উৎসবে সিনেমা মুক্তির ট্রেন্ড ইন্ডাস্ট্রির জন্য দুর্যোগ
রিয়েল তন্ময়
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকাই সিনেমার বর্তমান অবস্থা এমন যে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। সবাই নিজের সিনেমার বিষয়টিই আগে দেখছেন। কেউ ভাবছেন না, ‘সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আমাদের’। সবাই এখন ‘আমাদের’ বিষয়টি বাদ দিয়ে ‘আমার’ নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তাই তো নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখতে গিয়েই ঢাকাই সিনেমা হয়ে গেছে উৎসবকেন্দিক। লগ্নি ফেরতের আশায়, সিনেমা মুক্তিতে উৎসবকেই বেছে নিচ্ছেন নির্মাতা-প্রযোজকরা। তাই বছরের দুই ঈদ ঘিরেই শুরু হয় সবচেয়ে বড় সিনেমা রিলিজ যুদ্ধ। অনেক প্রযোজক এক বছর আগেই ঘোষণা দেন ‘ঈদে আসছি’। একাধিক প্রযোজক, হলমালিক ও পরিচালক জানিয়েছেন, উৎসবের সময় টিকিট বিক্রি ৫-১০ গুণ বেড়ে যায়। হলমালিকদের ভাষায়, ‘ঈদে সিনেমা না চালালে প্রেক্ষাগৃহই বন্ধ রাখতে হয়।’
উৎসবে সিনেমা মুক্তি এখন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। অনেক প্রযোজক-পরিচালক সিনেমার শুটিং শিডিউলই মিলিয়ে নেন ঈদ কেন্দ্র করে। এমনকি সরকারি অনুদানের সিনেমাগুলোও উৎসব রিলিজে ঠাঁই পেতে মরিয়া। এ ছাড়াও প্রযোজকরাও বড় তারকা বেছে নেন উৎসবের সিনেমা দিয়ে। কারণ তারকাদের ফ্যানবেজই তখন হলমুখী দর্শক টানে। শুধু তাই নয়, উৎসবে বড় তারকার সিনেমা ঘিরে যেমন থাকে প্রতিযোগিতা, তেমনই হয় দ্বন্দ্ব। নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে তাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক ঈদে একসঙ্গে যেখানে চার-পাঁচটি সিনেমা পড়লে ব্যবসা ভাগ হয়ে যায়, সেখানে মুক্তি পায় ১০টিরও অধিক। ফলে হল বুকিং নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তাতে ছোট বাজেটের সিনেমাগুলো হল পায় না খুব একটা। এক বা দুই তারকা ঘিরেই এ উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসা সীমাবদ্ধ থাকে।
চলতি বছরের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল ছয় সিনেমা। ঈদুল আজহায়ও মুক্তি পেয়েছে ছয়টি সিনেমা। কিন্তু তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল ১১টি সিনেমা। ঈদুল আজহায় মুক্তি পেয়েছিল পাঁচটি সিনেমা। গত একদশকের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী-২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে ৮টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি, ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে ১টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি, ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৮ সালের ঈদুল ফিতরে ৫টি ও ঈদুল আজহায় ৪টি, ২০১৭ সালের ঈদুল ফিতরে ১টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতরে ৩টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৪ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত এসব সিনেমা আলোচনায় থাকলেও বেশিরভাগের মূলধন উঠে আসেনি। কোনোটির তো বিনিয়োগের ১০ শতাংশও ফেরত পাননি লগ্নিকারী প্রযোজক। প্রেক্ষাগৃহ মালিক, পরিবেশক ও বুকিং এজেন্ট সূত্রে জানা যায়, গত দুই-তিন বছরে ঈদে মুক্তি পেয়েও ‘প্রিয়তমা’, ‘রাজকুমার’, ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’র মতো আর কোনো সিনেমা আহামরি ব্যবসা করতে পারেনি। বাদবাকি বেশিরভাগই মোটাদাগে ব্যর্থ। এত লোকসানের পরও ঈদে সিনেমা মুক্তি দিতে কেন মরিয়া প্রযোজক-পরিচালকরা? কারণ, ঈদেই যা একটু সম্ভাবনার আলো দেখেন তারা। পুঁজি ফেরত না এলেও ঈদে অন্তত দুই সপ্তাহ আলোচনায় থাকা যায়! তাদের ধারণা, বছরের অন্য সময়ে সিনেমা মুক্তি দিলে খুব একটা নজরে আসা সম্ভব হয় না।
তবে উৎসব ছাড়াও সিনেমা মুক্তি দিয়ে যে ব্যবসা করতে পারেনি এটিও কিন্তু নয়। ভালো গল্প ও চিত্রনাট্য, নির্মাণশৈলী, অভিনয় নৈপুণ্য, মনকাড়া গানসহ বিভিন্ন উপকরণের সম্মিলন ঘটলে অন্য সময়ে মুক্তি পেয়েও সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার নজির রয়েছে। গত ১০ বছরে ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়ে ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমার তালিকায় রয়েছে, ‘হাওয়া’ (২০২২), ‘ঢাকা অ্যাটাক’ (২০১৭), ‘আয়নাবাজি’ (২০১৬) ইত্যাদি।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে, ব্যবসায় মন্দার কারণে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৪৬০ থেকে নেমে দাঁড়ায় ৫০টিতে। ঢিমেতালে থাকা আরও ১০০টি প্রেক্ষাগৃহ মুনাফার আশায় কেবল ঈদ উপলক্ষ্যে চালু হয়ে থাকে।
এদিকে শুধু ঈদের সময় এবং সারা বছর প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার কারণ প্রসঙ্গে হলমালিকরা জানিয়েছেন, ভালো কনটেন্টের অভাব। তাদের মতে, শুধু ঈদেই দর্শক টানার মতো কিছু সিনেমা রিলিজ হয়। এ কারণে ঈদের প্রতিই হলমালিকদের আগ্রহ বেশি থাকে। অন্য সময় ভালো সিনেমা আসে না বলে প্রেক্ষাগৃহও বন্ধ রাখতে হয়। এটা ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
