মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার হওয়ায় মূলত সচিবের হাতেই সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইন করে সচিবের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এই ধারা ব্যবহার করে শিক্ষা ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার দখলে নেওয়া হবে বলেও তাদের আশঙ্কা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বিধিমালার ৯(১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ১০ ক্যাটাগরির ৫১২টি পদ ক্যাডার কম্পোজিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এ পদগুলো নন-ক্যাডারভুক্ত হয়ে গেছে। পদগুলো যখন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ছিল, তখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন নন-ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্যাডারভুক্ত পদে পদোন্নতির সুযোগ ছিল। এই সুযোগ ও মর্যাদা বাতিল হওয়ায় কর্মকর্তারা বিদ্যমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেটেড কর্মকর্তা ও নন-গেজেটেড কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮৫-তে উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার ও অন্যান্য পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিল। ১৯৯৪ সালে ওই নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হলেও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির যোগ্যতায় বাধ্যতামূলক ছিল শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩-এ সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রায় সব পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হয়েছে, যা মানসম্মত শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করার লক্ষ্যে মেধাবী, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষাপটে বহিরাগত নিয়োগ বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রাথমিক ক্যাডার সৃষ্টি করার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ
