বাণিজ্যিক সিনেমায় নারী চরিত্র অবহেলিত
ঢাকাই সিনেমায় অভিনেত্রীরা কখনো প্রেমিকা, কখনো স্ত্রী, কখনোবা মমতাময়ী মায়ের প্রতীক হয়ে পর্দা কাঁপিয়েছেন। তবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এলেও, দেশের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় এখনো নারী চরিত্র অবহেলিত। স্বাধীন ও শক্তিশালীভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারছে না তারা। এখনকার সিনেমায় নারীকে শুধু সৌন্দর্যের জন্যই ব্যবহার করা হয়। রাখা হয় দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য, যার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
রিয়েল তন্ময়
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকাই সিনেমা দীর্ঘ ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির একটি প্রতিচ্ছবি। সময়ের সঙ্গে শুধু গল্পের ধরন নয়, বদলে গেছে অভিনেত্রীদের চরিত্রায়ণও। এক সময় যেখানে নায়িকারা ছিলেন মূলত পুরুষপ্রধান গল্পের অনুষঙ্গমাত্র, সময়ের স্রোতে তারা হয়ে উঠেছেন গল্পের চালিকাশক্তি, প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ও নারীর নিজস্ব পরিচয়ের প্রতীক। ৫০ ও ৬০ দশকের দিকে ঢাকাই সিনেমার নারী ছিল শুধু আদর্শ নারীত্বের প্রতিচ্ছবি। সে সময়কার নায়িকারা মূলত ছিলেন পরিবারের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। তারা ছিলেন ভদ্র, শান্ত, আত্মত্যাগী, কখনো মা, কখনো প্রেমিকা, কিন্তু সব সময়ই ‘নিরাপদ’ নারী চরিত্র। ৭০ ও ৮০ দশকে সিনেমায় ছিল প্রেম, প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের মিশ্রণ। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সিনেমাগুলোতে উঠে এসেছে দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের ধারা। নায়িকারা তখন কেবল প্রেমিকা নয়, দেশের জন্য লড়াই করা সংগ্রামী নারী হিসেবেও উঠে এসেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমার নাম বলা যেতে পারে। সেসময় নায়িকারা যেমন প্রেম করেছেন, তেমনি দুঃখ, বেদনা ও আত্মত্যাগের প্রতীকও হয়ে উঠেছেন। সে সময় অভিনয় করতেন কবরী, ববিতা, অঞ্জু ঘোষ, শাবানা প্রমুখ। শাবানার বহু সিনেমায় দেখা গেছে, তিনি পরিবারের জন্য আত্মত্যাগ করছেন বা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
নব্বই দশকের দিকে মূলত সিনেমায় নারী চরিত্রের ব্যবহারে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। সিনেমা হয়ে গেছে নায়ককেন্দ্রিক। তবু এর মধ্যেও নায়িকারা লড়াই করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-মোল্লাবাড়ির বউতে শাবনূর, ম্যাডাম ফুলিতে সিমলা, খায়রুন সুন্দরীতে মৌসুমী হয়ে উঠেছিলেন সিনেমার গল্পের মূল চালিকাশক্তি। তাদের অভিনীত আরও সিনেমা আছে যেগুলোতে গল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন এসব নায়িকা। কিন্তু প্রেক্ষাপট পালটে গেছে তাদের পরবর্তী সময়ে। বর্তমানে নায়িকারা প্রাধান্য পাচ্ছেন শুধু সৌন্দর্য, নাচ ও রোমান্সের মাধ্যমে। ব্যতিক্রম কিছু সিনেমাও আছে। তবে সেটা একেবারেই নগণ্য। বেশিরভাগ সময়ই নায়িকাদের অবস্থান নায়কের পাশে।
বর্তমান প্রজন্মের অনেক নায়িকাই নারীপ্রধান সিনেমার স্বাদ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। নতুন প্রজন্মের কিছু নির্মাতা নারীর মানসিক জগৎ, স্বপ্ন ও সংগ্রামকে গল্পের কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করেন। উদাহরণ দিয়ে বললে জয়া আহসান অভিনীত ‘দেবী’, আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমাগুলোতে নারী চরিত্রকে যথেষ্ঠ সুযোগ দেওয়া হয়েছে আত্মপ্রকাশের। তারা শুধু প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়, মা, শিক্ষক, সমাজের প্রতিবাদী মুখ হিসাবে উঠে আসেন। কিছু সিনেমায়ও নায়িকারা তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়েই গল্পের মূল চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তারা পেশাজীবী, সমাজচিন্তক, আত্মবিশ্বাসী এবং ভুল করলেও তার দায় নিজের কাঁধে নিতে জানেন এমন বার্তাও দিতে দেখা গেছে সিনেমাগুলোতে। তবে সেটি বিকল্পধারা বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত সিনেমাতেই বেশি দেখা গেছে। বিকল্প ধারার সিনেমা ও ওটিটি কনটেন্টের উদাহরণ দিলে উঠে আসবে বেশ কিছু সিনেমার নাম। যেমন মেহজাবীন চৌধুরী অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘সাবরিনা’, তাসনিয়া ফারিণ অভিনীত সিরিজ ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, নওশাবা আহমেদ অভিনীত ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, জয়া আহসান অভিনীত ‘নকশীকাঁথার জমিন’, বিদ্যা সিনহা মিম অভিনীত ‘পরাণ’, নাজিফা তুষি অভিনীত ‘হাওয়া’, তমা মির্জা অভিনীত ‘সুড়ঙ্গ’ ইত্যাদি সিনেমায় দেখা গেছে, নারী চরিত্ররা কেবল সহচরী নন, তারা সংগ্রামী, জটিল ও নেতৃত্বদানকারী। শুধু তাই নয়, এ সিনেমাগুলোও দর্শক সমাদৃত হয়েছে। তাতে করে প্রমাণিত যে নারী চরিত্রকে উপজীব্য করে সিনেমা নির্মাণ করলেও দর্শক তা সাদরেই গ্রহণ করবেন।
কিন্তু বর্তমানে যেসব বাণিজ্যিক সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে চলমান, তার অধিকাংশেই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পুরুষ চরিত্র। নায়িকারা সেখানে প্রেমের অনুষঙ্গ কিংবা দৃশ্যের শোভা বাড়ানো ছাড়া কার্যত কোনো কাজ নেই। তাদের নিজস্ব সংকট, লক্ষ্য কিংবা সিদ্ধান্তের জায়গা খুবই ক্ষীণ। এখনো নারী চরিত্রকে ঘিরে ‘আইটেম গান’, অপ্রয়োজনীয় নাচ-গানের দৃশ্য এবং সৌন্দর্য বিক্রির ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হয়। এ প্রবণতা নারীকে একটি ভোগ্যপণ্যে রূপান্তর করে, যেখানে তার মানবিকতা বা বাস্তবতা হারিয়ে যায়। কেন নারীপ্রধান গল্প তৈরি করা হচ্ছে না? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীদের অভিনয় জীবন পুরুষদের তুলনায় অনেক কম সময় স্থায়ী হয়। নায়িকারা বয়স ৩০ পার করলেই ‘নায়িকা’ চরিত্র থেকে সরে যেতে বাধ্য হন, অথচ পুরুষরা ৫০ বছরেও হিরো চরিত্রে অভিনয় করছেন। তবে এর পরিবর্তনও সম্ভব বলে মতপ্রকাশ করেছেন অনেকে। তাতে বদলাতে হবে চিত্রনাট্য ও দৃষ্টিভঙ্গি। চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতাদের বড় একটি অংশ এখনো নারীর গল্পকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নারীর সংগ্রাম, মানসিক জটিলতা, পেশাগত চ্যালেঞ্জ কিংবা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নগুলো অধিকাংশ গল্পে অনুপস্থিত। ফলে পর্দায় উঠে আসে একঘেয়ে ও রূঢ়ভাবে সাজানো নারীচরিত্র। মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় এখন আর আগের মতো নারী চরিত্র সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালীভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারছে না। একাধিক চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতার কারণে নায়িকা তথা নারীরা আজও অনেকটা পিছিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলধারার সিনেমায় নারীর অবস্থান উন্নত করতে হলে নারী নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে পুরুষ নির্মাতাদের মধ্যেও সচেতনতা আনতে হবে, যাতে তারা নারীর বাস্তবতা বুঝে শক্তিশালী ও মানবিক চরিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন। নারী চরিত্রায়ণে গুরুত্ব দিলে ঢাকাই সিনেমায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে পারে বলেও আশা করছেন সিনেমা বিশ্লেষকরা। সেজন্য অবশ্যই আরও কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ করে নজর দিতে হবে। যেমন, নারীর অভিজ্ঞতা থেকে নারীর গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণে নারী নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকারদের এগিয়ে আসতে হবে, দর্শকের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে এমন বাস্তবধর্মী নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে, নারীকেন্দ্রিক সিনেমাও সফল হতে পারে এমন ভাবনায় প্রযোজকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে, সিনেমায় সমতা ও স্বাধীনতা প্রতিফলিত হয় এমন নারী নেতৃত্বের জায়গা তৈরি করতে হবে। অবশ্য কিছু নির্মাতা চেষ্টা করছেন পুরুষকেন্দ্রিক বলয় ভাঙার। এক্ষেত্রে দর্শকদেরও এখন এগিয়ে আসতে হবে, ভালো গল্প ও শক্তিশালী নারী চরিত্রের পক্ষে নিজের অবস্থান জানাতে। না হলে, নারীর গল্প শুনতে শুনতেই হারিয়ে যাবে এক সম্ভাবনার সিনেমা।
