বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় ফ্যাসিস্ট হাসিনাসমর্থক শিল্পীরা
জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থী ও সারা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিনোদন জগতের তারকারাও যখন রাজপথে নেমে এসেছিলেন, ঠিক তখন শোবিজে দেখা যায় বিভক্তি। শিল্পীদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে থাকলেও, আরেক দল স্বৈরাচার হাসিনার তোষামোদি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আওয়ামী সুবিধাভোগী এসব শিল্পীর অনেকেই ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রয়েছেন আত্মগোপনে, এদের কেউ কেউ দেশ থেকেও পালিয়ে গিয়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
রিয়েল তন্ময়
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তারপর থেকেই আত্মগোপনে যেতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী, নেতাকর্মী, সমর্থকসহ অনেকেই। এ তালিকায় রয়েছেন অনেক শোবিজ তারকাও। শোবিজের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে গত সরকারের আমলে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ছাত্র-জনতার রক্তে যখন রাজপথ রক্তাক্ত, মুক্তিকামী দেশবাসী যখন তাদের নির্মম মৃত্যুতে কাঁদছে, ঠিক তখন ইট-পাথরের তৈরি কিছু ভবনের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন একদল সুবিধাভোগী শিল্পী। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি শিল্পীদের একাংশ। বিটিভিতে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে ১ আগস্ট বিটিভি প্রাঙ্গণে হাজির হন সংস্কৃতি অঙ্গনের আওয়ামীপন্থি একঝাঁক তারকাশিল্পী। তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা ফেরদৌস, রিয়াজ, আজিজুল হাকিম, অভিনেত্রী নিপুণ, সোহানা সাবা, রোকেয়া প্রাচী, জ্যোতিকা জ্যোতি, নূনা আফরোজ, কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব, নির্মাতা এসএ হক অলীক, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুসহ আরও অনেকে। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড। অগ্নিকাণ্ডে বিটিভির ক্ষয়ক্ষতি দেখে তাদের অনেকে অঝোরে কেঁদেছিলেন। অথচ ওই সময় নিহত ছাত্র-জনতার জন্য তাদের চোখে কোনো পানি ছিল না। তাদের চোখের পানি গড়িয়েছে ইট পাথরের দেওয়ালের জন্য। এর আগেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার সমর্থনে বিটিভি ভবন পরিদর্শন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সারা যাকের, পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ। শুধু তাই নয়, ছাত্রদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে আওয়ামীপন্থি সেসব শিল্পী খুলেছিল ‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। সেখানে পরিকল্পনা করা হতো কীভাবে ছাত্র-জনতার গায়ে ‘গরম পানি’ ঢেলে দিয়ে আন্দোলন দমানো যায়। এ গ্রুপে দুই শতাধিক সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। যারা জুলাই বিপ্লবের পুরোটা সময় শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছেন এবং কীভাবে আন্দোলনকে দমানো যায় তার পরামর্শ দিয়েছেন। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাতের সমন্বয়ে এ গ্রুপের অ্যাডমিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য ও অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ, রিয়াজ, সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী শামীমা তুষ্টি। গ্রুপের অন্য সদস্যদের মধ্যে শোবিজের ছিলেন-অরুণা বিশ্বাস, তানভীন সুইটি, জ্যোতিকা জ্যোতি, রোকেয়া প্রাচী, সোহানা সাবা, সুবর্ণা মুস্তফা, বিজরী বরকতুল্লাহ, স্বাগতা, শমী কায়সার, আশনা হাবীব ভাবনা, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, হৃদি হক, দীপান্বিতা মার্টিন, নূনা আফরোজ, মেহের আফরোজ শাওন, সঙ্গীতা মেখাল, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, রওনক হাসান, রফিক (রজনীগন্ধা), জামশেদ শামীম, খান জেহাদ, আশরাফ কবীর, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, ঝুনা চৌধুরী, লিয়াকত আলী লাকি, সাইফ খান, স্মরণ সাহা, সায়েম সামাদ, শাকিল (দেশনাটক), শহীদ আলমগীর, মো. শাহাদাত হোসেন, মিলন ভট্ট, বদরুল আনাম সৌদ, মাসুদ পথিক, এবার্ট খান, জুয়েল মাহমুদ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, এসএ হক অলীক, রুবেল শঙ্কর, রাজিবুল ইসলাম রাজিব, সৈয়দ আওলাদ প্রমুখ। এদিকে অনেক শোবিজ তারকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ছাত্ররা যখন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল, তখন সেটার বিরোধিতা করে ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ৫ আগস্টের পর লাপাত্তা হয়ে গেছেন। অনেকেই পালিয়ে গেছেন বিদেশে। সেখানেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা, তারিন জাহান, ফেরদৌস আহমেদ, জায়েদ খান, অরুণা বিশ্বাস, মাহিয়া মাহী, সাইমন সাদিকসহ অনেকে। বিদেশে বসে কিংবা দেশে আত্মগোপনে থেকেও এদের অনেকেই সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে আওয়ামী প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে বেশ সরব রয়েছেন।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ-সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা অনেক দিন ধরেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। গত বছর ৩০ নভেম্বর চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যাওয়ার পথে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে এবং তার স্বামী নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে আটকে দেওয়া হয়। চেকইন ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হওয়ার পর বোর্ডিং শুরুর পাঁচ মিনিট আগে অভিবাসন পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাদের ফিরিয়ে দেন। তবে বর্তমানে এ দম্পতি ব্যাংককেই রয়েছেন। বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র তথ্যটি নিশ্চিত করেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে তারা কীভাবে দেশটিতে গেলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।
অভিনেত্রী তারিন জাহান পালিয়ে রয়েছেন ভারতে। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন (১ আগস্ট) দেশ ছাড়েন অভিনেত্রী তারিন জাহান। প্রথমে গেলেন তুরস্ক, সেখান থেকে ভারত। বর্তমানে দেশটিতেই রয়েছেন অভিনেত্রী। তবে পালিয়ে যাওয়া বেশির ভাগ শিল্পীই যুক্তরাষ্ট্রে ঠাঁই নিয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন অভিনয়শিল্পী জায়েদ খান, সাইমন সাদিক, লিটু আনাম, মাহিয়া মাহী, সাজু খাদেম, সোনিয়া হোসেন, নির্মাতা অমিতাভ রেজা, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামূল, কণ্ঠশিল্পী রেশমী মির্জা প্রমুখ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন অভিনেতা বাপ্পী চৌধুরী ও মাহিয়া মাহী।
কানাডায় পালিয়ে রয়েছেন অরুণা বিশ্বাস। ৫ আগস্টের কয়েক দিন বাদে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘আলো আসবেই’-এর একটি স্ক্রিনশট ফাঁস হয়। সেখানে দেখা যায়, আওয়ামী লীগসমর্থিত শিল্পীদের একটি অংশ ছাত্রদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে অভিনেত্রী ও নির্মাতা অরুণা বিশ্বাসকে বলতে দেখা যায়, ছাত্রদের ওপর ‘গরম পানি’ ঢেলে দিতে। বিষয়টি অন্তর্জালে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে তোপের মুখে পড়েন এ অভিনেত্রী। তড়িঘড়ি করে দেশ ছেড়ে তিনি কানাডা চলে যান।
এ ছাড়া সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট সরকারের এমপি ফেরদৌসকে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। বেশ কিছুদিন পর দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়, এ অভিনেতা ভারতের কলকাতায় তার প্রিয় বান্ধবী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের আশ্রয়ে আছেন। পরে সেখান থেকেই হয়তো আমেরিকায় পাড়ি দেন। কিছুদিন আগে আমেরিকায় জায়েদ খানের একটি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে দেখা গেছে ফেরদৌস, মৌসুমী এবং ঋতুপর্ণাকে।
চিত্রনায়ক সাইমন সাদিক আওয়ামীলীগের সক্রিয় কর্মী। আন্দোলনপরবর্তী তিনিও পালিয়ে যান আমেরিকায়। বর্তমানে সেখান থেকে তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে জুলাই আন্দোলনের বীর শহীদ ও আহতদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় শিল্পীদের অনেকে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়েছিলেন। অনেকে সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিও করেছেন। দেশ ছাড়ার তালিকায় তাদের নামই বেশি থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের অনেকে দেশেই আছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, রিয়াজ, নিপুণ, সোহানা সাবা, মেহের আফরোজ শাওন, তানভীন সুইটি, জ্যোতিকা জ্যোতি দেশেই রয়েছেন। অনেকে দেশ ছাড়ার সাহস দেখাচ্ছেন না, যদি বিমানবন্দরে হেনস্তার শিকার হতে হয়, এই ভয়ে।
