Logo
Logo
×

বৈশাখ সংখ্যা

‘হালখাতা’ থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’

Icon

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একদা দোকানি-বেপারির হালখাতা আর গৃহস্থের ঘরে রান্নাঘরের দুটি ভালোমন্দের আয়োজনের মাঝে সীমাবদ্ধ পহেলা বৈশাখ আজ ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে রঙে-রসে বিচিত্ররূপে। শিল্পী ইশতিয়াকের সুরে ধ্বনিত হয়েছে সে সুর : ‘আইলো আইলো আইলো রে/ রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে..’। বাংলা নববর্ষের বর্ণিল উদযাপনের প্রাক্কালে পুরান ঢাকার ‘হালখাতা’ নতুন কলেবরে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছে তা তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছি আলোচ্য নিবন্ধে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে নতুন নতুন সাময়িকপত্র প্রকাশের সংস্কৃতি ছিল সেকালে। ১৩১২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ঢাকা থেকে ‘ভারত মহিলা’ প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকাটি তৎকালীন শিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সেখানে আলোচনা হতো। এবার আসা যাক দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মেলন’-এর কথায়। একই মলাটে বাঁধাই করে এ পত্রিকার প্রথম অংশটি ইংরেজিতে এবং দ্বিতীয় অংশটি বাংলায় প্রকাশিত হতো। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩১৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। নারায়ণগঞ্জ থেকে মাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘সবুজ বাংলা’ প্রকাশিত হতো। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। ড. খাস্তগীর, ড. ভট্টশালী, প্রফেসর ওয়াদুদ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ পত্রিকায় লিখতেন। বৈশাখকে ঘিরে শিশুসাহিত্য প্রকাশের প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। ‘শিশু-সাথী’ নামক একটি পত্রিকা ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত হয়। পড়ুয়াদের ব্যস্ত রাখার নানাবিধ রসদের জোগান হতো এ বৈশাখেই।

সেকালের সাহিত্য-সাময়িকী ও ইতিহাস পর্যবেক্ষণে বাংলা নববর্ষের দেখা পাওয়া ভার। অনুপম হায়াৎ-এর লেখা ‘নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থ পর্যালোচনায় দেখা যায়-১৯২০ সালের ১৩ এপ্রিল এর দিনপঞ্জীতে লেখা, ‘খাজা শামসুল হক লিখেছেন আজ এবং আগামীকাল বাংলা পুরোনো বছরের শেষ ও নতুন বছরের শুরু (নববর্ষ) উপলক্ষ্যে পোস্ট অফিস বন্ধ থাকে’। বাসন্তী গুহঠাকুরতা’র ‘কালের ভেলায়’ গ্রন্থ হতে সেকালের বৈশাখ সম্পর্কে যৎসামান্য জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘মা পহেলা বৈশাখে নতুন কাপড় নিজের লুকিয়ে জমানো টাকা থেকে আমাদের কিনে দিতেন’। কবি ও কলামিস্ট ডা. দিলীপ দে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, পহেলা বৈশাখে দূরের আত্মীয়স্বজনকে অন্তত একটি পোস্টকার্ড লেখা ছিল হিন্দুবাড়ির রেওয়াজ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের তোড়জোড় শুরু হয় মূলত ১৯৫১ সালে। ২২ এপ্রিল ১৯৫১ যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সরলানন্দ সেনের কলাম ‘ঢাকার চিঠি’। সেখানে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসকে ছুটি ঘোষণার তাগাদা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৩ এপ্রিল ১৯৫৪, আজাদ পত্রিকায় তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের বরাতে ‘১লা বৈশাখ ও ১লা মহররম’ সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল ‘সংবাদ’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘আজ পহেলা বৈশাখ ঃ আজ শুভ হালখাতা’। সংবাদটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকাল ৫টায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত সুসজ্জিত প্রভাতফেরি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। সকাল ৬টায় রমনা পার্কের রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে ছায়ানট সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিকাল ৫টায় কবিতা পাঠের আসর ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়। রাত ৯টায় প্রেস ক্লাবে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর আগে পহেলা বৈশাখ কখনো এত ঘটা করে উদ্যাপিত হয়নি। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলা বর্ষের গণনা সংস্কার সরকারিভাবে গৃহীত হয় এবং যার পর থেকে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয় ১৪ এপ্রিল।

প্রাচীনকালে ভারতে অগ্রহায়ণ মাসকেই বলা হতো বর্ষারম্ভ। ‘অগ্র’ অর্থাৎ প্রথম, ‘হায়ণ’ অর্থাৎ বছর। অগ্রহায়ণকে মনে করা হতো বছরের প্রথম মাস। কিন্তু কালক্রমে এ দেশের দরিদ্র, ঋণ জর্জরিত কৃষক সমাজ মহাজনের দেনাপাওনা মেটাতে শুরু করল বৈশাখ মাসে। আর সে সুবাদে বৈশাখ মাস সবলে কেড়ে নিল অগ্রহায়ণের নববর্ষ-গৌরবের দাবি। নববর্ষের সিংহাসনে হলো বৈশাখের সাড়ম্বর প্রতিষ্ঠা। কৃষকদের ঋণ পরিশোধের চালচলন দেখে মহাজনেরাও এ মাসটিকে ধরে নিলেন বর্ষারম্ভ-তথা দেনাপাওনার লাভজনক ‘হালখাতা’। ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা লাল খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এ উপলক্ষ্যে ছাপানো হতো আমন্ত্রণপত্র, চলত নানা আয়োজন। যার যার সাধ্যমতো কার্ড ছাপানো হতো। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কার্ডের ওপর লিখতেন ‘এলাহী ভরসা’ আর হিন্দুরা লিখতেন ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ’। সেকালের বেতারেও প্রচারিত হতো হালখাতার কথা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর পাক্ষিক মুখপত্র ‘বেতার জগৎ’ শীর্ষক সাময়িকীর ১ এপ্রিল ১৯৩৯ সংখ্যার অনুষ্ঠানপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ‘হালখাতা’ নাটিকার কথা। সেখানে আরও লেখা রয়েছে, “আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বাঙ্গালার সর্ব্বত্র হালখাতা হচ্চে। আমাদের গ্রাম্য শিল্পীরাও তাদের নিজের ধরনে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান করবে”। হালখাতার পাশাপাশি জমিদারদের খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসাবে ‘পুণ্যাহ’ পালন করা হতো সেকালে। ১৮৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় ‘পুণ্যাহ’ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ‘১লা বৈশাখ পুণ্যাহ উপলক্ষ্যে বাবু কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর ঢাকাস্থ বাটীতে খুব সমারোহে নাচ ভোজাদি হইয়াছে’। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় বিলুপ্ত হয়েছে ‘পুণ্যাহ’। আর চাকরিজীবী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয়ের হিসাব কষেন বিধায় ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়েছে হালখাতার জৌলুস।

ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান, ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখশের কাছে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “পহেলা বৈশাখ তার বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে অনেকখানি। এক সময় এটা ছিল মূলত মুসলমান ব্যবসায়ীদের উৎসব এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। উভয় ধর্মের ব্যবসায়ীরাই হালখাতা অনুষ্ঠান করত। ব্যবসায়ীরা ছোট বাচ্চাদের ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়াত। পাটুয়াটুলীর কালাচাঁদ গন্ধবণিক ও সীতারাম ভান্ডার, নবাবপুরের মরণ চাঁদ, চকবাজারের আলাউদ্দিন সুইটমিট ও ফরাশগঞ্জের মিষ্টির দোকানগুলো নববর্ষের দু-তিন দিন আগে থেকেই রমরমা থাকত। নওয়াবপুরের রথখোলা মোড়ে ৩০ চৈত্র মেলা হতো। আর পহেলা বৈশাখের দিন লোহারপুলে মেলা হতো। এটাকে চিলপূজার মেলা বলত। চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘শিব গৌড়ীর নাচ’ দেখার সুযোগ হতো। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হতো। পুরুষরাই শিব ও গৌড়ী সাজত আর ঢাকের তালে তালে নাচত”। কালের পরিক্রমায় জীবন বীণার সে সুর থেমে গেছে, মেলার সে জীবনী শক্তিও ফুরিয়েছে।

১৯৮৮ সালের পাক্ষিক (১৬-৩০ এপ্রিল) ‘সুকন্যা’য়-‘এপারে হালখাতা, ওপারে উৎসব’ শীর্ষক রচনায় এপার-ওপার দুই বাংলায় নববর্ষ কেমনভাবে উদযাপিত হয়, তারই মনোগ্রাহী আলোচনা করেছেন মিহির কর্মকার। তিনি লিখেছেন, “ধর্মবিশ্বাসে বিভক্ত বাঙালি জাতির আবাহন পদ্ধতিতেও সংগত বিভাজন লক্ষণীয়। হিন্দু বাঙালির বিশ্বাসে বাংলা নববর্ষ শুধু বর্ষশুরুর প্রথম দিন মাত্র নয়। অন্য আর দশটি মাঙ্গলিক পার্বণের মতো নববর্ষও ঈশ্বরের শ্রীচরণে নিবেদিত একটি শাস্ত্রসম্মত মহাতিথি। সব রকম শুভ উদ্যোগ ও নবযাত্রার মহালগ্ন হলো ‘পহেলা’ বৈশাখ। এদিন মন্দিরে মন্দিরে পূজো-আর্চার সঙ্গে সঙ্গে গৃহদেবতা কূলদেবতাকেও জানানো হয় বিশেষ প্রণতি। ...আমাদের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ আসে শাস্ত্রের হাত ধরে, ধর্মীয় অনুভূতিকে ভর করে। অন্যদিকে সার্বভৌম বাংলাদেশে আজকের প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উৎসব যথার্থই সামাজিক এবং চরিত্রের দিক থেকে পুরোপুরি ধর্ম নিরপেক্ষ।”

পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ‘নববর্ষ’ ধীরে ধীরে তার নিরপেক্ষতা হারায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে শুরু হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরবর্তী সময়ে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হকের নাম দেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এর মাধ্যমে নির্দোষ বৈশাখকে মুসলিম ধর্মের মুখোমুখি করার প্রয়াস চালানো হয়। উল্লেখ্য, সেকালের জন্মাষ্টমীর মিছিলে থাকত নানা রকমের সঙ, সঙ্গে সাময়িক ঘটনা সম্পর্কিত নানাবিধ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ। এ দৃশ্যপট ও ধারণাকে কাজে লাগানো হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। সঙের জায়গায় স্থান পায় বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তির সঙ্গে পেঁচার মূর্তি। সংস্কৃতিবান জাতি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরার অভূতপূর্ব প্রয়াসের এখানেই শেষ নয়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর অধরা (intangible) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।

সংস্কৃতিবান হওয়ার এ অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে গবেষক সোহেল মজুমদার, ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল তার মুখ পুস্তিকার টাইমলাইনে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-“তারা বাঙ্গালিত্বের লগে মুসলমানিত্বের বিরোধ ঘটাইতে উইঠ্ঠা-পইড়া লাগে। তাগো দালালির হাম্বা রবে বাঙ্গালিত্ব থাকলে মুসলমানিত্ব থাকে না, আবার মুসলমানিত্ব থাকলে বাঙ্গালিত্ব থাকে না! অর্থাৎ কল্পিত ম্যাথমেটিক্যাল মডেল ডিজাইন কইরা তারা দেখাইতে চায় যে, বাঙ্গালিত্ব ও মুসলমানিত্ব পরস্পর পরস্পরের বিপ্রতীপ। এর মাধ্যমে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখায়! নির্দোষ বৈশাখের মইধ্যে কালে কালে তাই তারা ‘মঙ্গল’ ঢুকায়, হেইডারে নিয়া আবার প্রজ্ঞাপনও বানায়। সময় সময় পারলে মুসলমানের পোলারে দিয়া সরস্বতীর পূজাও করায়! তারা আসলে বুঝবার পারে না যে, জিদের ভাত শেষমেষ কুত্তায় খায়। তারা সংস্কৃতি বোঝে, তয় সংস্কৃতির পাঠ বোঝে না। ভাস্কর্য বোঝে, তয় মানুষ বোঝে না। তারা ভুইলা যায় যে, সংস্কৃতির জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সংস্কৃতি।”

সোহেল মজুমদারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যে শুধু আবেগের বশবর্তী ছিল না, অন্যায্য ছিল না-তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম : ‘ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া’। খবরের বর্ণনায় রয়েছে, ‘কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনো মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পুজো মণ্ডপ। কখনো বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের চেহারা। তা সে রমনার বটমূলের বৃন্দগানই হোক কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাজপথে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুজো, বসন্ত উৎসবের মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।’ শিক্ষক ও সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসান আনন্দবাজার পত্রিকার এ নিবন্ধের প্রত্যুত্তরে ১১ এপ্রিল ২০২৫ একটি মনোমুগ্ধকর নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এর শিরোনাম-‘অষ্টমীর একডালিয়া নয়; সব বিশ্বাসের জীবন উৎসব’। যেখানে তিনি লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গের যে ছেলেমেয়েরা কট্টর হিন্দুত্ববাদী বংকিমচন্দ্র পড়ে বড় হলো; শরতচন্দ্র পড়ে জানল মুসলমান হলে আর বাঙালি হওয়া যায় না; তারা মুসলমান আত্মপরিচয় নিয়ে কুঞ্চিত হলো।...২০০৯ সালে ভারতের রাজনীতিক প্রণব মুখার্জির হস্তক্ষেপে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দেওয়ানি লাভ করলে ক্রমেই মঙ্গল শোভাযাত্রা আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষায় ‘অষ্টমীর এক ডালিয়া’-তে রূপান্তর হয়। চারুকলার মতো সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান হিন্দুত্ববাদী আওয়ামী লীগের মঙ্গলসাধনকলায় পরিণত হয়”।

বাঙালি ‘বৈচিত্র্যবিলাসী, নতুনত্ব পিয়াসী’ আবার ‘ঐতিহ্যপ্রেমী’ও। উৎসব নিয়ে বাঙালির সমকালীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আশাপূর্ণা দেবীর ‘ঢেউ গুনছি সাগরের’ গ্রন্থে। তার ভাষায়, “বাঙালি ঝালেও থাকে, অম্বলেও থাকে। বাঙালির হৃদয় মন্দিরে সব দেশের সব জাতির সব ঐতিহ্যের প্রতীক পতাকাগুলো পতপত করে উড়তে থাকে। সময়কালে সেই পতাকার দড়ি টেনে তার নিচে সমবেত হয়। তাই তার নানাবিধ উৎসব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কবিগুরুর উদাত্ত মন্ত্রে ধ্বনিত, ‘নব বৎসরে করিলাম পণ লব স্বদেশের দীক্ষা’, এ নিয়ে এখন আর কে ভাবে? বছরের প্রথম দিনটিতে একটু ভালোমন্দ খেলে, একটু নতুন বস্ত্র পরিধান করলে সারা বছরটি ভালো কাটে-বাঙালি সমাজে এ সংস্কারটুকু ছিল দূর্বাঘাসের মতো। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহীরুহের তুল্য। শাখা-প্রশাখার কী বিস্তার। আসলে আমরা এখন সব বিষয়েই বাড়তির পথে। জামা-কাপড়ের বাজারের বাড়বাড়ন্ত! আমাদের ঐশ্বর্য বাড়ছে, আরাম বিলাসিতার উপকরণ বাড়ছে, লোভ বাড়ছে, দুর্নীতি বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাংস্কৃতিক উৎসব। এই কাল, এই যুগ আমাদের সব কিছুকে বাড়তির পথে ঠেলে দিলেও দিনে দিনে তলে তলে নিঃশব্দে লোপাট করে নিচ্ছে একটি জিনিস। সে হচ্ছে ‘হৃদয়’। সেখানে ক্রমেই ঘাটতি, কমতি, খামতি।” এবার নববর্ষে তাই প্রার্থনা হোক, আমরা যেন আমাদের হারানো হৃদয়টিকে আবার ফিরে পাই। আমরা যেন নিঃস্ব হতে হতে দেউলে হয়ে না যাই।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম