Logo
Logo
×

বাতায়ন

ব্যবসায়ীরা এত বেশি সংখ্যায় রাজনীতিতে আসছেন কেন?

Icon

এমএ আজিজ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। তাই ওই বছরেরই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন ধার্য করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনি তফশিলে ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ২৮ নভেম্বর বলেছেন, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে নির্বাচনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাহির থেকেও থাবা, হাত এসে পড়েছে। দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে।’ এ বক্তব্যের পর বোঝা যায়, সিইসি হয়তো আগেই জানতেন, ‘মার্কিন শ্রমনীতির লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশ।’

যা হোক, এ লেখায় অন্য একটি বিষয়ের গভীরে ঢুকতে চাই। যেমন-আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি দল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। ৩০ নভেম্বর শেষদিন পর্যন্ত সব দলের মনোনীত, স্বতন্ত্র, বিদ্রোহী ও ডামি প্রার্থী মিলে ২ হাজার ৭৪১ জন ৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৯৮ জন।

২ হাজার ৭৪১ জন মনোনয়নপত্র জমাদানকারীর মধ্যে কোন পেশার কতজন, তা এখনই জানা সম্ভব হয়নি। তবে গণমাধ্যম সূত্রে ইতোমধ্যেই জানা গেছে, রাজনীতিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, সাবেক উচ্চপদস্থ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, শিল্পী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ নানা ‘কিসিম’র মানুষ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে বর্তমান জাতীয় সংসদের মতোই এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, বর্তমান সংসদে মোট সংসদ-সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিবিদ আছেন মাত্র ৫ শতাংশ, ব্যবসায়ী ৬১ শতাংশ এবং বাকিরা অন্য পেশার। আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায়ও একই ফল দেখানো হয়েছিল-একাদশ জাতীয় সংসদে আছে ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ মাত্র ৫ শতাংশ এবং বাকি ৩৪ শতাংশের মধ্যে আইনজীবী ১৩ শতাংশ ও অন্যান্য পেশার ২১ শতাংশ। প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ ছিল ব্যবসায়ী।

তাহলে বলাই যায়, রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই। অর্থাৎ দেশ অর্থের প্রভাবে ধীরে ধীরে বিরাজনীতিকরণ হচ্ছে। এভাবেই রাজনীতি রাজনীতিকদের কাছ থেকে প্রায় ছুটে গেছে। তাই রাজনীতি এখন ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের দখলে। ফলে রাজনীতিতে রাজনীতিকরা প্রায় একঘরে। আবার যারা আছেন, তাদের মধ্যেও অধিকাংশ রাজনীতিক রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

একজন সংসদ-সদস্যের প্রধান দায়িত্ব মোটা দাগে চারটি। প্রথমত, আইন প্রণয়ন; দ্বিতীয়ত, জাতীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক করে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছা; তৃতীয়ত, সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদন করা; চতুর্থত, সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ চারটি দায়িত্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণের সেবার লক্ষ্যে কাজ করা ছাড়া আর্থিক কোনো সুবিধা নেওয়ার বা আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। তাহলে সংসদ-সদস্য হওয়ার আকর্ষণটা কোথায়?

বর্তমানে একজন রাজনৈতিক নেতা বা সংসদ-সদস্য হওয়ার আকর্ষণটা হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তার এলাকার পুরো ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার এবং জাতীয় পর্যায়েরও কিছু ক্ষেত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তার করে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। ব্যবসায়ীরা এ কারণেই অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা ও আধিপত্য এবং সহজে অর্থবিত্তের মালিক হতে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তারপর সংসদ-সদস্য ও পরের ধাপে কেউ কেউ উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হন। এরপর তার ‘ভাগ্য’ তিনি নিজে নিজের মতো করে গড়ে তোলার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করে নেন। এটা তারা হয়তো ‘রাজনৈতিক বিনিয়োগ’ হিসাবেই দেখেন।

যে কোনো পেশার মানুষ রাজনীতি করতে পারেন। এটি তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে প্রতিটি পেশা বা কাজে অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতিটা এতই সহজলভ্য করে ফেলা হয়েছে যে, কেউই অন্য কাজে পারদর্শী না হলেও অনায়াসে রাজনীতি করতে পারেন!

দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, নির্লোভ ও সৎ রাজনীতিকদের কাছে রাজনীতিকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। প্রতিটি রাজনৈতিক দল এ ধরনের জনহিতৈষীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে দেশের গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারে। সরকার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিকরা অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে দক্ষ হবেন, যেহেতু তাদের এবং জনগণের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া থাকে। তাই রাজনীতিকরাই জনগণের নাড়ির স্পন্দন বা চাহিদা সহজে বুঝতে পারেন।

বর্তমানে সরকারের মধ্যে রাজনীতিকের সংখ্যা অত্যন্ত কম থাকায় সরকার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না। তাই, দেশের চাহিদার চেয়েও আলু মজুত বেশি থাকলেও বা সয়াবিন তেলভর্তি জাহাজ বন্দরে থাকতেও বাজারে খাদ্য পণ্যগুলোর দাম বাড়ে।

প্রচলিত কথা আছে, ‘শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারায় রাখলে শিয়ালই তা সাবাড় করে।’ অর্থাৎ একজন ব্যবসায়ী যদি সরকারের কোনো বিষয় তদারকির দায়িত্ব পান, তাহলে তিনি স্বভাবগতভাবেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষার চেষ্টা করবেন। অপরদিকে, জনহিতৈষী একজন রাজনীতিক ওই দায়িত্ব পেলে তার কাছে অবশ্যই দেশ ও জনগণের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে। দেশের কোনো বড় দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। এ দলগুলোর মধ্য থেকে কোনো দল জনগণের ভোটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও তার নেতৃত্ব হয়ে ওঠেন কর্তৃত্ববাদী শাসক। এসব কর্তৃত্ববাদী শাসকের পছন্দের তালিকায় জনহিতৈষী রাজনীতিকদের চেয়ে অনুগত অলিগার্কের প্রাধান্যই বেশি থাকে। গুটিকতক স্বজোনতোষী অলিগার্কের হাতে দেশে-বিদেশে অসামান্য অর্থ-সম্পদ পুঞ্জীভূত, লাগামহীন দুর্নীতি সর্বস্তরে, নিয়ন্ত্রণহীন অর্থ পাচার, চরম ডলার সংকট, সর্বোচ্চ আয়বৈষম্য দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপমতে, দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে দরিদ্র মানুষ ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পাশাপাশি ৯০ শতাংশ মানুষ আয়বৈষম্যের শিকার। যেমন-১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৪১ শতাংশ অর্থ। অপরদিকে, সর্বনিম্ন আয়ের ১০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে ১.৩১ শতাংশ অর্থ।

আর নয়, দেশের শ্রমিকনির্ভর অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে জনহিতৈষী রাজনীতিকদের কাছে রাজনীতিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তারাই পারবেন এ সমস্যাবহুল দেশ ও জাতির মুক্তির দায়িত্ব নিতে।

এমএ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম