বুয়েটের ডিজাইনে রাজধানীতে নতুন যাত্রা
স্মার্ট নগরের পথে ই-রিকশা
সাইফ আহমাদ
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত এক দশকে ঢাকার অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় বেপরোয়াভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এ বাহনটি ছিল সুসংহত নীতিমালার বাইরে-অনিয়ন্ত্রিত, প্রযুক্তিগতভাবে অপ্রতিসংযত এবং নিরাপত্তার দিক থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা ও যানজটের অন্যতম কারণ হিসাবে এ রিকশাকে দায়ী করা হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে এ সমস্যার একটি টেকসই সমাধানের পথে এগোচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের নকশা অনুযায়ী তৈরি একটি উন্নত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব স্ট্যান্ডার্ড ই-রিকশা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এ নতুন মডেলটি আগামী আগস্ট মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে রাজধানীর তিনটি এলাকায়।
গতি ও স্থিতিশীলতার ভারসাম্য
বুয়েটের তৈরি ডিজাইন অনুযায়ী, ই-রিকশার সর্বোচ্চ গতি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারে। এর চ্যাসিস এবং বডি ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে মাইল্ড স্টিল ও লাইটওয়েট অ্যালুমিনিয়াম উপাদানে, যাতে যানটি স্থিতিশীল থাকে, অথচ অতিরিক্ত ভারী না হয়। এতে ব্যবহৃত হয়েছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, যা চার্জ ধরে রাখে দীর্ঘ সময় এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত চার্জ হয়। এ রিকশার চাকা তিনটি হলেও এর ওজন ভারসাম্য বিতরণ করা হয়েছে এমনভাবে, যেন হঠাৎ বাঁক নেওয়ার সময় উলটে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। ব্রেকিং সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়েছে ফ্রন্ট ড্রাম ও রিয়ার ডিস্ক ব্রেক, যা হালকা যানবাহনের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
স্মার্ট ফিচার ও ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ
বুয়েটের ডিজাইনে উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিট (ECU)। এটি রিকশার মোটর, ব্যাটারি ও ব্রেকিং সিস্টেমের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়। গতি বাড়ানো বা হঠাৎ থামানোর সময় ECU চালকের ইচ্ছার সঙ্গে যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখে। এতে একটি ডিজিটাল স্পিডোমিটার, ব্যাটারি মনিটরিং ডিসপ্লে ও GPS ট্র্যাকারও সংযুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সিটি করপোরেশন চাইলে এসব যানবাহনকে ট্র্যাক ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেস থেকে।
ট্র্যাফিক রুলস অনুযায়ী যান্ত্রিক নকশা
ঢাকার প্রেক্ষাপটে এ যানবাহন প্রধান সড়কে চলবে না, বরং পাড়া-মহল্লার ভেতর দিয়ে চলার উপযোগী। এজন্য রিকশার কাঠামো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে কম গতিতে ব্রেকিং ইফেক্টিভ হয় এবং ভিড়াক্রান্ত এলাকায় সহজে চলাফেরা করতে পারে।
এ ছাড়া প্রতিটি রিকশার সামনে ও পেছনে হ্যালোজেন হেডলাইট ও LED ব্রেক লাইট রাখা হয়েছে, যাতে রাতের বেলাতেও দৃশ্যমানতা নিশ্চিত থাকে। ইন্ডিকেটর সিস্টেম ও হর্নও রয়েছে-যা অতীতে বেশিরভাগ ই-রিকশায় অনুপস্থিত ছিল।
শক্তি সঞ্চয় ও চার্জিং প্রযুক্তি
নতুন মডেলের রিকশাগুলোতে রয়েছে ১২০০-১৫০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ডিসি ব্রাশলেস হাব মোটর, যা বেশি টর্ক দেয় এবং কম ব্যাটারিতে বেশি দূরত্ব চলতে সক্ষম। প্রতিটি রিকশা একবার চার্জে গড়ে ৬০-৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে। চার্জিংয়ের জন্য রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ৪৮ ভোল্ট লিথিয়াম ব্যাটারি সিস্টেম। ভবিষ্যতে ডিএনসিসি শহরের বিভিন্ন এলাকায় ‘সোলার চার্জিং স্টেশন’ চালু করার পরিকল্পনা নিচ্ছে, যাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার আরও উৎসাহিত হয়।
ট্রেইনার ও কারিগরি প্রশিক্ষণ
যেহেতু উন্নত প্রযুক্তির এ যান চালাতে হলে চালককে কারিগরি দিকগুলো জানতে হবে, তাই শুরুতেই ৩০০ জন ‘মাস্টার ট্রেইনার’ গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রথম ধাপে ২০০ জনকে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রশিক্ষণ কনটেন্ট, উপস্থাপন কৌশল, যন্ত্রাংশের ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের নানা কৌশল শেখানো হচ্ছে।
সম্ভাবনার দিগন্ত
এই ই-রিকশা শুধু পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বাহন নয়, বরং এটি নগর পরিবহন খাতে প্রযুক্তিনির্ভর একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। ডিজাইন, ডেটা ট্র্যাকিং, নিরাপত্তা ফিচার এবং সরকারি তদারকির মিলিত প্রয়োগে এটি ঢাকার জন্য একটি মডেল পরিবহন ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যান্ত্রিক নকশা, প্রযুক্তিগত সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রিত গতি—এই তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে বুয়েটের ডিজাইন করা ই-রিকশা হতে যাচ্ছে ঢাকা নগরীর জন্য একটি স্মার্ট ও নিরাপদ যানবাহনের প্রতিচ্ছবি। ডিএনসিসির উদ্যোগ ও সরকারের সমন্বিত প্রয়াস যদি দীর্ঘমেয়াদে বজায় থাকে, তবে এ প্রযুক্তিনির্ভর রিকশা বদলে দিতে পারে নগরীর পরিবহন বাস্তবতা। এবার ই-রিকশা শুধু সস্তা নয়, স্মার্টও।
