Logo
Logo
×

বৈশাখ সংখ্যা

বাংলা নববর্ষ : আর্তব থেকে কৃষ্যুৎসব

Icon

আহমেদ বাসার

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর সব দেশের সংস্কৃতিতেই নববর্ষ বা নতুন বছর নব উদ্দীপনায় জেগে ওঠার চেতনায় উজ্জীবিত। বিগত বছরের ব্যর্থতা, গ্লানি, হতাশা ও অপ্রাপ্তির বেদনা মুছে ফেলে নতুন করে শুরু করার প্রেরণা জোগায় নববর্ষ। ইংরেজ কবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায় ring out the old, ring in the new/ring, happy bells, across the snow. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/ অশ্র-বাষ্প সুদূরে মিলাক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন বছরের বিচিত্র নামও লক্ষযোগ্য। তিব্বতে নববর্ষকে বলা হয় ‘লোগসর’, থাইল্যান্ডে ‘ত্রাত’, ভিয়েতনামে ‘তেত’, ইরানে ‘নওরোজ’ প্রভৃতি। তবে সব সংস্কৃতিতেই উদযাপনের ভিন্নতা থাকলেও চেতনাগত দিক থেকে মৌলিক ঐক্য চোখে পড়ে। খ্রিষ্টপূর্ব দুহাজার বছর আগেও মেসোপটেমিয়ার জনগণ নববর্ষের উৎসবকে জীবনের একপর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণ বলে মনে করতেন। এ দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরও বিশ্বাস প্রায় সমধর্মী। অর্থাৎ নববর্ষ নব জীবনেরই বার্তামুখর।

বর্তমানে ‘বাংলা নববর্ষ’ ও ‘পহেলা বৈশাখ’ প্রায় সমার্থক শব্দগুচ্ছ রূপে ব্যবহৃত হলেও এ দুটির সমার্থকতা লাভ করতে প্রয়োজন হয়েছিল সহস্র বছরের পথপরিক্রমা। আদিম জনগোষ্ঠী ‘আর্তব (Seasonal festival) উৎসব হিসাবে নববর্ষ উদযাপন করত। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখকে বলা হয় সভ্য মানুষের কৃষ্যুৎসব (Agricultural festival)। তবে তা অবশ্যম্ভাবী রূপে নববর্ষের ঐতিহ্যেরই স্বর্ণশস্য।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এ অঞ্চল ‘সুবে-বাংলা’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। সুবে বাংলায় বাংলা সন প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫)। মূলত আকবরের নির্দেশে তার নবরত্ন সভার বিখ্যাত রাজ-জ্যোতিষী ও গণিতবিদ আমির ফতে উল্লাহ সিরাজির অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার ফসল বাংলা সন। তৎকালে মুঘলরা হিজরি সন অনুসারে শাসনব্যসস্থা পরিচালনা করতেন। অন্যদিকে সুবে-বাংলায় কৃষিকাজ ও খাজনা আদায় ছিল সৌরবর্ষকেন্দ্রিক। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সম্রাট আকবরের আগে ভারতবর্ষে সৌর বছর কার্যকর থাকলেও সৌরমাসের অস্তিত্ব ছিল না। ‘আকবরনামা’য় দেখা যায়-where as in the almanac current in india, the years were solar and months luner, we ordered that the months of the era should be solar.(Akbarnama, tr. By Beveridge- Abul Fazal). ফলে এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি নতুন সন প্রবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। এ তাগিদ থেকে সম্রাট আকবর আমির ফতে উল্লাহ সিরাজিকে নতুন সন প্রণয়নের তাগিদ দেন। সিরাজি মূলত হিজরি সনকে আদর্শ ধরে কাজ শুরু করেন। হিজরি চান্দ্রমাসকে তিনি সৌরবর্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন ফসলি অব্দের সূচনা করেন। এক্ষেত্রে ৯৬৩ হিজরির মহররম মাস থেকে বাংলা সনের ৯৬৩ অব্দের সূচনা হয়। ভারতের প্রচলিত শকাব্দের চৈত্র মাস বাদ দিয়ে বৈশাখ মাসকে বঙ্গাব্দের প্রথম মাস হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হিজরি মহররম মাসের সঙ্গে বৈশাখের মিলের দিকটি এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। শুরুর দিকে বাংলা মাসের ৩০ দিনের ৩০টি নাম ছিল, যা মনে রাখা খুব দুরূহ। সম্রাট শাহজাহান পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিটি মাসকে ৪ ভাগে ভাগ করে সপ্তাহের ধারণায় উপনীত হন। ৭ দিনে সপ্তাহ আবর্তিত। গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিতে সপ্তাহের সাত দিনের নাম রবি, সোম, মঙ্গল প্রভৃতি নির্ধারণ করা হয়। এমনকি বাংলা মাসের নামও শুরুর দিকে ছিল ভিন্ন। যেমন-ফারওয়ারদিন, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, আজার প্রভৃতি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন তারকা ও গ্রহের নাম অনুযায়ী বাংলা মাসের নাম নির্ধারিত হয়। যেমন-বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ. অষধা নক্ষত্র থেকে আষাঢ়, শ্রবণা নক্ষত্র থেকে শ্রাবণ প্রভৃতি নাম ঠিক করা হয়।

বাংলা সনের বর্তমান কাঠামোটি নির্মিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর হাত ধরে। বাংলা সনকে খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে মিল করে যুগোপযোগী করা ও লিপইয়ারের সমস্যা দূর করার তাগিদ থেকে ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। বঙ্গাব্দের এ সংস্কার বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।

বাঙালির সর্বজনীন উৎসব

বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ম্যানচিপ হোয়াইট-এর মতে, পৃথিবীতে বিশুদ্ধ কোনো রক্তধারা নেই। এমনকি বিশুদ্ধ কোনো বংশও নেই। এদিক থেকে বাঙালি নিঃসন্দেহে শংকর জাতি। বাংলাদেশে এক সময় নর্ডিক ও ভেড্ডিড জনগোষ্ঠীর ব্যাপক হারে বসতি ছিল। আজকের বাঙালির চাষাবাদ ও ধাননির্ভরতা মূলত ভেড্ডিড নরগোষ্ঠীর আবিষ্কার। বাঙালি সংস্কৃতি যে ভেড্ডিড সম্প্রদায়ের সম্প্রসারিত ও পরিমার্জিত রূপ এ কথা সঙ্গতভাবে বলা যায়। বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের পর এ অঞ্চলে ইসলামি সংস্কৃতির সূচনা ঘটে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতিও সমান্তরালভাবে বিদ্যমান। এ তিন সংস্কৃতির সম্মিলিত স্রোতে জন্ম নেয় বাঙালি সংস্কৃতি। সম্প্রদায়গতভাবে সবাই ভিন্ন ভিন্ন উৎসব উদযাপন করলেও পহেলা বৈশাখই হয়ে উঠেছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব।

বর্ণাঢ্য বৈশাখী আচার-অনুষ্ঠান

বাংলা নববর্ষ বর্ণাঢ্য আয়োজন ও অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। এক্ষেত্রে বৈশাখী মেলা, হালখাতা, পুণ্যাহ, বৈসাবি প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ‘হালখাতা’ মূলত ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। মিষ্টিযোগে পুরোনো বছরের হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। এখনো গ্রামে-গঞ্জে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। ‘পুণ্যাহ’ মূলত জমিদারদের খাজনা আদায়ের একটা প্রীতিপূর্ণ অনুষ্ঠান। প্রজারা এ অনুষ্ঠানে এসে মিষ্টিমুখ করে সাধ্যমতো বকেয়া পরিশোধ করে যেত। এ উপলক্ষ্যে রাতে গান-বাজনারও ব্যবস্থা থাকত। মধ্যযুগে চীন, জাপান, স্পেন প্রভৃতি দেশে এ ধরনের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।

বৈশাখী মেলা বাংলা নববর্ষের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। দেশের বিভিন্ন জেলায় মহাসমারোহে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালে তৎকালীন জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক সিএ বেন্টলি ‘ফেয়ার অ্যান্ড ফেস্টিবল অব বেঙ্গল’ বইয়ে সমগ্র বাংলায় সাড়ে সাত হাজার মেলার বর্ণনা দিয়েছিলেন। বৈশাখী মেলা সাধারণত এক দিন, তিন দিন অথবা সাত দিনব্যাপীও আয়োজিত হতে দেখা যায়। এক দিনের মেলা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বান্নি’ নামে পরিচিত। বৈশাখী মেলায় লোকশিল্পের ব্যাপক সমাহার লক্ষযোগ্য। মাটির তৈরি নানা ধরনের শিল্পকর্ম, নকশি পাটি, সুতো-বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র, নানা ধরনের পটচিত্র, লোক-বাদ্যযন্ত্র, বিচিত্র খাদ্যসামগ্রী, যেমন-উড়কি-মুড়কি, বিন্নিধানের খই, ফুটকলাই, কদমা, বাতাসা, মুরালি, নাড়ু প্রভৃতি। মেলায় ছোট্ট ছেলেমেয়েদের অন্যতম আকর্ষণের বিষয় ছিল বায়স্কোপ। পুতুল নাচ, নাগরদোলা, লাঠিখেলা, জারিগান প্রভৃতি আয়োজন বৈশাখী মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বৈশাখী মেলা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ঠাকুরগাঁ জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের মেলা ও চট্টগ্রামের মহামুনির বৌদ্ধপূর্ণিমা মেলা।

নববর্ষের একটি প্রাচীন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ‘আমানি’। এটি মূলত কৃষক পরিবারের অনুষ্ঠান। চৈত্রের শেষদিন সন্ধ্যা রাতে গৃহিণীরা এক হাঁড়ি পানিতে অল্প পরিমাণ অপক্ব চাল ছেড়ে দিয়ে সারা রাত ভেজাত এবং এর মধ্যে কচি আমের পাতাযুক্ত একটা ডালও রাখা হতো। পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের আগেই ঘর ঝাড়ু দিয়ে গৃহকর্ত্রীরা সেই হাঁড়ির পানি সারা ঘরে ছিঁটিয়ে দেয় এবং ভেজা চালগুলো পরিবারের সবাইকে খেতে দেওয়া হয়। আমের কচি ডালের পাতা সেই পানিতে ভিজিয়ে সবার গায়ে ছিঁটিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে পরিবারের কল্যাণ ও সুখ-শান্তি আসবে বলে বিশ্বাস করা হতো। এ অনুষ্ঠানটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। স্পেনেও একই ধরনের আচার প্রচলিত ছিল। নববর্ষের সূচনায় রাত বারোটার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে কেউ যদি একটি করে আঙুর খায় তবে নববর্ষ সৌভাগ্য বয়ে আনবে বলে তারা মনে করত। জাপানে নববর্ষে দরজার মুখে গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া ও উজ্জ্বল রঙের ফল ঝুলিয়ে রাখা হতো সুখ-শান্তির প্রত্যাশায়। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে নববর্ষে ধানের শিস ঝুলিয়ে রাখা হয়। চীন, জাপান ও মিয়ানমারে গাছ ও ঘরের চূড়ায় প্রদীপ জ্বালানো হয় ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার নিমিত্তে।

বৈশাখী আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানমালা। বৈসাবি, বিউ পরব প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি প্রধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-ত্রিপুরাদের বৈসুব, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু উৎসবকে সংক্ষেপে বৈসাবি নামে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া পহেলা বৈশাখে বন-বাদাড় থেকে বিভিন্ন জাতের বিউফুল কুড়িয়ে এনে বিউ পরব আয়োজন করা হয়। এটাকে সৌাভাগ্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বৈশাখের আরও বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসবের কথা উল্লেখ করা যায়। উত্তরবঙ্গের গম্ভীরা, ঘোড়দৌড়, মোরগ লড়াই, ষাড়ের লড়াই, পুতুল নাচ প্রভৃতি। চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের আবদুল আজিজের বলীখেলার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়।

বাংলা কাব্য ও খনার বচনে বৈশাখ

মহীয়সী খনা মূলত কৃষি, জলবায়ু ও আবহাওয়াকেন্দ্রিক বচন রচনা করেছেন। বৈশাখ তার বচনে সদর্পে স্থান করে নিয়েছে। তার বৈশাথকেন্দ্রিক কিছু বচন নিচে উল্লেখ করা হলো-

১.বৈশাখের প্রথম জলে

আশুধান দ্বিগুণ ফলে।

অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিকে মুষলধারে বৃষ্টি হলে আউশ ধান দ্বিগুণ ফলে।

২. মাঘে মুখী

ফাল্গুনে চুখী

চৈত্রে লতা

বৈশাখে পাতা

অর্থাৎ মাঘ মাসে মুখী কচুর ফলন ভালো হয়। ফাগুনে চোখা হয়, চৈত্রে লতা বেশি হয় আর বৈশাখে হয় পাতা।

বৈশাখ বাঙালি কবিদের প্রিয় ঋতু না হলেও বাংলা কাব্যে বৈশাখ বন্দনা নিতান্ত কম নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবির কবিতায় বৈশাখ নান্দনিক ও দার্শনিক ভাবনার আকররূপে ধরা দিয়েছে। নজরুলের কবিতায় বৈশাখ ধ্বংসের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে-‘আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর’। কিংবা ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবি যখন বলেন-‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখের ঝড়’ তখন নতুনের জয়ধ্বনির সঙ্গে কালবৈশাখীর প্রমত্ত ও প্রবল রূপের সমন্বয় ঘটে দারুণভাবে।

জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতায় গ্রাম-বাংলার জীবনচিত্র তুলে ধরে অমর হয়ে আছেন। ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ কাব্যে বৈশাখের দাবদাহ ও শুষ্ক রূপ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে-

চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে

এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে।

ফররুখ আহমদ বৈশাখকে ধ্বংস ও সৃজনের দ্বৈত রূপেই ধারণ করেছেন-ধ্বংসের নকীব তুমি হে বৈশাখ, এস ফিরে, এস তুমি অপূর্ব সুন্দর / বৎসরের সূচনায় পিঙ্গল আকাশে দেখি অগ্নিবর্ণ তোমার স্বাক্ষর।

আল মাহমুদ ‘বোশেখ’ কবিতায় বিভেদ সৃষ্টিকারী পরগাছা, অবিবেচক ও অমানবিক ধনকুবেরদের গুঁড়িয়ে দিতে কালবৈশাখীকে আহ্বান জানিয়েছেন-ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান / ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের / পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান / বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেল। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘পয়লা বৈশাখ’ কবিতায় বৈশাখের ঐতিহ্যিক আবহ ও বৈশাখী মেলার চিত্র দৃশ্যমান-

থরে থরে বিন্নি মন্ডা ডুগডুগি আহলাদি পুতলি

পতঙ্গ-ডাহুক-ঘুড্ডি-বাঁশি কাগজের বুলবুলি-

লাগাও হে চর্কিদোলা ক্রীড়াচ্ছলে হবই সম্রাট

মাটির হাতিতে চড়ে বুঝে নিতে চাই রাজ্যপাট।

বন্দে আলী মিয়া কবিতায় বৈশাখের ভূ-প্রকৃতির চিত্র তুলে ধরেছেন-বিহানের খরা আসিয়া পড়িছে ধূসর মাঠের পরে / চষা জমিনের চাপ চাপ মাটি চিক চিক করে।

কবি আবদুল হাই শিকদার কবিতায় বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব চিত্রিত করেছেন চমৎকারভাবে-

খামোখাই গাছদের ধরে ধরে আছড়ায়

যেন রাগী খুব পাজি ধোপারে

বাহাদুরি দেখাবার জন্য সব বাড়িঘর

কান ধরে পাঠাচ্ছে ওপারে।

‘বাংলা নববর্ষ’ বাঙালির অনিঃশেষ শক্তি ও সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার। পহেলা বৈশাখ শুধু নতুন বছরের সূচনাই নয়, বরং নতুন জীবনের প্রেরণায় বলীয়ান। সাংস্কৃতিক উদারতার পাশাপাশি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ মুছে দিয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ চেতনার মঞ্জিলে পৌঁছে দিতে পারে বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন মানবীয় মন্ত্রধ্বনি। তাই বৈশাখ হোক আমাদের ঐক্যের নিশান, নববর্ষ হোক আমাদের বিশ্বভ্রাতৃত্বের সোপান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম