Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

সংস্কৃতি ও সদাচার : পরিপূরক সত্তা

Icon

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাভাষায় সংস্কৃতি শব্দটির প্রচলন খুব পুরোনো নয়। আগে ইংরেজি ‘কালচার’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলায় ‘কৃষ্টি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘কৃষ্টি’ শব্দটি কৃষি কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকায় কালচার অর্থে কৃৃষ্টির ব্যবহার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অনীহা ছিল। কৃষ্টির বদলে কালচার অর্থে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্য সুনীতি কুমারের প্রস্তাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন। এভাবে বাংলাভাষায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির অন্তর্ভুক্তি ঘটে।

সুনীতিকুমারের অন্যতম কীর্তিমান ছাত্র গোপাল হালদার ১৯৪১ সালে ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ নামে একটি বই লেখেন। সংস্কৃতি শব্দ দিয়ে বাংলায় কোনো বইয়ের নামকরণ এই প্রথম। পরবর্তীকালে তার হাতেই রচিত হয় ‘বাঙালি সংস্কৃতির রূপ’ ও ‘বাঙালি সংস্কৃতি প্রসঙ্গ’ বই দুটি। তাই বাংলাভাষায় সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় গোপাল হালদারের ভূমিকা পথিকৃতের। পরবর্তী সময়ে অন্য লেখকেরা সংস্কৃতি বিষয়ে যাই লিখেছেন তা গোপাল হালদারের আলোচনার সম্প্রসারণ অথবা আংশিক খণ্ডন। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গোপাল হালদারের পর সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম মোতাহের হোসেন চৌধুরী। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তার ‘সংস্কৃতি কথা’ বইটি শিক্ষিত বাঙালির বিপুল অভিনন্দন লাভ করে এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের রায়ে এ বইটি আমাদের সাহিত্যের বাতিঘর বিশেষ। বইটির সূচনা প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচা প্রকৃতি সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, প্রচুরভাবে গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।’

উপরোক্ত সংজ্ঞার মধ্যে সংস্কৃতির প্রাণবীজটুকু ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শুধু সংস্কৃতির সংজ্ঞা নয়, সংস্কৃতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। ঐতিহ্যপরম্পরা ও উত্তরাধিকারকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতি নির্মিত ও বিকশিত হয়। মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যে ঐতিহ্যপরম্পরার সঞ্চয় যুগে যুগে বয়ে নিয়ে চলে তাই হলো সংস্কৃতি। সদাচারের আভিধানিক অর্থ শুদ্ধ আচরণ বা সাধু ব্যবহার। প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থেই শুদ্ধ আচরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যদিও ধর্মচর্চা করলেই সদাচারী হওয়া নিশ্চিত নয়। এ দেশের প্রেক্ষাপটে নীতি-নৈতিকতার সমার্থক সদাচার। একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে, সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সদাচারের। সেই সূত্রে ব্যক্তি ও সমাজের সঙ্গেও সংস্কৃতি ও সদাচার সম্পর্কিত। সংস্কৃতিচর্চা ব্যক্তির রুচিকে উন্নত করে, তার ভেতরে পরিশীলিত ও মার্জিত বোধের জন্ম দেয়।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি কথা দুটিকে প্রায়ই আমরা সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করি। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত রায়ের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কমল হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি। এ দীপ্তি সংস্কৃতির শক্তি। শিক্ষিত মানুষ মাত্রই সংস্কৃতিমান নন, সংস্কৃতিমান ব্যক্তি মাত্রই শিক্ষিত। ব্যক্তি যখন সংস্কৃতির দীপ্তিতে আলোকিত হয়, সমাজ তখন বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। একটি প্রাণবন্ত সংস্কৃতির উপস্থিতি সুস্থ সমাজের লক্ষণ। সদাচার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করতে হয়। সদাচার বহুমাত্রিক-সত্যবাদিতা, সততা, পরহিতকর মনোভাব, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, নিষ্ঠা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে সদাচার বিকশিত হয়। সদাচারের শিক্ষা আমরা পাই পরিবারে ও প্রতিষ্ঠানে। শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে পরিবার থেকে। মা-বাবা ও নিকট আত্মীয় যে আচরণ করে তা দেখে সহজে অনুপ্রাণিত হয় শিশুরা। শিক্ষকের কাছে সদাচারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে তারা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সদাচারের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেনি। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির একটি বড় অংশের মধ্যে সদাচারের অভাব পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা থেকে তৈরি হয়েছে। ব্যক্তির সদাচারের অভাব সমাজকে সহজে গ্রাস করে। মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নীতিহীনতা সদাচারের সংকটের পরিচায়ক।

হাঙ্গেরির দার্শনিক লুকাচ বলেছিলেন, ‘পলিটিক্স ইজ ওনলি দ্যা মিনস, কালচার ইজ দ্যা গোল’। সংস্কৃতি হচ্ছে লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়। সংস্কৃতি ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্লেষকরা মাঝে মাঝে এ দেশের রাজনীতিকে অসুস্থ রাজনীতি আখ্যা দেন। এ অসুস্থতার কারণ সংস্কৃতিবর্জিত রাজনীতি। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে, রাজনীতি তখনই গণমুখী ও সফল হয়েছে যখন এর সঙ্গে সংস্কৃতি যুক্ত হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরির পর থেকেই বাঙালিরা শোষণের শিকার হতে থাকে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক-নানামাত্রিক শোষণ থাকে অব্যাহত। লক্ষণীয় যে সাংস্কৃতিক শোষণই বাঙালিকে প্রথম অধিকার সচেতন করে তোলে যার তীব্র বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই পরবর্তীকালে রাজনীতি অগ্রসর হয়েছে। এ সাংস্কৃতিক চেতনাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে নানা প্রতিকূলতা তৈরি করে পাকিস্তান সরকার। সেই বাধা পেরিয়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে উদযাপিত হয় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। ১৯৬৪ সালে প্রথম রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। এ অনুষ্ঠানটি এখন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ। ষাটের দশকে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল সংস্কৃতিচর্চার কারণে। রাজনীতি ও সংস্কৃতি তখন হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়েছে। এরই সার্থক পরিণতি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সাংস্কৃতিক পটভূমির কারণে। পরবর্তী সময়ে রাজনীতি যে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে এর বড় কারণ সংস্কৃতির সঙ্গে এর বিযুক্ততা।

সংস্কৃতি কোনো স্থবির বিষয় নয়। সংস্কৃতির ধর্ম বহমানতা ও পরিবর্তনশীলতা। এ পরিবর্তনের অনুঘটক হতে পারে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রভাবে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটেছে। রূপান্তর বিকাশের একটি রূপ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি বিপন্ন-এমন একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। বাইরের সংস্কৃতি এ দেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে সন্দেহ নেই। তাই বলে বিশ্বায়নের যুগে দরজা জানালা বন্ধ করে নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করার চিন্তা হাস্যকর। বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে...’ এটাই সংস্কৃতি চর্চার দর্শন হওয়া উচিত। সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বিশ্বায়নের সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অপরিহার্য।

বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণভোমরা লুকিয়ে রয়েছে কৃষিভিত্তিক লোকসংস্কৃতিতে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা লোকায়ত সংস্কৃতির ভিত্তি। কৃষকের ঘরে নতুন ধান উঠলে তার মনে গান বেজে ওঠে। বাঙালির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব বাংলা নববর্ষ। আবহমান গ্রামবাংলার চিরন্তন উজ্জ্বলতার প্রতীক নববর্ষ। নতুন বছরে হালখাতা, নতুন শস্য, গ্রামীণ মেলা ও সংস্কৃতির আয়োজন নববর্ষকে নতুন মাত্রা দান করে। কয়েক দশক ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষের সবচেয়ে বড় আকর্ষণে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নাগরিক সংস্কৃতিরও বিকাশ ঘটেছে। বর্ষাবরণ, শারদ উৎসব, বসন্ত উৎসবের মতো ঋতুভিত্তিক গ্রামীণ আয়োজনগুলো এখন নাগরিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সংগ্রামের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে হয়েছে। এমনকি বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথকে প্রাত্যহিক জীবনচর্চার অঙ্গ করতে হয়েছে লড়াইয়ের বিনিময়ে। স্বাধীন বাংলাদেশেও সংস্কৃতিচর্চা আক্রান্ত হয়েছে। রমনার ঐতিহ্যবাহী বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছে। উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মসূচিতে আঘাত করেছে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী। সংস্কৃতির জোর এখানে যে বাধা পেলে সে আরও জাগ্রত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে বেড়ে ওঠা মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। গ্রামীণ ও নাগরিক উভয় অবয়বে বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটেছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে।

আগেই বলা হয়েছে, সংস্কৃতি কোনো স্থবির বিষয় নয়। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এর বিকাশ ঘটে। এ পরিবর্তনশীলতা সংস্কৃতির অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। আবার কোনো কোনো পরিবর্তন সংস্কৃতির অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভরতা। প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে সহজ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রযুক্তির অতি ব্যবহার বা অপব্যবহার একই সঙ্গে জীবনকে বিপন্ন করছে। এ সময়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবার প্রিয় বস্তু স্মার্টফোন। বিনোদনের সব উপকরণ এ আয়তাকার যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান। ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। এ আসক্তি মাদকের চেয়ে কম ভয়ংক নয়। ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি এত প্রবল যে, অনেক সময় রিয়্যাল জগৎ উপেক্ষার শিকার হয়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে, পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যোগাযোগ আর বন্ধন এক নয়। প্রযুক্তিনির্ভর এ যোগাযোগের কারণে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবারের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেন না, পরস্পরকে সময় দিচ্ছেন না। আড্ডায় বসেও বন্ধুরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে নিজের সেলফোন নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

প্রযুক্তিনির্ভর এ সংস্কৃতি পাঠাভ্যাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক প্রায় সবাই বই ছেড়ে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট। গ্রন্থাগারগুলোতে বই আছে, পাঠক নেই। যে কয়েকজন পাঠক পাওয়া যায়, তারা চাকরিপ্রত্যাশী পাঠক। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তারা গ্রন্থাগারে যায়। এভাবে পাঠাভ্যাসের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়েছে। শিল্পের গুণগত মানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে। আগে একজন অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী কিংবা অন্য যে কোনো শিল্পী সাধনা দিয়ে দর্শক-শ্রোতার মন জয় করতেন। এখন সাধনার মধ্য দিয়ে শিল্পী তৈরি হওয়ার প্রবণতা নেই, রাতারাতি সবাই তারকা হতে ব্যস্ত। কে কত ‘ভিউ’ পেল তা হয়ে উঠেছে সাফল্যের মানদণ্ড। সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ তাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছে যে, তাদের কেউ কেউ বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দিয়ে আলোচনায় থাকতে চান। একশ্রেণির গণমাধ্যমও এক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। রুচিহীন ও মুখরোচক খবর পরিবেশনের স্থূল প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। এ পরিস্থিতি স্বভাবতই রুচির সংকট তৈরি করেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এ সংকট বিদ্যমান। বাণিজ্যিক ও ভোগসর্বস্ব মানসিকতায় অধিকাংশ ব্যক্তি আক্রান্ত। সামাজিক অঙ্গীকার তথা দায়বদ্ধতার বোধ যেন দিন দিন লুপ্ত হচ্ছে। জীবনকে সার্থক করে তোলার লক্ষ্য কোথাও নেই, সর্বত্রই সস্তা সাফল্যের হাতছানি। ফুল নিজের জন্য ফোটে না। কুঁড়ি থেকে পূর্ণ পুষ্পে রূপান্তরিত হওয়া ফুলের সাফল্য। এর সৌরভ যখন চারপাশকে মুখরিত করে, সেটি হয়ে ওঠে ফুলের সার্থকতা।

এ সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। জিজ্ঞাস, সংস্কৃতিমান, মানবহিতৈষী ও প্রজ্ঞাবান মানুষের অভাব দৃশ্যমান। সম্প্রীতি, সৌজন্য ও উদারতা হারিয়ে যেতে বসেছে। সদাচার ও সংস্কৃতির সমর্থক যারা, সভ্যতা ও সৌন্দর্যের পূজারি যারা তাদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। অশুভ শক্তি বরাবরই সংঘবদ্ধ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংস্কৃতিমান মানুষেরা সংগঠিত নন। এটি সদাচারী সংস্কৃতির দুর্বলতার পরিচায়ক। বিশ্বব্যাপী উগ্র জাতীয়তাবাদ, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধ করতে হলে চেতনার জাগরণ প্রয়োজন। বাসযোগ্য মানবিক স্বদেশ ও বিশ্ব নির্মাণে শুভ শক্তির বিজয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ বিজয় সদাচারের বিজয়, এ বিজয় সংস্কৃতির বিজয়। সদাচার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠে। ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধের সূচনা বাক্যে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম।’ শিক্ষিত ও মার্জিত লোকের হাতেই পৃথিবী নিরাপদ। সে লক্ষ্যে কালচার তথা সংস্কৃতির সাধনা অপরিহার্য। সদাচার এ লক্ষ্য অর্জনে সংস্কৃতির পরিপূরক সত্তা।

লেখক : গবেষক ও রম্যলেখক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম