Logo
Logo
×

আনন্দ নগর

সামাজিক মাধ্যমে তারকাদের বিপণন কার্যক্রম

একটা সময় ছিল, যখন অভিনয়শিল্পী বা মডেলদের শুধুই টিভি সেট ও সিনেমার পর্দায় দেখা যেত, বাস্তবে তাদের দেখা মিলত না। পর্দায় অভিনয় দেখেই ভক্তরা তাদের প্রেমে পড়তেন, ভালোবাসতেন। করতেন অনুসরণ-অনুকরণ। অনেকেই স্বপ্নের নায়ক-নায়িকার মতো হতেও চাইতেন। এভাবেই তারকারা হয়ে ওঠেন সবার ‘আদর্শ’ ও ‘আইডল’। সাধারণ মানুষের ন্মদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে অনেক তারকা মরে গিয়েও লাভ করছেন অমরত্ব। বর্তমানে এর চিত্র ভিন্ন। এখন তারকা মানেই হাতের নাগালে। বিস্তারিত এ প্রতিবেদনে।

Icon

রিয়েল তন্ময়

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যুগের পরিক্রমায় তারকাদের জীবনবোধ, চিন্তাধারা ও কাজের ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় তারকাদের দেখা যেত সিনেমার পর্দায়, টিভি নাটকে, বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডে। আজকের তারকা শুধু পর্দার নয়, তিনি ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা। এ যেন ২৪ ঘণ্টার শো, যেখানে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, মডেল- সবাই নিজের গল্প নিজের মতো করে বলার সুযোগ পান। এ উপস্থিতি শুধু ভক্তদের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা নয়, বরং ক্যারিয়ারের কৌশল, ব্র্যান্ডিং, এমনকি বিতর্ক বা রাজনৈতিক অবস্থান জানানোরও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তাই প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে বর্তমান সময়ে তারকাখ্যাতি পাওয়া অভিনয়শিল্পীরা কি আগের তারকাদের মতো সম্মান পাচ্ছেন? কিংবা তারা কি তারকাখ্যাতি সঠিকভাবে অর্জন করতে পারছেন? অর্জন করতে পারলেও কি তা ধরে রাখতে পারছেন?

বর্তমানে দর্শক সিনেমা, নাটক বা গানের খবর প্রথম পান তারকাদের ফেসবুক পোস্ট বা ইনস্টাগ্রাম রিল থেকে। শুটিংয়ের ছবি, ট্রেলার লঞ্চ, ব্যক্তিগত জীবনের অবস্থান-সবই মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় লক্ষাধিক ফলোয়ারের মধ্যে। বাংলাদেশি তারকাদের মধ্যে শাকিব খান,অপু বিশ্বাস, শবনম বুবলী, পরীমনি, মেহজাবীন চৌধুরী, বিদ্যা সিনহা মিম, সাবিলা নূর, তাসনিয়া ফারিণ, জিয়াউল ফারুক অপূর্বসহ অনেক জনপ্রিয় তারকা রয়েছেন যাদের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে লাখ লাখ ফলোয়ার রয়েছে। নিয়মিত তাদের কাজের খবর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খবরও এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষের কাছে। এ যেন তারকাদের বিপণন কার্যক্রমের আরেকটি শাখা! নিজেদের সহজলভ্য করে বড় রকমের একটি রোজগারের জায়গা হিসাবেও প্ল্যাটফর্মগুলোকে বেছে নিচ্ছেন তারকারা। বিভিন্ন স্পন্সরের পোস্ট, ব্র্যান্ড কোলাব, ইউটিউব মনিটাইজেশন, ফ্যান সাবস্ক্রিপশন, প্রোডাক্ট ও ব্র্যান্ড প্রমো-এসব কাজের চিত্রই বেশি লক্ষ করা গেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বদৌলতে একজন তারকার ইনস্টাগ্রাম পোস্ট বা ফেসবুক লাইভ হতে পারে লাখ টাকার বিজ্ঞাপন চুক্তির সমান মূল্যবান। তাই সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন অনেকে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া মানেই শুধুই আলো নয়, অন্ধকারও আছে। নিজেদের স্বার্থে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মনির্ভর তারকাদের নানা ব্যক্তিগত বিষয় চলে আসছে মানুষের কাছে। যা সৃষ্টি করছে বিতর্কের। ব্যক্তিগত ঝগড়া, ভক্তদের নেতিবাচক কমেন্ট, বডি শেমিং, সাইবার বুলিং, ‘ক্যাম্পেইন’ করে কাউকে হেয় করা-এসব বিষয়ে প্রায়শই তারকারা জড়িয়ে পড়ছেন। যা তাদের ইমেজ নষ্টের পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির জন্যও হুমকি। তারকাদের সহজলভ্য হয়ে ওঠা ও অধিক আর্থিক মুনাফার আশায় সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করাকেও অনেকেই ভালোভাবে দেখছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সোশ্যাল মাধ্যমে তারকাদের উপস্থিতিকে কোনোভাবেই খারাপও বলা যাবে না। এসব মাধ্যম ব্যবহারেও বাড়াতে হবে সচেতনতা।

তবে এ প্রসঙ্গে তারকারা বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। সোশ্যাল মাধ্যমে প্রচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোকপাত করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে শাকিব খান বলেন, ‘আমার মনে হয় এখন প্রচারের সবচেয়ে বড় জায়গা সোশ্যাল মাধ্যম। সিনেমা রিলিজের আগে ফেসবুকে বা ইউটিউবে যখন ট্রেলার বা গান পোস্ট করি, সেখানেই লাখো কোটি দর্শক দেখে ফেলে। এটা আগের পোস্টার পত্রিকা বিজ্ঞাপনের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’ অপু বিশ্বাস বলেন, ‘ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আমার দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর সহজ মাধ্যম। কিন্তু আমি সব কিছু প্রমোট করি না। কারণ দর্শক বুঝতে পারে, এটা নিজের কথা নাকি বিজ্ঞাপন।’

‘ডিজিটাল মার্কেটিং খুব জরুরি। এখন নাটকের টিজার, পোস্টার ফেসবুকে ছাড়া হয়। দর্শক তখন থেকেই যুক্ত হয়। তবে কনটেন্টের মান ভালো না হলে কিছু হয় না’-এমনটাই বলেন অভিনেতা আফরান নিশো। আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর ভাষ্যমতে, ‘আমি যেটা করি, নিজের মতো করে করি। স্পন্সর পোস্ট হলেও নিজের ভাষায় বলি। কারণ মানুষ খুব সচেতন, আপনি যদি জোর করে কিছু বিক্রি করতে চান, ওরা বুঝে যায়।’

অনেক নির্মাতার মতে, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া এখন কোনো মার্কেটিং নেই। আর এতে তারকাদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এদেশে এখনো অনেক কাজ এলোমেলো হয়। ডিজিটাল টিম, স্ট্র্যাটেজি লাগে। অন্যদিকে বিপণন এজেন্সিগুলো বলছে, তারকারা ইনফ্লুয়েন্সার হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে অবশ্যই পরিকল্পিত কনটেন্ট হতে হবে। এলোমেলো পোস্ট দিলেই হবে না।

একটা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত ছড়াছড়ি ছিল না, তখন তারকারা ছিল সুশোভিত ও মার্জিত। তারা নিজের কাজের বাইরে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতেন না। এসব শিল্পী ধরেই নিতেন, আমার কাজটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে দর্শক নিজে থেকেই তাকে চিনে নেবেন। দর্শকরাই তাদের বিচারের মাপকাঠিতে তারকা হিসেবে আগলে নেবেন। কিন্তু বর্তমানে ঘটছে তার উলটো। সোনালি দিনের বাংলা সিনেমার তারকাদের জীবন সিনেমার রঙিন পর্দার মতোই ঘটনাবহুল ছিল। সে সময়ের তারকারা শুধু অভিনয়শিল্পী ছিলেন না, বরং তাদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের জীবনযাত্রা, সম্পর্ক বা সিনেমার বাইরের কার্যকলাপ প্রায়শই খবরের শিরোনাম হতো।

বর্তমানে ‘তারকা’ শব্দটির চেয়ে ‘সেলেব্রিটি’ শব্দটি বেশি ব্যবন্মত হচ্ছে। আর এই ‘সেলেব্রিটি’ তকমা অর্জনের লক্ষে নতুন যারা অভিনয়শিল্পী শোবিজে আসছেন, তারা তাদের কাজের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ বিতর্কে জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করছেন। নিজেদের ‘সেলিব্রেটি’ হিসাবে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখতে সব বিষয় তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাই সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে কথাবার্তা বলে বিনোদনের রসদ জোগাচ্ছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম