Logo
Logo
×

আনন্দ নগর

ঢালিউডের হৃদয়, অথচ মৃতপ্রায় এফডিসি

একটা সময় ছিল, যখন দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই এফডিসির ফ্লোরগুলো মুখর হয়ে উঠত। ক্যামেরা রেডি, ক্ল্যাপস্টিক ধরা সহকারী পরিচালক, আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারস্টার, আর তার চারপাশে ঘুরে চলা কুশলীরা- সব মিলিয়ে ছিল এক জাদুকরী পরিবেশ। সেই এফডিসি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা) আজ যেন নীরব, ক্লান্ত এবং মৃতপ্রায়। নেই শুটিং ও তারকা শিল্পীদের পদচারণা। কাজবিহীন এফডিসি প্রাঙ্গণ যেন নিস্তব্দ নগরী। তারকাদের স্মৃতি, ভালোবাসা ও সিনেমার আঁতুড়ঘর খ্যাত এ জায়গাটির প্রাণ ফেরানোর ব্যাপারে কারও কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই।

Icon

রিয়েল তন্ময়

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এফডিসি (তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) মূলত সিনেমার সব ধরনের কাজ এক ছাদের নিচে করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এখানেই ক্যারিয়ার গড়েছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আলমগীর, ববিতা, জাফর ইকবাল, শাবানা, সালমান শাহ, মৌসুমী থেকে শুরু করে বহু তারকা। এখানেই তৈরি হয়েছিল কালজয়ী সব সিনেমা। তবে সেই গৌরবের ঠিকানা আজ যেন এক পরিত্যক্ত চলচ্চিত্র নগরী। অবকাঠামোতে ভাঙন, ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা, এসব সঙ্গী করেই চলছে এফডিসি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ স্টুডিও পরিত্যক্ত বা অকার্যকর। শুটিং ফ্লোরে নষ্ট এসি, ফাটল ধরা দেওয়াল, মলিন মেকআপ রুম, ঝাঁপসা লাইট, এসবই এখনকার বাস্তবতা। ল্যাবরেটরি, রেকর্ডিং স্টুডিও কিংবা পোস্ট-প্রোডাকশন ইউনিটগুলো আধুনিকায়নের অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশ্ব যখন ফোর-কে, এইট-কে, ভার্চুয়াল প্রোডাকশন ও ভিএফএক্সে এগিয়ে গেছে, তখন এফডিসিতে এখনো চলছে অ্যানালগ মনোভাব নিয়ে। ডিজিটাল ক্যামেরা, সাউন্ড প্রুফিং, কালার গ্রেডিং, প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট-সব কিছুতেই ঘাটতি। ফলে তরুণ নির্মাতারা বাইরে লোকেশন বেছে নিচ্ছেন, ইউটিউব বা ওটিটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রজেক্ট করছেন। এফডিসি থেকে তারা বিমুখ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন শিল্পীদের জন্য নেই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। পুরোনো তারকারাও অনুভব করেন, এফডিসি এখন আর সেই ‘মর্যাদার জায়গা’ নয়। এক সময়কার বিখ্যাত মেকআপ রুম, কস্টিউম ডিপার্টমেন্ট বা সেট ডিজাইনের জন্য পরিচিত বিভাগগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক। সিনিয়র শিল্পীদের পদচারণা এখন এফডিসিতে নেই বললেই চলে। তারা যেতেও চান না। এখানে রয়েছে শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতিসহ প্রায় ১৭টি সংগঠনের অফিস। সমিতির সদস্যদের আনাগোনা ছাড়া এফডিসিতে আর কেউ পারতপক্ষে যান না। মাঝে মাঝে এ সংগঠনগুলোর মধ্যেও দেখা যায় সমন্বয়ের বদলে দ্বন্দ্ব, দখলদারত্ব এবং ক্ষমতার লড়াই। যা এফডিসির পরিবেশ নষ্ট করে। ফলে প্রশাসন, বাজেট, রক্ষণাবেক্ষণসহ সবকিছুতেই তৈরি হয় স্থবিরতা।

এফডিসি কর্তৃপক্ষ সিনেমার উন্নয়নে কাজ করার কথা থাকলেও, তারা রয়েছে পিছিয়ে। যেখানে আজ দর্শক ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, বায়োস্কোপে সময় দিচ্ছে, সেখানে এফডিসির কোনো উদ্যোগ নেই। ওটিটি নির্মাতাদের সহযোগিতায় কোনো প্ল্যান নেই, নেই প্রশিক্ষণ বা টেকনিক্যাল সাপোর্টও। ওটিটি নির্মাতাদের মতে, ওটিটির জন্য শুট করতে এফডিসির চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র বা পুরান ঢাকা অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। কারণ এফডিসিতে পরিবেশটাই নেই।

সিনেমার সুদিন ফিরিয়ে আনতে এফডিসির উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ জরুরিভাবে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার কতটুকুও বা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপ, স্বচ্ছ বাজেট ও প্রশাসনিক জবাবদিহি, ওটিটি ও ওয়েব প্রোডাকশনের জন্য সহায়ক পরিবেশ, সমিতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও পুনর্গঠন, চলচ্চিত্র ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য ফিল্ম মিউজিয়াম ও আর্কাইভ তৈরি এগুলোর ব্যাপারে কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন কর্তৃপক্ষ? বিএফডিসির সংকট, সম্ভাবনা, পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুমা রহমান তানি বলেন, ‘বর্তমান সরকার কিছু জিনিস সংস্কার করার পর, দুটো ফ্লোর ভাড়া হচ্ছে রেগুলার। অনেক নিয়মতান্ত্রিক জটিলতা ছিল। যে কারণে মানুষ আরও অনুৎসাহিত হতো। ভাড়া বেশি ছিল। ভাড়া একদম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু আনুষাঙ্গিক কাজও আমরা করছি।’

এফডিসি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের বাংলা সিনেমার ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে দরকার সময়োপযোগী পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত নবায়ন এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একে চিনবে শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায়, একটি প্রতিষ্ঠানের নাম হিসাবে। তারা জানবে, যার হৃদয়ে ছিল ঢালিউড, অথচ সে নিজেই হারিয়ে গেছে আজ নীরবতার অন্ধকারে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম