Logo
Logo
×

বাতায়ন

এক দেশে দুই সমাজ

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ৬৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সেমিনারে একটি সময়োপযোগী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যপ্রবণতা এবং নিয়ামকসমূহ : সাম্প্রতিক প্রমাণ থেকে অন্তর্দৃষ্টি’। এ মূল প্রবন্ধটির শিরোনাম দেখেই দেশের চলমান আর্থিক ও সামাজিক সমস্যা-সংকটের আভাস পাওয়া যায়। সরকারের গৃহীত মেগা প্রকল্পের আড়ালে দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যকার আয়-বৈষম্য বৃদ্ধির উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই প্রকাশিত ও আলোচিত হয়ে আসছে। সে সময়ে ড. সেনের প্রবন্ধটি একটি প্রামাণিক দলিল হিসাবে কাজ করবে। তার মতে, ‘দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। আর এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে এক দেশে দুই ধরনের সমাজ গড়ে উঠেছে। এ বৈষম্য কমাতে হলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আর অর্থ পাচার এখন দাপ্তরিকভাবেও স্বীকৃত বিষয়।’ বর্তমান সময়ের আগে গত এক দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ অগ্রগতি সাধন করলেও ক্রমে তা আবার প্রকট হয়ে উঠছে। এর পেছনে কোভিড-১৯, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবও কাজ করেছে।

আয়বৈষম্য পরিমাপের জন্য গবেষকরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন, তার নাম গিনি সহগ। এর মান সর্বনিম্ন ০ এবং সর্বোচ্চ ১। যদি কোনো দেশে গিনি সহগের মান ০ হয়, তাহলে বুঝতে হবে আয়ের ক্ষেত্রে সে দেশে চূড়ান্ত সমতা রয়েছে। আর যদি গিনি সহগের মান ১ হয়, তাহলে বুঝতে হবে আয়ের ক্ষেত্রে সেদেশে চূড়ান্ত অসমতা বিরাজ করছে। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, কোনো দেশেই গিনি সহগের মান ০ অথবা ১-এ অবস্থান করে না, বরং ০ থেকে ১-এর মধ্যে অবস্থান করে। সেক্ষেত্রে কোনো দেশের আয়বৈষম্য ০ থেকে যতই ১-এর দিকে যাবে, মনে করতে হবে সে দেশে বৈষম্য বাড়তির দিকে। গিনি সহগের মান ০ দশমিক ৫০ অতিক্রম করলে বোঝায়, সেদেশে উচ্চ অসমতা বিরাজ করছে। বিনায়ক সেনের খানা-জরিপ বলছে, দেশে এখন গিনি সহগের মান ০ দশমিক ৫০, যার মধ্যে শহরাঞ্চলে সহগের মান ০ দশমিক ৫৪, আর গ্রামাঞ্চলে ০ দশমিক ৪৫। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অসমতার দেশ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। সেদেশে গিনি সহগের মান ০ দশমিক ৬৩। বিপরীতভাবে সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশ স্লোভাকিয়া, সেখানে সহগের মান ০ দশমিক ২৩। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ মান ০ দশমিক ৩৬, আর পাকিস্তানে ০ দশমিক ৩০। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ যখন তার যাত্রা শুরু করে-১৯৭২ সালে-আমাদের দেশে গিনি সহগের মান ছিল ০ দশমিক ২৪।

যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই বৈষম্য বাড়ছে। যারা উন্নয়নের রমরমা প্রচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তাদের এ ভয়াবহ বৈষম্যের কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। আয়বৈষম্যের পাশাপাশি ভোগের ক্ষেত্রে অসমতা বেড়েছে। ২০২২ সালে দেশে জাতীয় পর্যায়ে ভোগ অসমতার ক্ষেত্রে গিনি সহগের মান ছিল ০ দশমিক ৩৩৪, যা শহরাঞ্চলে ০ দশমিক ৩৩৪, আর গ্রামাঞ্চলে ০ দশমিক ২৯১। ড. বিনায়ক সেন মনে করেন, বর্তমান সময়ে দেশে যে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে, তা এ অসমতা দূর করতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা অসমতা দূরীকরণে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। ২০১৬ সালের খানা-আয় জরিপ বলছে, তখন দেশের ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ছিল। তথ্যে দেখা যায়, গ্রাম ও শহরাঞ্চলে এ নিয়ে বিস্তর ব্যবধান আছে। গ্রামাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার থাকলেও শহরাঞ্চলে রয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার। অথচ শহরাঞ্চলে আয়বৈষম্য গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি।

ড. বিনায়ক সেন মনে করেন, শিক্ষাবৈষম্যের কারণে একই দেশে দুটি সমাজ তৈরি হয়েছে। এদেশে একাধিক পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এদেশের চিন্তকরা বহুদিন ধরে একই পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবি করে আসছেন। কিন্তু কার্যত এ দাবির কোনো প্রভাব পড়েনি। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রধান অন্তরায়। ড. সেন বলেন, সংসদ সদস্য, গুলশান ও ঢাকা ক্লাবের সদস্যদের পরিবারের সন্তানরা উন্নত দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে; আর অন্যরা বড় হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। ফলে এক দেশে দুই ধরনের সমাজ গড়ে উঠছে। দেশে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা নেই, এটাও একটা বড় সমস্যা।

চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছেন। ড. সেনের মতে, বর্তমানে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার আশপাশে অবস্থান করছে। তবে চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে এসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। তিনি মনে করেন, দারিদ্র্যের এ প্রবণতা মোকাবিলা করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে। অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণ বর্তমান সময়ে অনেক বেশি আলোচিত একটি বিষয়। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটা অনুমাননির্ভর কথা নয়, ওয়াশিংটনভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির গত এক দশকের গবেষণার ফল। পাশাপাশি ঋণখেলাপির কথাও বানিয়ে বলার কিছু নেই। খোদ সরকারি হিসাবমতেই দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত হিসাবে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। এ দুটি বিষয়ে ড. বিনায়ক সেনের বক্তব্য হলো, ‘বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচার হচ্ছে, এটা এখন দাপ্তরিকভাবেও স্বীকৃত। এটা বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতেই হবে। পাশাপাশি খেলাপি গ্রাহক যারা নির্বাচন করছে, তাদের থেকেও ৩০ শতাংশ অর্থ আদায় করতে হবে। এখন খেলাপি ঋণ চারবার পুনঃতফসিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে, তা কমিয়ে দুইবারে নামিয়ে আনতে হবে। কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, যা সবাইকে খুশি করবে না।’ তিনি আগামী ৬ মাসের মধ্যে বাজারভিত্তিক ডলারের বিনিময় হার চালু, সুদহার ও দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনা চালু, মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, চলতি হিসাবে উন্নয়ন এবং পরিমিত পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখার পরামর্শ দেন।

পরিশেষে, আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার উপায় হিসাবে ড. সেনের বক্তব্য হলো, ‘গিনি সহগে উন্নতি করতে ছোট ও মাঝারিদের জন্য সহজে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্রদের অর্থায়নের জন্য দেশে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখন ছোট ও মাঝারিদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ এর বাইরে আমরা মনে করি, ধনিকগোষ্ঠীর ওপর সম্পদ কর বাড়িয়ে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন খাতে ব্যয় করতে হবে। বিশ্বের কল্যাণরাষ্ট্র বলে পরিচিত দেশগুলোতে এমনটিই করা হয়ে থাকে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম