পহেলা বৈশাখ বিশেষ সংখ্যা
বাংলার বিকাশ ও বাঙালির নববর্ষ

মজিদ মাহমুদ
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কোনো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের পথ ধরে আমরা কিছুটা পেছনে যেতে পারলেও তার আদি উৎসের অধিকাংশ অনির্ণিত সুড়ঙ্গ অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। তখন কল্পনার আলো ফেলে কিছুটা দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে না এর দিনক্ষণ জন্ম মূহূর্ত। তবু আমাদের জানতে ইচ্ছা করে কীভাবে অর্জিত হয়েছিল এসব উত্তরাধিকার। এসব ঘরে ফেরার উপাদান যতই হীন ও তুচ্ছ হোক না কেন, যা থেকে আমরা নিজেদের ব্যবচ্ছেদ করতে পারি না। যদিও অধিকাংশ উৎসব সাধারণ মানুষের একটি করুণ বিসর্জনের অকথিত অধ্যায় হয়ে ক্ষমতা-বলয়ের মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করে। তবু এসব পূর্বপুরুষদের সঙ্গে আমাদের মিলনের সেতুবন্ধ রচনা করে দেয়। মানবের সংঘবদ্ধ অবিরত ক্লান্তিকর যাত্রা সামনের দিকে এগিয়ে চলার সময় নতুন করে শ্বাস নেওয়ার ফুরসত করে দেয়। যে কোনো উৎসবের জন্য এ ধরনের ধারণা যুতসই হলেও জাতিসত্তার মৌল উপাদানগুলোও বিতর্কের বাইরে নয়।
তবে ভাষা জাতিসত্তার অবিভাজ্য উপাদান এবং সংস্কৃতির একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রধান নিয়ামক এ সত্য অস্বীকার করা যায় না। এমনকি ভাষার বাইরে যে উপাদানগুলো সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে সেগুলোও ভাষার দ্বারা ব্যাখ্যাত। ভাষা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক চেতনা পরিবহণের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়। কিন্তু ভাষা সব সময় একটি নির্দিষ্ট সার্বভৌম ভূখণ্ডের দ্বারা সীমায়িত নয়। এ গ্রহে খুব কম সংখ্যক দেশই আছে, যার দেশ ও ভাষা একই নাম দ্বারা চিহ্নিত। সেই কম সংখ্যক দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। যা একইসঙ্গে ভাষা ও ভূখণ্ড বাচক। আমরা জানি প্রাচীনকাল থেকেই এ জনপদে একটি ভূখণ্ড ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। এখানে নির্দ্বিধায় একটি প্রশ্ন করা সম্ভব, তাহলো সেই ‘বঙ্গ’ কি আজকের বাংলার সমার্থক? আর সমার্থক হলে সেটি ভাষা-বাচক নাকি দেশ (ভূখণ্ড) বাচক?
এ প্রশ্নের মীমাংসার প্রাক্কালে আমরা একটি ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আজ থেকে প্রায় আটশ বছর আগে এক তুর্কি যোদ্ধা ও সেনাপতি এ ভূখণ্ডের নদীয়াহ নামক স্থান জয় করেছিলেন। তখন নদীয়াহ ছিল আজকের বাংলাদেশের একটি অংশের রাজধানী। আর এ রাজধানী অলংকৃত করেছিলেন রায় লক্ষ্মণ সেন। তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন দক্ষিণের কর্ণাটক থেকে। লক্ষ্মণ সেনের পূর্বপুরুষ আর তুর্কি সেনাপতি মোহাম্মদ বখতিয়ার উভয়ই এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে দ্রুতগতিতে। এ ভূখণ্ডের আদিবাসীদের ঘোড়া ছিল না। গতির মাহাত্ম্য তারা জানতেন না। আদি ‘বঙ্গে’র একটি আনুমানিক অর্থ জলাশয়। সোমবছর পানিতে ডুবে থাকতো। পানি-কাদায় মাখামাখি এ জনপদের জীবন। কাউকে তারা আক্রমণ করতে গেছেন কদাচিৎ। বহিরাগত দখলদারত্ব আর রাজনৈতিক কারণে এ জনপদের মানুষকে বারবার পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। ঐতিহাসিক বর্ণনা সত্য হলে মাত্র সতেরো জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে মোহাম্মদ বখতিয়ার একটি রাজবংশের পতনের পথ সুগম করেছিলেন। এত অল্পসংখ্যক সৈন্যের রাজধানী বিজয়কে বঙ্কিম একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখেছিলেন। সে আশঙ্কা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কেননা, এ আশঙ্কা প্রমাণ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সেন শাসনের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না, তারা লক্ষণ সেনের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, যেমন খলিফা ওমরের সময় চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনের ইহুদিরা রোমন দুঃশাসন থেকে মুক্তি।
অবশ্য তখন পরাক্রান্ত রাজার জীবনও জড়িত ছিল অদৃষ্টের কুষ্ঠি-গণনায়। রাজজ্যোতিষীদের কুষ্ঠি গণনায় আগেই সূচিত হয়েছিল আজানুলম্বিত খর্বকায় তুর্কি সেনাপতির হাতে সেন রাজবংশের পতন। এর সঙ্গে পশুপতিরায়ের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাহিনি সত্য হলেও রাজজ্যোতিষীদের অন্য একটি গণনা উল্লেখ করতে চাই। লক্ষ্মণ সেন ছিলেন পস্টিউমাস-পিতার মৃত্যুর পর জন্মানো সন্তান। বিজয় সেন পরলোকে যাওয়ার পর রাজমাতার পেটের ওপর মুকুট রেখে ভাবি লক্ষ্মণ সেনের অমার্ত্যরা রাজ-সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। রানির প্রসব আসন্ন হলে কুষ্ঠি বিচারে দেখা যায়, এ মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করলে সন্তান অকালে মারা যাবে। কিন্তু দুঘণ্টা পরে জন্ম হলে লক্ষ্মণ সেন আশি বছর রাজত্ব করবেন। রাজমাতা হুকুম দিলেন তার পা-দুটো ওপরের দিকে তুলে শূন্যে বেঁধে রাখা হোক, যাতে দুঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার আগে কুমার জন্মাতে না পারেন। এ ক্ষেত্রে কুষ্ঠি-গণনা সত্য হয়েছিল। লক্ষ্মণ সেন আশি বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু রাজমাতা ভবিষ্যৎ রাজার জন্ম নির্বিঘ্ন করে তৎক্ষণাৎ মারা যান। প্রাচ্যের জীবনের এসব গল্পের মূল্য অস্বীকার করা যায় না। এ গল্প লেখা আছে সমসাময়িক ইতিহাসকার মিনহাজ সিরাজের বিখ্যাত ইতিহাস বই তবাকত-ই নাসিরিতে। এসব বিখ্যাত ইতিহাসবিদ না লিখে রাখলে এ বঙ্গের কোনো ইতিহাস পাওয়া যেত না।
বাঙালি জীবনের যুগসন্ধিক্ষণে এ দুই ভিনভাষী, ভিনদেশি ও ভিনধর্মী রাজন্যের ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ভিন্নধর্ম ও ভিন্নদেশি সংস্কৃতি এবং ভাষার মিথস্ক্রিয়ায় এখানকার জীবনে এক নতুন ভাষাজাতির জšে§র সূচনা হয়েছিল। আপাত বিচারে মনে হবে, তাদের দ্বারা প্রাপ্ত বিরোধাত্মক চেতনা পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার সম্প্রসারণশীলতা ও টিকে থাকার ক্ষমতার অন্তর্নিহিত শক্তি হিসাবে ধারণা করা যায় এ সাংঘর্ষিক বিরোধাত্মক চেতনা। একই সময় এ অঞ্চলে বিকাশমান সহোদরা ভাষাগুলোর দিকে তাকালে এর যথার্থতা ধরা পড়ে। এত অল্প সময়ে আর কোনো ভাষা তার এত বিশাল ব্যবহার গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারেনি। দ্বান্দ্বিক উপাদানগুলো এ ভাষাকে ঘাতসহ করে তুলেছিল। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এ ভাষা বিকাশের দাবিদার কারা? ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারছি লক্ষ্মণ সেন কিংবা মোহাম্মদ বখতিয়ার কেউই বাঙালি নন। কেবল তা-ই নয়, এ দুজন রাজন্যের আগে আমরা বাংলাভাষার তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপি হাজির করতে পারি না। চর্যাপদের দাবি মনে রাখলে অবশ্য বলতে হয় লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলাভাষার গঠন অনেকখানি দানা বেঁধে উঠেছিল। কিন্তু রাজ দরবারে জায়গা করে নিতে পারেনি। লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব বাঙালি বলে পণ্ডিতরা বিতর্ক করলেও তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘গীতগোবিন্দ’ সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বাংলা ভাষা হিসাবে রাজ-দরবারে জায়গা করে নিয়েছিল ইলিয়াস শাহী, হোসেন শাহী আমলে। রাজ আনুকূল্য পেয়ে বাংলা-এতদিন যা ছিল মুখের ভাষা তাই হয়ে দাঁড়াল সাহিত্য সন্দর্শনের ভাষা। পঞ্চদশ শতকের এসব আনুকূল্য এভূখণ্ডের মানুষকে ভাষাভিত্তিক জাতি গঠনে এগিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানে ইতিহাসের তথ্যাদি এটিই প্রমাণ করে, তুর্কিরা এ দেশে না এলে, স্বাধীন সুলতানি আমল দীর্ঘদিন স্থায়ী না হলে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ এভাবে হতো না। বাংলা ভাষা বিকাশের প্রেক্ষাপট বর্ণনার ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক আলোচনা সব সময় লক্ষ করা যায়। পাল শাসকদের বিতাড়নের মাধ্যমে সেনরা বাংলাভাষা বিকাশের পথ অনেকখানি রুদ্ধ করে দিয়েছিল-এ ভাষ্যের পাশাপাশি তুর্কি শাসনের অন্ধকার যুগের কাহিনিও সমানভাবে চালু আছে। এ ধরনের আলোচনার পশ্চাতে একটি ক্ষমতা-বলয় সক্রিয়। যারা আসলে এ ভাষার মিত্র নন; ব্যবহারকারীও নন। তাদের বিকল্প ভাষা ছিল; এখনো আছে। আরবি-ফারসি, সংস্কৃত, হিন্দি-উর্দু ও ইংরেজিসহ তারা নানা ভাষায় কথা বলতে পারে। তাদের ঘরের ভাষা আর রাজনীতির ভাষা এক নয়। কবি আবদুল হাকিম যাদের কথা বলেছিলেন। তাই বলে ভাষার কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে অস্বীকার করা নয়। এ লেখায় কেবল ভাষা বিকাশের পর্যায়গুলো মোটা দাগে অঙ্কন করা। চর্যাপদ বাদ দিলে এ ভাষার লিখিত পাণ্ডুলিপির ইতিহাস সাড়ে ছশ বছরের বেশি নয়। তবে, একথা ঠিক রাতারাতি যেমন ভাষার সৃষ্টি হয়নি, লিখিত ভাষায় রূপ নিতেও যার লেগেছে বহু শতাব্দী। মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী সডেস এবং লিস এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, এক হাজার বছরে একটা ভাষার কেবল ১৯ শতাংশ শব্দ পরিবর্তিত হতে পারে। সুতরাং পাঁচশ বছরে কেবল নতুন শব্দ এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করা যুক্তিসংগত নয়। এ সময় থেকে মাত্র একশ বছরের মধ্যে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের ভাষাসৌকর্য লক্ষ করলে ফোর্টউইলিয়াম পরবর্তী বাংলাগদ্যের নমুনা মেলে। এ ছাড়া জাতি থেকে বিচ্যুত নিম্নবর্গের মানুষের দুই ঠোঁটের মধ্যে এর আগেই পরম যত্নে ধরা ছিল এ ভাষার শব্দরাজি। ঠোঁট থেকে ঠোঁটে তারা পৌঁছে দিয়েছিল এ ভাষার শব্দ। সম্প্রসারিত করেছিল ভাষার ভূখণ্ড। তাহলে কে বলল বাঙালি যুদ্ধ জানে না। বাঙালি দেশ জয় করেনি। বাঙালির ঘোড়া ছিল না। বাংলাই বাঙালির বাহন। পরস্পরের কাছে যাওয়ার উপায়। বাঙলা নিঃসন্দেহে একটি আধিপত্যবাদী ভাষা; যে ভাষা অন্য ভাষার বিকাশের পথ করেছে সংকুচিত। যে ভাষা তার মাতৃ ও সহোদরা ভাষাগুলোকে আত্তিকরণ করে অন্যতম বৃহত্তর ভাষাগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, ফোর্ট ইউলিয়াম পরবর্তী বাংলার ভাষার ভিত্তি তৈরি করেছিল- আলাওলের বাংলা, সুতরাং এ প্রকল্প ধোপে টেকে না যে, আধুনিক গদ্যের কৃতিত্ব কেবল কেরী, রামরাম বা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের।
তবে ভাষার আধিপত্য আর রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী ভূমিকা এক সূত্রে গাঁথা নয়। রাষ্ট্রের শাসকরা সব সময় রাষ্ট্রকে তাদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। তাদের নীতিকে বলেন রাষ্ট্রের নীতি। তাদের নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হিসাবে প্রচার করেন। অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছেড়ে দিলে, অন্য দল কিংবা অন্য দেশ সে দাবি নিয়ে আসবে না তা কিন্তু নয়। প্রাচীনকালে বঙ্গ নামের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের বাসিন্দারা যে জবানীতে নিজেদের যোগাযোগ গড়ে তুলেছিল কালক্রমে সেই জবানীই বাংলা ভাষা হিসাবে পরিচয় লাভ করে। পরবর্তীকালে আবার এ ভাষাকে কেন্দ্র করেই দেশের সীমানা নির্ধারিত হয়। পুরো বাংলাভাষীরা একটি দেশ গড়ে তুলতে না পারলেও বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড যার জাতীয়তার অন্যতম মৌল উপাদান ভাষা। যোগাযোগের সুবিধার্থে স্বভাষীরা দ্রুত তাদের আবেগের বিষয়গুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারে। ভাষা ঐক্যবদ্ধতার অন্যতম সূত্র হলেও ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তার সীমাবদ্ধতাও কম নয়। বিশেষ করে আজকের সার্বভৌম রাষ্ট্রিক পৃথিবীতে ক্ষুদ্রতমের অধিকারও বাইরে রাখা যায় না। একটা দেশের সীমানার মধ্যে একটি সম্প্রসারণশীল ভাষা থাকলেও বহু ক্ষুদ্র ভাষা ও নৃগোষ্ঠীর এশটি সম্মানজনক অবস্থানের দরকার হয়। ভাষার বাইরেও তখন দেশের অংশিদারত্ব বড় হয়ে দেখা দেয়-তার নামই বাংলাদেশ-বাংলাদেশি।
এ লেখার শুরুটা ছিল উৎসব নিয়ে। মূলত বাঙালির উৎসব। অনেক দূর দিয়ে আসার কারণ, এ কথা বলতে চাওয়া যে বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ অর্ধ-সহস্রাব্দের বেশি নয়। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ বাঙালি উৎসবের বয়স এরচেয়ে বেশি কি করে হয়? তা ছাড়া বাংলা ভাষা নাম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে অষ্টাদশ শতকের পর। পহেলা বৈশাখ দিয়েই বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের শুরু। আর এর শুরু ইংরেজ আসার অনেক পরে। যদিও এ কথা আজ প্রায় সবাই জানেন, বাংলা সনের প্রবর্তক মুঘল সম্রাট আকবর। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ফসল কর্তনের সঙ্গে মিল রেখে তার আমলে এ সৌরবর্ষের সূচনা হয়েছিল। প্রজার তাতে কি লাভ হয়েছিল তা আমরা জানি না। এমনকি নগর জীবনে এ সনের ব্যবহারও বিরল। কিন্তু কোনো ভদ্রলোককেও চাষাবাদের মৌসুম জানার জন্য বাংলা পঞ্জিকার শরণাপন্ন হতে হয়। বাংলা সনটিও বাংলা ভাষার মতো বাঙালির রক্তে মিশে গিয়েছিল। অনায়াসলব্ধ আহ্নিক সময়ানুগ চিত্র বাঙালির মানসপটে অঙ্কিত হয়েছিল। সুতরাং বাংলা সন কেবল বাঙালির দিন গণনা নয়। প্রকৃতির ইচ্ছার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াইয়ের মানচিত্র।
মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন এটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হলেও একমাত্র মত নয়। সম্রাট তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ সিরাজীকে একটি সৌরপঞ্জিকা প্রবর্তনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন- যেহেতু চান্দ্র-পঞ্জিকা প্রাকৃতিক একই ঋতুপর্ব ধরে চলে না-এতে খাজনা আদায়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফতুল্লাহ সিরাজী ১৫৮৪ সালে চান্দ্র বর্ষপুঞ্জি এবং শাকাব্দ বর্ষপঞ্জির একটা সমন্বয় করে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। হিজরি বর্ষকে অক্ষুণ্ন রাখার কারণে ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়-যাকে ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ও বলা হয়। আর বাংলায় এটি নবাব মুর্শিদ কুলি খান পুন্যাহর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিলেন। আবার তারও আগে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি এবং রাজা শশাঙ্ক এ সন ব্যবহার করতেন বলেও মত আছে। যার দ্বারাই এ সন প্রবর্তন হোক না কেন, এ অঞ্চলের মানুষের শ্রম-ঘামে মিশে আছে এ সনের ইতিহাস। তা ছাড়া বাংলা সালের মধ্যে মুসলমানি হিজরি সনও লুখিয়ে আছে, অর্থাৎ এ আত্তিকরণই এ দেশের মুসলিম শাসনের বৈশিষ্ট্য।এখন প্রশ্ন বাংলা সন আর বাঙালির বর্ষবরণ কি এক? বাঙালি কি ইংরেজের ঢঙে তখন এ দিবসটি পালন করত প্রাচীন কালে? হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা কিংবা বৈসাবি-যাই হোক না কেন, আজকের মতো করে নববর্ষের উদযাপন ছিল না অন্তত ইংরেজ এ দেশে আসার আগেও। ইংরেজের হ্যাপি নিউইয়ারের শিক্ষা থেকেই আজকের পহেলা বৈশাখ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু রাজনারায়ণ বসু বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আধুনিক উদ্গাতা বলে মনে করা হয়। এক মুসলিম নৃপতি এ সনের প্রবর্তক হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত সত্যেন, সুভাষ চন্দ্র বসুর পিতামহ এ দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। কারণ তখন ছিল বাঙালির জাতি গঠনের সময়, জাতীয় নায়ক এবং জাতির গর্ব করার মতো ঐতিহ্য খুঁজে বের করার সময়। তাই দখলদারের বিরুদ্ধে রাক্ষস রাবণ হয়ে উঠছেন জাতীয় বীর। কারবালার করুণ কাহিনির মধ্যে উঠে আসছে নতুন ইতিহাস। ইতিহাস থেকে তুলে আনা হচ্ছে সিরাজউদ্দৌলা, শিবাজি প্রমুখ আঞ্চলিক বীরদের। সব কিছুর পশ্চাতে ছিল ঔপনিবেশিকবিরোধী চেতনা। ভিনদেশি দখলদারদের জানানোর একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলা নববর্ষ উদযাপন যে এরপর নিয়মিতভাবেই হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি। শান্তি নিকেতনেও নিয়মিত বর্ষবরণ হতো। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অন্তঃপ্রবাহে রুদ্র-বৈশাখের রূপ অঙ্কিত ছিল। বৈশাখের ভীমমূর্তি তাকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাণী রচনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
বাঙালির নববর্ষ মূলতই বিদ্রোহী নববর্ষ। ব্রিটিশ এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরে জাতীয় জীবনের অনেক কিছু অনুপ্রেরণাহীনতায় হারিয়ে যায়। অথবা সময়ের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক দশক আগেও কলকাতার বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ পালন সেভাবে করতেন না, নিশ্চয় এর জন্ম-কুষ্ঠি তাদের কাছে টানতে পারেনি। কিন্তু পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশি বাঙালিদের এখনো পরমোৎসব। পাকিস্তান-পর্বে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে যখন রবীন্দ্র সংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় তখন রবীন্দ্রনাথের ‘এসো, এসো হে বৈশাখ’ গান গেয়ে শিল্পীরা ঢাকার রাজপথ মুখরিত করে তুলত। ঢাকায় নাগরিক নববর্ষ পালনের উৎসও ছিল বাঙালির চিরাচরিত বিদ্রোহ। যে বাঙালি অন্তরের এ বিদ্রোহটুকু হারিয়ে ফেলবে সে বাঙালি হিসাবে টিকে থাকতে পারবে না। সে হয়তো আরও দামি কোনো ভাষা, বড় কোনো শক্তির অংশভাগ হবে। কিন্তু অস্ট্রিক, মঙ্গলয়েডের যে অস্পৃশ্য রক্তের ধারা আজকের জীবন পর্যন্ত প্রবাহিত-সে জীবনের কেউ হতে পারবে না।